বাংলার ভোর প্রতিবেদক
চার দশক ধরে খেজুর গুড় তৈরি করেন গাছি আবদুল গণি (৭০)। শীতের মৌসুমে তার ব্যস্ততা বেড়ে যায়। রস গুড় বিক্রি করেই চলে সংসার। গুড়-পাটালি নিয়ে হাজির হয়েছেন খেজুর গুড় মেলায়। ক্রেতা ও দর্শনার্থীদের ভিড়ে দরকষাকষি করে ন্যায্য দামে গুড়-পাটালি বিক্রি করতে পেরে খুশি তিনি। আরেক গাছি ও তরুণ উদ্যোক্তা আবদুল কুদ্দুস (৩৫) তিন শতাধিক খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে গুড় পাটালি বিক্রি করেন। গুড় মেলায় প্রায় একশ’ কেজি গুড়ি পাটালি নিয়ে হাজির হয়েছেন। বিক্রিতে সাড়া পেয়েছেন বেশ। শুধু আবদুল গণি কিংবা আবদুল কুদ্দস নয়, তাদের মত প্রায় দুই শতাধিক গাছির খেজুর গুড়-পাটালির পসরায় জমজমাট হয়ে উঠেছে যশোরের চৌগাছার খেজুর গুড় মেলা।
বুধবার সকালে উপজেলা চত্বরে চৌগাছা উপজেলা প্রশাসন আয়োজিত তিনদিন ব্যাপি খেজুর গুড় মেলার উদ্বোধন করা হয়। ফিতা কেটে ও বেলুন উড়িয়ে গুড় মেলা উদ্বোধন করেন যশোরের জেলা প্রশাসক আজাহারুল ইসলাম।
জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, বর্তমানে যশোরে উৎপাদিত গুড়ের পরিমাণ প্রায় ৩৭ লাখ ২০০ কেজি। শীত এলেই পড়ে যায় খেজুর ও রস দিয়ে পিঠা তৈরির ধুম। সম্প্রতি শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে যশোরের খেজুরের গুড়কে জিআই পণ্যেও স্কীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে চৌগাছা উপজেলায় ১৪শ’ গাছির বসাসবস। গাছের সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার। ২০২৩ সালে যশোরের চৌগাছা উপজেলা প্রশাসন প্রথম খেজুর গুড়ের মেলা চালু করে। সেই ধারাবাহিকতায় তৃতীয়বারের মত এবারও গুড় মেলার আয়োজন করা হয়েছে। বুধবার আনুষ্ঠানিকভাবে মেলার উদ্বোধন করা হয়। মেলায় উপজেলার ১১টি ইউনিয়নের দুই শতাধিক গাছি অংশ নেন। গাছিরা তাদের উৎপাদিত গুড়, পাটালি নিয়ে স্টল দেন। গুড়, পাটালি বিক্রির পাশাপাশি এই শিল্পের সম্প্রসারণে প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। গুড় মেলায় গাছিদের পাশাপাশি ক্রেতা ও দর্শনার্থীদের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মত।
মানভেদে খেজুর গুড় ও পাটালি প্রতি কেজি ৩৫০ টাকা থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত দরে বিক্রি হয়েছে। পাঁচ বছর ও সাত বছর বয়সী দুই মেয়েকে নিয়ে মেলায় আসেন এনজিও কর্মী তৌফিকুর রহমান। তিনি বলেন, ছোট বেলায় বাবা গাছ কাটতেন। রস জ্বালিয়ে মায়ের হাতের গুড় খাওয়ার জন্য গোল হয়ে বসে থাকতাম ভাইবোনেরা। এখন মা বাবাও নেই আর গাছও নেই। আমরা গুড় তৈরি করা দেখলেও আমার সন্তানেরা দেখেনি। তাই সন্তানদের নিয়ে মেলায় এসেছি; ঘুরে ঘুরে গুড় তৈরি ও গুড় দেখাচ্ছি। বাচ্ছারা খুব ফুলকিত হচ্ছে।
