জুয়েল অধিকারী
বাংলাদেশ একটি জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র। জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের মূল কাজ হলো রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ, অধিকার, উন্নয়ন ও সেবা নিশ্চিত করা। সমান সুযোগ কিংবা সম-অধিকার ও সেবা প্রদান করতে গিয়ে রাষ্ট্রকে সুনির্দিষ্ট বিধি বিধান ও নীতিমালা প্রণয়ন করতে হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সুযোগ-সুবিধা নিতে বিপরীতে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জনগণকে ব্যয় করতে হয়।
অনেক ক্ষেত্রে জনগণকে বেসরকারী ব্যবস্থার সাহায্য নিতে হয়। যা ব্যয় বহুল এবং অনেকের পক্ষে ব্যয় বহন করা সম্ভব হয় না। জনগণকে বিচার কিংবা আইনী সেবা পেতে নিজ পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ কিংবা আইনী পরামর্শ নিতে হয়। যা ব্যয়বহুল হওয়ায় অনেকের পক্ষে ব্যয় বহন করা সম্ভব হয় না। বিধায় যাদের টাকা নেই বা যারা দরিদ্র তারা টাকার অভাবে মামলা কিংবা অধিকার চাইতে পারে না বা অধিকার বাস্তবায়ন করতে পারে না।
আবার কোন ব্যক্তি যদি কোন নিরপরাধ দরিদ্র ব্যক্তির বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করে সেক্ষেত্রেও তাকে নির্দোষ প্রমাণ করতে তার নিজ খরচে আইনজীবী নিয়োগ করতে হয়। তার যদি অর্থ না থাকে, তাহলে সে তার পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ করতে পারবে না। আর এমনটি যেন না হয়, সেজন্য সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদ এর বিধান অনুযায়ী বাংলাদেশের মহামান্য সুপ্রীম কোর্ট জনস্বার্থে মামলা করার অনুমতি দেয়। কিন্তু সেটি নির্ভর করে কারো ইচ্ছা অনিচ্ছা বা দয়ার উপর। কারো দয়া বা ইচ্ছার উপর রাষ্ট্রের এই দরিদ্র জনগণের ভাগ্য নির্ভর করতে পারে না।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে “সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।” এজন্য দেশের নাগরিকদের জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে এমনকি অনগ্রসর জনগোষ্ঠী, আর্থিকভাবে অসচ্ছল সহায় সম্বলহীন এবং নানাবিধ আর্থসামাজিক কারণে বিচার প্রাপ্তিতে অসমর্থ্য বিচার প্রার্থী জনগণকে আইনগত সহায়তা প্রদানকল্পে বাংলাদেশ সরকার ২০০০ সালে আইনগত সহায়তা প্রদান আইন প্রণয়ন করেন। প্রতি বছর ২৮ এপ্রিল দেশে জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস পালিত হয়। এ বছর “দ্বন্দ্বে কোন আনন্দ নাই, আপস করো ভাই, লিগ্যাল এইড আছে পাশে, কোন চিন্তা নাই” প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে দিবসটি পালিত হচ্ছে।
সকল দ্বন্দ্ব, বিরোধ আপসের মাধ্যমে নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় গণতন্ত্রকে সুসংহত রূপ প্রদানের জন্য এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির ভিত্তি অধিকতর মজবুত করার লক্ষ্যে শক্তিশালী বিচার ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। এই আইনের অধীনে অসচ্ছল বা আর্থিকভাবে অসচ্ছল ব্যক্তি যার বার্ষিক গড় আয় সুপ্রীম কোর্টে আইনগত সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং অন্যান্য আদালতের ক্ষেত্রে এক লাখ টাকার উর্ধ্বে নয়; কর্মে অক্ষম, আংশিক কর্মক্ষম, কর্মহীন কোন ব্যক্তি বার্ষিক ১ লাখ ৫০ হাজার টাকার উর্ধ্বে আয় করতে অক্ষম কোন