বাংলার ভোর ডেস্ক
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব, অর্থাৎ সংসদ নির্বাচনে দলের ভোটের অনুপাতে সংসদে আসন বণ্টনের যে আলোচনা উঠেছে, তাকে অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবু হেনা। ভোটের পদ্ধতি না পাল্টিয়ে বিদ্যমান ব্যবস্থাকে কার্যকর করার সুপারিশ করে তিনি বলেছেন, সংস্কারের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আইনের প্রয়োগ। যোগ্য নির্বাচন কমিশন থাকলে রাজনৈতিক সরকারের অধীনেও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব বলেও মত দিয়েছেন তিনি।
১৯৯৬ সালের ১২ জুনের বিতর্কমুক্ত নির্বাচন আয়োজনের দায়িত্বে থাকা সাবেক সিইসি সোমবার দুপুরে আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। পরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে এসব কথা বলেন তিনি। জামায়াতসহ কয়েকটি দল জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থার দাবি করছে।
গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে দুই ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে। একটি হচ্ছে, নির্বাচনি এলাকায় প্রার্থীদের মধ্যে যিনি সর্বোচ্চ ভোট পাবেন, তিনি নির্বাচিত হবেন। এ পদ্ধতিকে বলা হয় ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’। বাংলাদেশসহ বেশিরভাগ দেশেই এর চর্চা আছে।
অন্য পদ্ধতি হল সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা বা ‘প্রপোরশনাল রিপ্রেজেনটেশন’ পদ্ধতি। সেখানে আসনভিত্তিক কোনো প্রার্থী থাকে না। ভোটাররা ভোট দেবেন দলীয় প্রতীকে। একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে সংসদে তাদের আসন সংখ্যা নির্ধারণ হবে।
নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার করে এমন পদ্ধতিতে যাওয়ার প্রয়োজন আছে কিনা, এ প্রশ্নে আবু হেনা বলেন, “না, আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে, নির্বাচন পদ্ধতির পরিবর্তনের কোনো প্রয়োজন নেই। এখানে আমাদের ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ সিস্টেম রয়েছে। এ সিস্টেমই কার্যকর হতে পারে, মানুষের এ সিস্টেমের সাথে পরিচয় রয়েছে। আমরা মনে করি না, নতুন কোনো সিস্টেমের (প্রয়োজন রয়েছে)। নেপাল ও ইসরাইলের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, যেসব দেশে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা আছে, সেসব দেশে তা ভালো কাজ করছে না। আমাদের যে সিস্টেম রয়েছে, যেটার সঙ্গে মানুষ পরিচিত সে পদ্ধতিই কার্যকর করে গড়ে তোলা দরকার। সেটাই সবচেয়ে বড় কথা।
পরে এ বিষয়ে এক প্রশ্নে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার সাংবাদিকদেরকে বলেন, “এটা (সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) যদি সিদ্ধান্ত হয়, তাহলে তো সংবিধান সংশোধন করতে হবে। আরও অনেক বিষয় রয়েছে, যেখানে সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন হতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে নানা প্রস্তাব পাওয়া যাচ্ছে জানিয়ে তিনি এও জানান, বেশ কিছু দল ভোটের পদ্ধতি পাল্টানের কথা বলেছে।
সংস্কারের চেয়ে বেশি প্রয়োজন আইনের প্রয়োগ:
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর ‘সংস্কার’ এর যে আলোচনা উঠেছে, সেটি নিয়েও কথা বলেন আবু হেনা। নির্বাচনি আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ বা আরপিওর কয়েকটি ধারায় পাল্টানোর কথাও বলেন সাবেক এ সিইসি। তিনি এও বলেছেন যে, বেশি প্রয়োজন হল আইনের প্রয়োগ।
সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে-আমি যেটা বলেছি, আইন যতই ভালো করেন না কেন, আইনের প্রয়োগ না হলে কিন্তু সেই আইনের অর্থ নেই।
নির্বাচন কমিশনে যোগ্য লোক দরকার বলে মত দিয়ে তিনি বলেন, “বোল্ড ও কারেজাস (দৃঢ় ও সাহসী) লোক, স্ট্রং (শক্তিশালী) ইলেকশন কমিশন এবং রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা নেই এমন মানুষের খুব দরকার। সুনাম রয়েছে এমন ব্যক্তি, কমিটেড (প্রত্যয়ী) লোক দরকার।
রাজনৈতিক সরকারের অধীনেও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব:
যোগ্য লোক থাকলেও রাজনৈতিক সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব কি না- এমন প্রশ্ন ছিল আবু হেনার কাছে। জবাবে তিনি বলেন, (রাজনৈতিক সরকারের আমলে) যোগ্য লোক যদি থাকে নিশ্চয় তারা (ভালো নির্বাচন) করতে পারে। করতে পারবে না কেন? ভারতে করছে করছে না? ভারতে ও তো রাজনৈতিক দল (সরকার) আছে, সেখানেও তো সুষ্ঠু নির্বাচন হয়। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সে কমিটমেন্টই (সদিচ্ছা) যদি থাকে, নিশ্চয়ই পারা যায়। প্রয়োজনে তারা নানা ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে। এগুলো খেয়াল রাখা দরকার।
তৃণমূলের মতের ভিত্তিতে প্রার্থী বাছাই জরুরি:
দলের তৃণমূলের মতামতের ভিত্তিতে সংসদ ও স্থানীয় নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নে রাজনৈতিক দলগুলো নজর দিলে দেশের জন্য কল্যাণ হবে বলেও মত দেন আবু হেনা।
তিনি বলেন, “আর আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির উন্নয়ন দরকার। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রার্থী নির্বাচনও আরও সুষ্ঠু হওয়া দরকার। এটা উপর থেকে আরোপ করা নয়; এটা নিচে থেকে (গণতান্ত্রিক চর্চা) করা দরকার। ভোটের মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে নির্বাচন করে প্রাইমারি ইলেকশনের মত বাছাই করে যোগ্যপ্রার্থী মনোনয়ন করা দরকার।
সাবেক সিইসির পর গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলে, উনি (আবু হেনা) বলেছেন, আমরা সঠিক পথেই আছি; আমরা যেসব বিষয় বিবেচনায় নিচ্ছি, পর্যালোচনা করছি ও অগ্রাধিকার হিসেবে নিয়েছি, সেগুলো উনার অভিজ্ঞতার আলোকে সঠিক পথেই আছি। এটা বড় পাওয়া। আমরা উৎসাহিত হয়েছি ।
কাজের অগ্রগতির বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমরা আইনকানুন, বিধি-বিধান পর্যালোচনা করছি। অনেকগুলো বিষয় চিহ্নিত করার চেষ্টা করছি, গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করছি। আইনে কীভাবে প্রতিফলিত হবে সেটা আমরা দেখছি।
কমিশন এ পর্যন্ত ১৭টি বৈঠক করেছে জানিয়ে কমিশন প্রধান বলেন, রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে অনানুষ্ঠানিকভাবে অনেক প্রস্তাব পেয়েছি, আনুষ্ঠানিকভাবেও পেয়েছি। আরও পাব। সবার কথা শুনতে চাই সীমিত সময়ের মধ্যে। সবার মতামতের ভিত্তিতে কিছু সুপারিশমালা উপস্থাপন করব।