এস এম জালাল
যশোর সদর উপজেলার রূপদিয়া মধ্যপাড়ায় হতদরিদ্র পরিবারের ১৪টি বাড়ি ঘরে হামলা, ভাংচুর ও লুটপাটের নেপথ্যে রয়েছে অবৈধভাবে জমি দখলে রাখা নিয়ে বিরোধের জের। হামলার শিকার ভুক্তভোগীরা দীর্ঘদিন জোরপূর্বক খবিবর খানের জমি দখলে রেখেছে। তারা আইন, শালিস ও বিচার অমান্য করে অদৃশ্য শক্তির বলে জবরদখল করে রেখেছিল। কিন্তু তাদের উচ্ছেদের ঘটনাকে কেন্দ্র সৃষ্ট জটিলতাকে রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে সামনে আনা হচ্ছে। হামলার ঘটনায় পাল্টাপাল্টি বক্তব্য পাওয়া গেছে।

জমি ও বাড়ির মালিক খবিবর রহমান খানের দাবি, ভাড়াটিয়ারা এতদিন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের প্রভাব খাটিয়ে জোর করে তাদের জায়গা ও বাড়ি দখল করে রেখেছে। এখন তারা রাজনৈতিক ভোল পাল্টিয়ে জবরদখলে থাকার অপচেষ্টা করছে। তারই অংশ হিসেবে তাদের সম্পদ নষ্ট করে তাদের ওপরই দায় চাপাচ্ছে।
জানা গেছে, দীর্ঘদিন বাড়ি ভাড়া না দেয়া ও জোরপূর্বক বাড়ি দখলের অভিযোগে ভাড়াটিয়াদের বিরুদ্ধে স্থানীয় পুলিশ ক্যাম্প, সেনাবাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্প ও ইউনিয়ন পরিষদে লিখিত অভিযোগ করেন খবিবর খান। এ নিয়ে তাদের মধ্যে মীমাংসার জন্য বসাবসি হয়েছে। ভাড়াটিয়ারা এক মাস সময় চেয়ে নিয়েছিল, তারপরেও বাড়ি থেকে সরতে চাইছে না।

তিনি বলেন, ভাড়াটিয়ারা এতদিন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের প্রভাব খাটিয়ে জোর করে থেকে এসেছে। এখন রাজনৈতিক ভোল্ট পাল্টিয়ে থাকার চেষ্টা করছেন।

স্থানীয়রা জানান, দখলদাদের উচ্ছেদ করতে জমির মালিক কয়েক দফা উকিল নোটিশ, ইউনিয়ার পরিষদে দখলদার উচ্ছেদের জন্য আবেদন করেও কোন ফল পাননি। সরকার পরিবর্তনের পর দখলদারদের উচ্ছেদ করতে আইনশৃংখলা বাহিনীকে জানিয়েছেন তিনি। উভয় পক্ষ কয়েক দফা বসেছেন। আপোসের মাধ্যমে ফেব্রুয়ারি মাসে বাড়ি ছেড়ে দেবে বলে জানায়। নির্দিষ্ট সময়ে বাড়ি না ছেড়ে একটি রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের উপর চাপিয়ে ফায়দা নেয়ার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বাড়ির মালিক ও ভাড়াটিয়ার মধ্যে দখল ও উচ্ছেদ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে গোলযোগ চলছে দীর্ঘদিন ধরে। ১/১১ পর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতার আসার পর থেকে ভাড়াটিয়া ১২ পরিবার বাড়ির মালিককে ভাড়া দেয়া বন্ধ করে দেয়। এর পর থেকে ভাড়াটিয়া ও মালিকের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। তখন বাড়ির মালিক খবিবর রহমান আওয়ামী শাসন আমলে কোন পদক্ষেপ নিতে পারেননি।

জমির মালিক খবিবর রহমান খান বলেন, যশোর সদর উপজেলার রূপদিয়া মৌজার ১৯৬ ও ১৯৭ দাগে মোট ৩০ শতক জমি শাহেদ বকসের কাছ থেকে ক্রয় করেন। বিআরএস রেকর্ডে তার নামে হয়েছে। জমির নিয়মিত খাজনা তিনি পরিশোধ করে থাকেন। এ জমি নিয়ে আদালতে কোন মামলা নেই বলে জানান তিনি।
খবিবর রহমান খানের ছেলে আসলাম খান জানান, ১৯৬, ১৯৭ দাগের মোট ৩০ শতক জমিতে টিনশেডের ঘর নির্মাণ করে তাদেরকে ভাড়া দেয়া হয়। শুরুতে ভাড়াটিয়ারা সঠিকভাবে ভাড়ার টাকা পরিশোধ এবং রশিদ নিয়েছেন। কিন্তু বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসলে ভাড়াটিয়ারা দলীয় প্রভাব খাটিয়ে আমাকে ভাড়ার টাকা দেয় না। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় হুমকি দিয়েছে। সে সময় ভাড়াটিয়ারা বলতো, ‘আমরা কোনদিন তোর ভাড়ার টাকা দেব না। আর যদি কোনদিন ভাড়ার টাকা চাইতে আসিস তা হলে জামায়াত শিবির বলে জঙ্গি মামলা দিয়ে ঘর ছাড়া করবো। তোকে ও তোর ছেলেমেয়েদেরকে জানে শেষ করে দেব।’