মুক্তিযোদ্ধা; কোন শ্রমিক যার বার্ষিক গড় আয় এক লাখ টাকার উর্ধ্বে নয়; কোন শিশু; মানব পাচারের শিকার কোন ব্যক্তি; শারীরিক, মানসিক এবং যৌন নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশু; নিরাশ্রয় বা ভবঘুরে; ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা বা নৃগোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের কোন ব্যক্তি; পারিবারিক সহিংসতার শিকার বা সহিংসতার ঝুঁকিতে রয়েছেন; বয়স্ক ভাতা গ্রহণকারী; ভিজিবি কার্ডধারী কোন দুঃস্থ মাতা; দুর্বৃত্ত কর্তৃক অ্যাসিড দগ্ধ নারী বা শিশু; আদর্শ গ্রামে গৃহ বা ভূমি বরাদ্দ প্রাপ্ত কোন ব্যক্তি। অসচ্ছল বিধবা; স্বামী পরিত্যক্তা এবং দুঃস্থ মহিলা, প্রতিবন্ধী; আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে আদালত অধিকার প্রতিষ্ঠা বা আত্মপক্ষ সমর্থন করতে অসমর্থ ব্যক্তি, বিনা বিচারে আটক ব্যক্তি যিনি আত্মপক্ষ সমর্থনের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণে আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল; আদালত কর্তৃক আর্থিকভাবে অসহায় বা অস্বচ্ছল বলে বিবেচিত ব্যক্তি; জেল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক আর্থিকভাবে অসহায় বা অস্বচ্ছল বলে সুপারিশকৃত ব্যক্তিগণ আইনগত সহায়তা পেয়ে থাকেন। মামলা দায়ের থেকে শুরু করে মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি পর্যন্ত ব্যয়ভার সরকার বহন করে থাকেন।
আইনের মাধ্যমে অধস্তন আদালত সমূহে দেওয়ানী ও ফৌজদারী বিচার পরিচালনাসহ সুপ্রীম কোর্টে জেল আপীল, দেওয়ানী আপিল, ফৌজদারী আপিল, দেওয়ানী রিভিশন, ফৌজদারী রিভিশন ও রিট মামলার ক্ষেত্রে লিগ্যাল এইড প্রদানের বিধান রাখা হয়েছে।
প্রত্যেক জেলায় জেলা জজের কার্যালয়ে জেলা লিগ্যাল এইড এর অফিস রয়েছে এবং প্রত্যেক জেলায় একজন করে সিনিয়র সহকারী জজ পদ মর্যাদার জেলা লিগ্যাল এইড কর্মকর্তা রয়েছেন। সেখানে শুধু আইনজীবী নিয়োগ করে মামলা পরিচালনা করার ব্যবস্থায় নয়; ‘এ ডি আর’ এর মাধ্যমে বিরোধ নিস্পত্তিসহ বিনা খরচে আইনগত পরামর্শ ও প্রদান করা হয়ে থাকে।
সরকার বর্তমানে বিনা খরচে আইনি সেবা প্রদানের লক্ষ্যে মামলা/মোকদ্দমা করার প্রাথমিক তথ্য; সরকারী আইনী সেবা সম্পর্কিত যেকোনো পরামর্শ ও অভিযোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে টোল ফ্রি হেল্প লাইন চালু করেছে। শুধু দেশ থেকেই নয় বিদেশ থেকেও কল করার সুযোগ রয়েছে।
আইনগত সহায়তা কার্যক্রম জনমুখী ও কার্যকর করার লক্ষ্যে জেলা কমিটি যতটা শক্তিশালী এবং কার্যকর ভূমিকা রেখে চলেছে উপজেলা কমিটি এবং ইউনিয়ন কমিটি ততটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। জেলা লিগ্যাল এইড কর্মকর্তার কোন যানবাহন সুবিধা না থাকায় তিনি উপজেলা কমিটি এবং ইউনিয়ন কমিটি প্রতিনিয়ত মনিটরিং করতে পারেন না এবং এ কারণে ছিন্নমূল মানুষের দোরগোড়ায় আইনগত সহায়তা এর সুফল এবং সুবিধা সমূহের বার্তা পৌছে দেয়া তার জন্য দুরুহ হয়ে পড়েছে।
জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস উপলক্ষে জেলা আইনগত সহায়তা প্রদান কমিটি, যশোর বর্ণাঢ্য র্যালি, আলোচনা সভা, রক্তদান কর্মসূচি ও তৃণমূল পর্যায়ে এর বার্তা পৌঁছে দেয়ার জন্য নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
লেখক: অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ, যশোর।