হাসান আদিত্য
রাত পোহালেই যশোর সদর উপজেলা পরিষদের নির্বাচন। বুধবার সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনের মাধ্যমে এই নির্বাচনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। তিনটি পদেও বিপরীতে লড়ছেন ১৬ প্রার্থী। এবার দলীয় প্রতীক না থাকায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবেই লড়ছেন তারা। ফলে নিজ দলেই মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনের চেয়ারম্যান পদে ত্রিমুখি লড়াইয়ের সম্ভাবনা দেখছেন সাধারণ ভোটাররা। তাদের ভাষ্য, প্রার্থীরা সবাই একই দলের। তাই আওয়ামী লীগের ভোট ভাগ হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে যার বলয়ের পাল্লা ভারি হবে তিনিই হবেন চেয়ারম্যান। আবার কেউ বলছেন, বিএনপি সমর্থিত ভোটাররা যাকে বেছে নিবেন তার গলায় উঠবে বিজয়ের মালা।
এদিকে, সোমবার ছিলো প্রচার প্রচারণার শেষ দিন। তবে বেশির ভাগ প্রার্থীরা তাদের প্রচার-প্রচারণার ছেড়ে প্রার্থীদের একে অপরের বিরুদ্ধে শেষ মুহূর্তে রয়েছে হামলা-ভাংচুর, হত্যার হুমকিসহ নানা অভিযোগ। কখনও সংবাদ সম্মেলন আবার কখনও প্রচারকালে অভিযোগ তুলেছেন তারা। এতে শেষ মুহূর্তে ভোটের মাঠের পরিস্থিতি অনেকটাই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। স্থানীয় সংসদ সদস্য, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সম্পাদকের বিরুদ্ধেও পছন্দের প্রার্থীকে বিজয়ী করতে নির্বাচনে প্রভাব খাটানোর অভিযোগও রয়েছে। অভিযোগ উঠেছে ভোটগ্রহণকালে কালোটাকা ছড়িয়ে ভোটগ্রহণকারী কর্মকর্তাদের পক্ষে নেয়ার।
অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশন (ইসি) ইতোমধ্যে সব প্রস্তুতি শেষ করেছে। আজ সকাল থেকে কেন্দ্রে কেন্দ্রে পৌঁছে যাবে নির্বাচনি সামগ্রি। সদরের ১টি পৌরসভা ও ১৫টি ইউনিয়নের ২১৯টি ভোট কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ হবে। মোট ভোটার ৬ লাখ ৭ হাজার ৭৪২ ভোটার। এর মধ্যে পুরুষ ৩ লাখ ৪ হাজার ৭৩০, মহিলা ৩ লাখ ৩ হাজার ৫২ ও হিজড়া ভোটার ৭ জন। ২১৯টি ভোট কেন্দ্রে ১৭৫৬ কক্ষে ভোটগ্রহণ হবে। এতে দায়িত্ব পালন করবেন ২১৯ প্রিজাইডিং অফিসার, ১৭৫৬ সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ও ৩৫১২ পোলিং অফিসার। তৃতীয় ধাপে গেল ২৯ মে সদর উপজেলা পরিষদের ভোট গ্রহণের কথা ছিলো। কিন্তু সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহারুল ইসলামের করা মামলার কারণে সেটি স্থাগিত হয়। স্থগিত হওয়ায় ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের চতুর্থ ধাপে এই উপজেলাতে ভোট গ্রহণ হবে।
নির্বাচনে চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রতিন্দ্বন্দ্বিতা করছেন ১৬ প্রার্থী। এর মধ্যে চেয়ারম্যান প্রার্থী ৮, পুরুষ ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী ৫ ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী ৩ জন। এরমধ্যে এমপি কাজী নাবিল আহমেদ’র সমর্থন নিয়ে প্রার্থী হয়েছেন দোয়াত কলম প্রতীকের আনোয়ার হোসেন বিপুল। আর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলন ও সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার গ্রুপের সমর্থন নিয়ে মোটরসাইকেল প্রতীকে ভোট করছেন তৌহিদ চাকলাদার ফন্টু।
