বাংলার ভোর প্রতিবেদক
সীমাহীন নৈরাজ্য, লুটপাট, ভাংচুর অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে যশোরে। গত সোমবার বিকেলে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পদত্যাগের পর হোটেল জাবির ইন্টারন্যাশনালে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেন বিজয়মিছিলে থাকা বিক্ষুব্ধ জনতা। এতে প্রাণ হারিয়েছেন ২৪ জন। পুড়ে অগ্নিদগ্ধ হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন ২৩ জন।
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, সংসদ সদস্য, জনপ্রতিনিধিদের কার্যালয়, বাড়িতে ভাংচুর অগ্নিসংযোগ, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে লুটের ঘটনা ঘটেছে। সংখ্যালঘুদের বাসাবাড়ি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাংচুর লুটের ঘটনাও পাওয়া গেছে। জেলাজুড়ে চরম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি চলছে। গত দুই দিন ধরে চলা এই ধ্বংসযজ্ঞ ও নৈরাজ্য থামাতে কোথাও কাউকে দেখা যায়নি। কারফিউ উঠিয়ে নিলেও আতঙ্কে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খুলতে ভয় পাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এসব দেখে চরম উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় সময় পার করছেন জেলাবাসী।
এমন পরিস্থিতিতে বুধবার বেলা সাড়ে ১১ টার দিকে জেলার সার্বিক আইনশৃংখলা পরিস্থিতি রক্ষার্থে বিশেষ মতবিনিময় করেন জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবরাউল হাছান মজুমদারের সভাপতিত্বে ১৪ দলীয় জোট বাদে সর্বদলীয় নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় হয়। সভায় বক্তারা মত দিয়েছেন, জেলার শান্তিশৃংখলা রক্ষায় প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলগুলো একযোগে কাজ কর পুলিশ তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু করার। রাজনৈতিক দলগুলো তাদেরকে সহযোগিতা করবে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে সচেতনতা বাড়াতে মাইকিং করা হবে। মসজিদের মাইকেও ঘোষণা দেয়া হবে সহিংসতা পরিহার করার জন্য। বক্তব্য রাখেন প্রশাসনের কর্মকর্তা, রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, সাংবাদিক, আইনজীবীগণ।
মতবিনিময় সভায় বিএনপির খুলনা বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত বলেন, আমরা গত ১৭ বছর গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের জন্য লড়াই করেছি। আমরা একটি বৈষম্যহীন সমাজের কথা বলেছি। স্বাধীন গণমাধ্যম, বাক স্বাধীন ও ভোটাধিকারের কথা বলেছি।
আইনের শাসন, মানবাধিকারের কথা বলেছি। আমরাই বলেছিলাম। আপনারা বলতে সাহস পাননি। সেটা পরিণতি পেয়েছে ছাত্রদের আন্দোলন এবং আত্মত্যাগের মধ্যদিয়ে। আপনারা মনে করেছিলেন বিএনপির চেয়ারপার্সন জেলে তো, এটা বিএনপির কথা। ভাবেননি কথাটি আমার ছিল না। কথাটি দেশবাসীর ছিল। কথাটি বুঝতে ১৭ বছর সময় গেছে বলেই এতে প্রাণ গেছে, রক্ত ঝরেছে। অপকর্ম করলে কি পরিণতি হয়, সেই উপলব্ধি যদি না করতে পারি, তাহলে আমাদের পরিণতি আরও করুণ হবে। সেই বুঝে যদি শিক্ষা গ্রহণ করি, তাহলে এই পরিবর্তন অর্থবহ হবে। হোটেল জাবিরে অগ্নিকাণ্ড ও প্রাণহানির ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে অনিন্দ্য ইসলাম অমিত বলেন, হতাহতদের উদ্ধারে আমরা তৎপর ছিলাম। আহতদের হাসপাতালে চিকিৎসা নিশ্চিত করেছি।
বর্তমান বাস্তবতা তুলে ধরে অনিন্দ্য ইসলাম অমিত বলেন, গত ১৭ বছরের অভিজ্ঞতায় প্রশাসনের প্রতি ইতিবাচক মন্তব্য করার কোন কারণ নেই। এখন লোম বাছতে গেলে কম্বল উজাড় হয়ে যাবে, রাষ্ট্র চলবে না। এখন আমাদেরকে উদার হতে হবে। যার যত বেশি তিক্ত অভিজ্ঞতা, তাকে তত বেশি উদার হতে হবে। এটাই হলো বাস্তবতা। সরকার পতনের পর থেকে আমরা জেলা প্রশাসন ও পুলিশ সুপারের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছি। উনার যেখানে সমস্যার কথা বলেছেন, আমরা সহযোগিতা করেছি। আবার উনাদের কাছ থেকেও কাক্সিক্ষত সহযোগিতা পেয়েছি। যশোরের জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার মহোদয় অন্য জেলার তুলনায় ব্যতিক্রম লক্ষ্য করেছি। তারা ব্যতিক্রম ছিলেন বলেই তো যশোর শান্ত ছিল। ছাত্ররা সহনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন।