এলাকাবাসী জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায়ের পর তাদেরকে দখল ছেড়ে দেয়ার জন্য চাপ দেন খবিবর খান। কিন্তু তারা দখল ছাড়তে চায় না। এ নিয়ে তাদের সাথে কথা কাটাকাটিও হয়।

খবিবর খা, ভাড়াটিয়া উচ্ছেদ করতে বিরোধে না গিয়ে আইনানুযায়ী আইনজীবীর মাধ্যমে ভাড়াটিয়া চান্দু, আয়নাল হক, ইসমাইল, কাল্লা (কালু), আবু জাফর, বাদশা, রাজুসহ ১২ জনকে লিগ্যাল নোটিশ পাঠানো হয়। তারপরেও তারা ভাড়া বাড়ি ছেড়ে দেয়নি। পরে তিনি কোতয়ালী থানায় অবৈধ ভাড়াটিয়া উচ্ছেদের জন্য আবেদন করেন।

খবিবর খান জানান, গত ১৬ ডিসেম্বর পুলেরহাটস্থ অস্থায়ী সেনা ক্যাম্পে তার অভিযোগের ভিত্তিতে শুনানি হয়। এ সময় ভাড়াটিয়ারা উপস্থিত ছিলেন। জমির কাগজপত্র যাচাই শেষে ভাড়াটিয়াদের ২৬ ফেব্রুয়ারি মধ্যে শান্তিপূর্ণভাবে জমির দখল ছেড়ে দিতে বলা হয়। কিন্তু ভাড়াটিয়ারা তা না করে জোরপূর্বক বাড়ি দখল করে রাখে।

খবিবর আরও জানান, এ বাড়ি ও জমি তার। দলিল ও রেকর্ড রয়েছে। খাজনাও তিনি পরিশোধ করে আসছেন। তিনি বলেন, এ ঘটনা আমার ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক নয়।

গত ১৩ এপ্রিলের ঘটনার বিষয় তিনি বলেন, ভাড়াটিয়াদের সাথে মীমাংসা হয়েছিল, তারা ২৬ ফেব্রুয়ারির মধ্যে বাড়ি ও জায়গা ছেড়ে দিবে। সেদিন সকালে পরিবারের লোকজন নিয়ে বাড়ি চারপাশে বেড়া তৈরি করতে গেলে ভাড়াটিয়ারা বাঁধা দেয়। এ নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়।

ঘরবাড়ি ভাংচুরের বিষয়ে তিনি বলেন, আমার বাড়ি আমি কেন ভাংচুর করবো। ভাড়াটিয়ারা আমার সম্পদ নষ্ট করে উল্টো আমার নামে মামলা দিয়েছে। এখন বিষয়টি থেকে তারা রাজনৈতিক ফায়দা নেয়ার চেষ্টা করছে।’
এদিকে, ভাড়াটিয়া মিলন, সালমা খাতুন, শফিকুল ইসলাম বলেন, হামলাকরীরা আমাদের উপর দেশি অস্ত্র নিয়ে হামলা, বাড়ি ভাংচুর ও লুটপাট করেছে। তবে তারা স্বীকার করেন যে, এ জমি তাদের না। তারা দীর্ঘদিন ধরে এখানে ভাড়া নয়, ফ্রি বসবাস করছেন।

এ হামলার ঘটনায় ভুক্তভোগী ইজিবাইক চালক মিলন হোসেন বাদী হয়ে ঘটনার দিন রাতেই যশোর কোতোয়ালী থানায় একটি এজাহার দায়ের করেন।

এদিকে, ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ি-ঘর পরিদর্শন করেছেন বিএনপি ও জামায়াতের নেতৃবৃন্দ। এ সময় ক্ষতিগ্রস্তদের চাল ও নগদ টাকা সহায়তা দেয়া হয়েছে।

এ ব্যাপারে যশোর জেলা জামায়াত আমীর অধ্যাপক গোলাম রসূল বলেন, হামলা ও বাড়ি ভাংচুরের বিষয়টি জমাজমি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে ঘটেছে। একটি পক্ষ রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য জামায়াতের ওপর দায় চাপাচ্ছে।

এ বিষয়ে বিএনপির খুলনা বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত বলেন, আমরা বিশ্বাস করি কোন রাজনৈতিক দল এ ধরনের কর্মকাণ্ড সমর্থন করে না। আমরা এর তীব্র নিন্দা ও জড়িতদের আটকের দাবি জানাচ্ছি।

Share.
Exit mobile version