শিহাব উদ্দিন নামে এক ক্রেতা জানান, ‘যশোর গুড় স্বাদে মানে অন্যন্য। কিন্তু বাজারে গুড় কিনতে ভয় পায় ভেজালের কারণে। মেলার খবর শুনে চলে এসেছি; ঘুরে ঘুরে গুড় দেখছি; স্বাদ নিচ্ছি। নির্ভেজাল গুড় এখানে।’ মেলায় অংশ নেয়া হুদা ফতেপুর গ্রামের গাছি নজরুল ইসলাম বলেন, বিশ বছর ধরে গাছ কাটি। এবছর ৫২টি গাছ কাটছি (রস সংগ্রহ) করছি। খুব বেশি গুড় বানাতে (তৈরি) করতে পারিনি, গুড় বেশি হবে ফাল্গুন মাসে। এখন শীত বেশি, জিরেন (স্বচ্ছ) রস সব বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। এক ভাড় রস ২৫০ টাকায় বিক্রি করছি। গুড়ের চেয়ে রস বিক্রিতে বেশি লাভ।
পাশাপোল গ্রামের গাছি আলম গাজি বলেন, ত্রিশ বছর ধরে গাছ কাটি (রস সংগ্রহ)। এবারও ২৫টি গাছ কাটছি। গাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এজন্য গুড় বেশি তৈরি করতে পারছি না। মেলায় গুড়-পাটালি এনেছি। ভাল দাম পাচ্ছি।
মেলায় আসা সিংহঝুলি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হামিদ মল্লিক বলেন, ২০২৩ সালে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইরুফা সুলতানার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় প্রথমবারের মত চৌগাছায় খেজুর গুড়ের মেলা চালু করা হয়। সেই ধারাবাহিকতায় এবারও মেলা হচ্ছে। ইতোমধ্যে খেজুর গুড় যশোরের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। খেজুর গুড়ের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও শিল্পের বিকাশে এই মেলা অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।
উপজেলা সমবায় অফিসার অহিদুর রহমান বলেন, গাছিরা আগে সংগঠিত ছিল না। উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ১১টি ইউনিয়নে একটি করে গাছি সমবায় সমিতি গঠন করা হয়েছে। গাছিরা এখন সংগঠিত। তাদেরকে সরকারিভাবে সহযোগিতা করা হচ্ছে।’ মেলার আয়োজক চৌগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুস্মিতা সাহা বলেন, খেজুর গুড় যশোরের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। খেজুর গুড়ের অর্থনীতি সম্প্রসারণ ও কর্মসংস্থান তৈরির লক্ষ্যে মেলার আয়োজন করা হয়েছে। মেলায় ব্যাপক সাড়া পড়েছে। জেলা প্রশাসক আজাহারুল ইসলাম বলেন, খেজুর গুড়ের ঐতিহ্যকে সারাবিশ্বের সামনে তুলে ধরার লক্ষ্যে মেলার আয়োজন করা হয়েছে। খেজুর গুড় উৎপাদনের মাধ্যমে উদ্যোক্তা তৈরি ও কর্মসংস্থানের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে চাই।
এদিকে, বুধবার সকালে উপজেলা চত্বরে মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জেলা প্রশাসক আজাহারুল ইসলাম। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুস্মিতা সাহার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন সহকারী কমিশনার (ভূমি) তাসমিন জাহান, প্রেসক্লাব যশোরের সভাপতি জাহিদ হাসান টুকুন, চৌগাছা উপজেলা বিএনপির সভাপতি আবদুস সালাম প্রমুখ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোশাব্বির হোসাইন। মেলা উপলক্ষে প্রতিদিন গম্ভিরা, লাঠিখেলা, পিঠা উৎসব ও কুইজ প্রতিযোগিতা। তিন দিনব্যাপি মেলার শেষ হবে ১৭ জানুয়ারি।