সেনাবাহিনীর ১৪ বীর অধিনায়ক ও যশোরের দায়িত্বপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্ণেল মোস্তফা বলেন, পুলিশ আজ থেকে তাদের কাজ শুরু করবে। এজন্য সব রাজনৈতিক দলের সহযোগিতা প্রয়োজন। পুলিশ কাজ শুরু করলে আইনশৃংখলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। আইনশৃংখলা রক্ষায় ছাত্র সমাজ, জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের সমন্বয়ে প্রত্যেক উপজেলায় কমিটি গঠন করা যেতে পারে। কমিউনিটি পুলিশিং টহল দিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, সহিংসতা নিয়ে যেন গুজব না ছড়ায়, এদিকে সজাগ থাকতে হবে। কেশবপুবের সেনা ক্যাম্প করা হয়েছে। মণিরামপুর ও কেশবপুর উপজেলার দায়িত্ব পালন করবে এই ক্যাম্প। নওয়াপাড়ার ক্যাম্প অভয়নগর উপজেলার দায়িত্ব পালন করবে। আর সেনানিবাসের ক্যাম্প থেকে চৌগাছা, ঝিকরগাছা ও শার্শা উপজেলার আইনশৃংখলা রক্ষায় কাজ করা হবে। কোন সহিংসতার ঘটনা কিংবা আশঙ্কা থাকলে ক্যাম্প কিংবা কন্ট্রোল সেলে অবহিত করতে হবে।
পুলিশ সুপার মাসুদ আলম বলেন, আমাদের কৃতকর্মের ফল আমরা পেয়েছি। সমাজের অংশীজনের কাছে আমাদের আস্থা নেই। কিন্তু বাস্তবতা হলো পুলিশ ছাড়া সমাজের শৃংখলা আনা সম্ভব নয়। আমরা বিশ্বাস করি বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যদিয়ে যে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি, সেখানে পুলিশ জনগনের আস্থা অর্জন করবে। পুলিশের কোন সদস্য যদি অতিউৎসাহী হয়ে কোন অপরাধ করে থাকে, তালিকা দিলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি উল্লেখ করেন, পুলিশের সকল সদস্যই খারাপ নয়। সবাই নিজেকে রাজনীতির স্বার্থে ব্যবহার হননি। কেউ ক্ষমতার অপব্যবহার করলে শাস্তি পাবেন। আমরা ন্যায় ভিত্তিক পুলিশ পরিচালনা করবে চাই। এজন্য আপনাদের সহযোগিতা চাই।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবরাউল হাছান মজুমদার বলেন, জেলার শান্তি শৃংখলা রক্ষায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং করা হবে। মসজিদের মাইকে সহিংসতা এড়াতে মানুষকে সচেতন করতে বলা হবে। একই সাথে শুক্রবার মসজিদে মসজিদে সচেতনতার বার্তা দেয়া হবে। ইতোমধ্যে প্রত্যেক উপজেলা প্রশাসন স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন শান্তিশৃংখলা রক্ষায় করণীয় বিষয়ে। বৃহস্পতিবার যশোর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে প্রশাসন ও সকল রাজনৈতিক দলের নেতাকমীদের অংশগ্রহণে সম্প্রীতি শোভাযাত্রা বের করা হবে।
সভায় আরও বক্তব্য রাখেন জেলা বিএনপির সদস্য সচিব অ্যাড. সাবেরুল হক সাবু, যুগ্ম সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন খোকন, বিএনপি সিনিয়র নেতা ও আইনজীবী মোহাম্মদ ইসহক, জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি আবু মোর্ত্তজা ছোট, জামায়াত ইসলামীর কেন্দ্রীয় সদস্য মাওলানা আজিজুর রহমান, বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ যশোরের সম্পাদক তসলিম-উর রহমান, গণতান্ত্রিক বাম জোট যশোরের নেতা জিল্লুর রহমান ভিটু, জেলা জামায়াত ইসলামীর শূরা সদস্য অ্যাড. গাজী এনামুল হক, প্রেসক্লাব যশোরের সভাপতি জাহিদ হাসান টুকুন, সিপিবি নেতা মাহাবুবুর রহমান মজনু, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) যশোরের সিনিয়র সহসভাপতি ফকির শওকত, জেলা জাতীয় পার্টির সদস্য সচিব মুফতি ফিরোজ শাহ্, হেফাজত ইসলামীর নেতা মো. নাসিরুল্লাহ, সাংবাদিক শিকদার খালিদ, সরোয়ার হোসেন, জুয়েল মৃধা, মনিরুল ইসলাম, বিএম ফারুক, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন যশোরের সমন্বয়ক রাশেদ খান, মারুফ হোসেন, ফাহিম আল ফাত্তাহ প্রমুখ।