জেলা যুবলীগের সভাপতি মোস্তফা ফরিদ আহমেদ চৌধুরী ভোট করছেন আনারস প্রতীক নিয়ে। শালিক প্রতীকে ভোট করছেন যশোর সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহিত কুমার নাথ এবং জোড়া ফুল প্রতীকে সমর্থন পেতে ছুটছেন সাধারণ সম্পাদক শাহারুল ইসলাম। কাপ পিরিচ প্রতীক নিয়ে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছেন শফিকুল ইসলাম জুয়েল। এছাড়া ঘোড়া প্রতীক নিয়ে নিরলস ছুটছেন একমাত্র নারী চেয়ারম্যান প্রার্থী ফাতেমা আনোয়ার। আর ভোটের মাঠে আছেন হেলিকপ্টার প্রতীকের আরিফুল ইসলাম হীরা। পুরুষ ভাইস চেয়ারম্যান পদে কামাল খান পর্বত (তালা), মনিরুজ্জামান (উড়োজাহাজ), শাহজাহান কবীর শিপলু (চশমা), শেখ জাহিদুর রহমান (বৈদ্যুতিক বাল্ব) ও সুলতান মাহমুদ বিপুল (টিউবওয়েল)। মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে শিল্পী খাতুন (হাঁস), বাশিনুর নাহার (ফুটবল) ও জ্যোৎস্না আরা মিলি (কলস)।
জেলার সদর উপজেলায় নির্বাচন হওয়াতে নির্বাচনী আমেজ ছিলো চোখে পড়ার মতো। নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণাতে কেউ কাউকে ছাড় দেয়নি। মাঠে ময়দানে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমনকি মুঠোফোনে ডিজিটাল ভয়েজ কলের মাধ্যমেও প্রার্থীরা ভোটারদের কাছে ভোট চাচ্ছেন। ভোটররা বলছেন, বহুদিন পর ভোটের ইমেজ খুঁজে পাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। বাড়ি বাড়ি, এমনকি বাজার-ঘাটেও দল বেধে নারী কর্মীরা ভোটের লিফলেট বিতরণ করছেন। ভোটের এই ‘কালচার’ বিগত বেশ কয়েকটি ভোটে চোখে পড়েনি বলে জানিয়েছেন কয়েকজন সাধারণ মানুষ। তারা বলছেন, চেয়ারম্যান প্রার্থীরা মাইক প্রচারণায় এগিয়ে থাকলেও বাড়ি বাড়ি লিফলেট বিতরণে এগিয়ে ছিলো ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীরা। মার্কা দেয়ার আগে থেকেই শুরু হয়েছে চুলচেরা বিশ্লেষন। সে বিশ্লেষণ এখনো চলছে। কে হচ্ছেন যশোরের চেয়ারম্যান? কে জিতবেন বিজয়ের মুকুট? তা নিয়ে চায়ের দোকান থেকে নেতাদের ড্রইং রুম সর্বত্র আলোচনার ঝড়। আর সে ঝড়ের চূড়ান্ত ফলাফল দেখতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় রয়েছেন যশোরের আট উপজেলার মানুষ। কারণ, যশোরে উপজেলা নির্বাচন ঘিরে চলছে রাঘব-বোয়ালের লড়াই।
এদিকে, মোটরসাইকেল প্রতীকের এক কর্মীকে মারপিটের অভিযোগ উঠেছে দোয়াত কলমের কর্মীর বিরুদ্ধে। তবে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন আনোয়ার হোসেন বিপুল।
মোস্তফা ফরিদের অভিযোগ :
সোমবার প্রচার প্রচারণার শেষ দিনে প্রার্থীদের একে অপরের বিরুদ্ধে শেষ মুহূর্তে রয়েছে হামলা-ভাংচুর, হত্যার হুমকিসহ নানা অভিযোগ। কখনও সংবাদ সম্মেলন আবার কখনও প্রচারকালে অভিযোগ তুলেছেন তারা। এতে শেষ মুহূর্তে ভোটের মাঠের পরিস্থিতি অনেকটাই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। যশোর সদর উপজেলা পরিষদের নির্বাচনের চেয়ারম্যান প্রার্থী মোস্তফা ফরিদ আহমেদ চৌধুরী সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময় করেছেন। সোমবার দুপুরে প্রেসক্লাব যশোরে মতবিনিময়কালে তিনি সদর উপজেলার বেশ কয়েকটি নির্বাচনী এলাকায় সুষ্ঠু পরিবেশ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, যশোরের ১ নং ওয়ার্ড, ৯ নং ওয়ার্ড, বসুন্দিয়া ইউনিয়ন এবং নওয়াপাড়া ইউনিয়নের কিছু অংশে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটাদের হুমকি দিচ্ছে আরেকজন প্রার্থীর সমর্থকরা। যদি তাকে ভোট না দেয়া হয় তাহলে কেন্দ্রে যেতেও নিষেধ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
মোস্তফা ফরিদ আহমেদ চৌধুরী বলেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রার্থীদের কেউ কেউ টাকা ছেটানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। আবার কেউ কেউ হুমকি ধামকিও দিচ্ছেন। এছাড়া স্থানীয় সংসদ কাজী নাবিল আহমেদ সরসরি নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন। এমনকি তিনি কিশোর গ্যাংয়ের আশ্রয় প্রশ্রয়দাতাকে প্রার্থী হিসেবে মনোনিত করে তার পক্ষে কাজ করছেন। যা মোটেও সমোচিন নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ দুই নেতা আরেক প্রার্থীর জন্য মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। তাদের বিরুদ্ধেও নানা অভিযোগের কথা তিনি তুলে ধরেন। তিনি আরো বলেন, লিমিটেড কোম্পানি ও তিন বোলয় থেকে বের হতে চান। তিনি আগামী ৫ জুন সদর উপজেলা এলাকায় সুষ্ঠু নির্বাচন দাবি করেন। এজন্য তিনি প্রশাসন ও সাংবাদিকদের সহযোগিতা কামনা করেন।
আনোয়ার হোসেন বিপুলের ইশতেহার ঘোষণা :
সোমবার যশোর সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী আনোয়ার হোসেন বিপুল সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময় করেন। প্রেসক্লাব যশোর মিলনায়তনে মতবিনিময়কালে তিনি তার নির্বাচনী ইশতেহার উপস্থাপন করেন। ইশতেহারে তিনি সদর উপজেলা এলাকার উন্নয়ন ও এলাকাবাসীর শান্তিময় পরিবেশ তৈরির অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। এসময় তার সাথে উপস্থিত ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা খয়রাত হোসেন, সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম আফজাল হোসেন, শ্রম বিষয়ক সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সবুর হেলাল, তথ্য গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক ফারুক আহমেদ কচি, নির্বাহী সদস্য প্রভাষক সাইফুল ইসলাম তুহিন ও এহসানুর রহমান লিটু।
আরিফুলের ২৫ দফা ইশতেহার :
চেয়ারম্যান প্রার্থী আ.না.ম আরিফুল ইসলাম হিরা সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময় সভায় নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেন। সোমবার সকালে প্রেসক্লাব যশোরে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় চেয়ারম্যান প্রার্থী হিরা তার নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেন। এসময় তিনি সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব নেন। তিনি যশোর সদর উপজেলার সাধারণ মানুষের কল্যাণে কাজ করার অঙ্গীকার নিয়ে ২৫টি ইশতেহার ঘোষণা করেন।
তিনি অভিযোগ করেন-নির্বাচনে কালো টাকার ছড়াছড়িতে নেমেছেন প্রার্থীরা। নির্বাচনে ২৫ লাখ টাকা খরচের নিয়ম থাকলেও প্রার্থীতা সেটা মানছেন না। একই সাথে কালোটাকা ছড়িয়ে ভোটগ্রহণকারী কর্মকর্তাদের পক্ষে নেয়ার। এ সময় তার সাথে ছিলেন যশোর জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রাকিবুল আলম হিরন, মহিলা আওয়ামী লীগের নেত্রী জাহানারা বেগম, রিক্সা-ভ্যান শ্রমিক লীগের সহ-সভাপতি কাঞ্চন শেখ, সাংগঠনিক সম্পাদক অরেছ ইসলাম, লেবুতলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক হাফিজুর রহমান।