বাংলার ভোর ডেস্ক
বৈশ্বিক বাস্তবতা আর নানামুখি চাপের মধ্যে দাঁড়িয়েও টেকসই উন্নয়ন এবং স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে যাত্রার চ্যালেঞ্জ নিয়ে নতুন অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট জাতীয় সংসদের সামনে উপস্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। প্রস্তাবিত এই ব্যয় বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের (৭ লাখ ১৪ হাজার ৪১৮ কোটি টাকা) চেয়ে ১১.৫৬ শতাংশ বেশি। টাকার ওই অংক বাংলাদেশের মোট জিডিপির ১৪.২৪ শতাংশের সমান। বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গত সরকারের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের দেওয়া বাজেটের আকার ছিল ২০২২-২৩ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটের ১৫.৩৩ শতাংশ বেশি এবং জিডিপির ১৫.২১ শতাংশের সমান।
বৃহস্পতিবার বিকালে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের এই বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেন মাহমুদ আলী। তার আগে মন্ত্রিসভার অনুমোদনের পর ওই প্রস্তাবে সই করেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল বিজয়ে টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম এ বাজেট অর্থমন্ত্রী হিসেবে মাহমুদ আলীর জন্যও প্রথম। আর এই দায়িত্ব সামলাতে গিয়ে চাপে থাকা অর্থনীতির উদ্বেগ জাগানো সূচকগুলো মাথায় রেখে সরকারের নির্বাচনি ইশতেহার বাস্তবায়নের অংক মেলাতে হয়েছে তাকে।
গতবছর বাজেট দিতে গিয়ে ‘স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে’ যাত্রার সংকল্প করেছিলেন অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামালকে। তবে ইউক্রেইন যুদ্ধের ধাক্কায় বদলে যাওয়া বিশ্ব বাজার, ডলার সঙ্কট আর মূল্যস্ফীতি সেই যাত্রাকে কঠিন করে তুলেছে।
পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার দুই বছর আগে যে কৃচ্ছ্রের পথে হাঁটতে শুরু করেছিল, সেই অবস্থান বদলে সাহসী হওয়ার সুযোগ ঘটেনি নতুন অর্থমন্ত্রী মাহমুদ আলীর জন্য। তার মধ্যেই বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডারে স্বস্তি আনার চেষ্টায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ঋণ নিতে গিয়ে আর্থিক খাতের নানামুখি সংস্কারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে হচ্ছে।
স্মার্ট বাংলাদেশে পৌঁছানোর নির্বাচনি স্লোগানটি আওয়ামী লীগ সরকারের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতিতে অটুট আছে। তবে অর্থমন্ত্রী মাহমুদ আলী তার বাজেটে অর্থনীতিকে পথে ফেরানোর ওপরই গুরুত্ব দিচ্ছেন। তার এবারের বাজেটের শিরোনাম: টেকসই উন্নয়নের পরিক্রমায় স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্নযাত্রা’।
বাজেট বক্তৃতায় তিনি বলেন, “স্মার্ট বাংলাদেশ: উন্নয়ন দৃশ্যমান, বাড়বে এবার কর্মসংস্থান- এ দর্শনকে কেন্দ্র করে ২০২৪ সালে পঞ্চমবারের মত মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেছে। আমাদের সরকারের বিগত মেয়াদসমূহে ডিজিটাল বাংলাদেশের যে শক্ত ভিত রচিত হয়েছে- তার উপর নির্ভর করে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য স্মার্ট, সমৃদ্ধ একটি দেশ গড়া এখন আমাদের প্রধান লক্ষ্য।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে ১১টি বিষয়ে বিশেষ অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, “বাজেট প্রণয়নের সময় আমরা এ বিষয়গুলো বিশেষ বিবেচনায় নিয়েছি।”
২০৪১ সালে বাংলাদেশকে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশের কাতারে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য ঠিক করা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের বাজেটগুলোতে উন্নয়ন খাত বরাবরই বেশি গুরুত্ব পেয়ে আসছিল। কিন্তু ২০২০ সালে মহামারীর ধাক্কায় সেই ধারায় কিছুটা ছেদ পড়ে। মুস্তফা কামাল তারপরও বাজেটের আকার বাড়িয়ে পরিকল্পনা সাজানোর পুরনো ধারায় যতি দেননি গত অর্থবছর পর্যন্ত। কিন্তু মাহমুদ আলীকে কিছুটা সংযত হতে হচ্ছে। ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেটে এবার উন্নয়ন ব্যয় ৮.২৫ শতাংশ বাড়িয়ে ধরা হয়েছে ২ লাখ ৮১ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ২ লাখ ৬৫ হাজার টাকা, যা ইতোমধ্যে অনুমোদন করা হয়েছে। এবার পরিচালন ব্যয় (ঋণ, অগ্রিম ও দেনা পরিশোধ, খাদ্য হিসাব ও কাঠামোগত সমন্বয় বাদে) ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৬ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা, যা বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত অনুন্নয়ন বাজেটের চেয়ে প্রায় ১১.৮৬ শতাংশ বেশি।
এর মধ্যে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা যাবে সরকারের দেশি-বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধে, যা মোট অনুন্নয়ন ব্যয়ের ২২.৩৯ শতাংশ। অনুন্নয়ন ব্যয়ের আরও প্রায় ১৬ শতাংশ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধে ব্যয় হয়ে, যার পরিমাণ অন্তত ৮১ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা। মহামারীর ধাক্কা সামলে ২০২১ সালে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল হতে শুরু করলে বেড়ে যায় আমদানি। তাতে সরকারের জমানো ডলারের ওপর চাপ তৈরি হয়। রপ্তানি বাড়লেও আমদানির মত অতটা না বাড়ায় এবং রেমিটেন্সের গতি ধীর হয়ে আসায় উদ্বেগ বাড়তে থাকে। এর মধ্যে ২০২২ সালে ইউক্রেইনে যুদ্ধ শুরু হলে বিশ্বজুড়ে খাদ্য আর জ্বালানির দাম বাড়তে শুরু করে। মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকায় ডলার বাঁচাতে সরকার বিলাস পণ্য আমদানিতে লাগাম দেওয়ার পাশাপাশি কৃচ্ছ্রের পথে হাঁটতে শুরু করে। তাতেও কাজ না হওয়ায় ডলারের যোগান বাড়াতে সরকারকে আইএমএফ এর কাছ থেকে ঋণ নিতে হয়েছে। সেই ঋণের শর্ত হিসেবে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর চাপ রয়েছে সরকারের ওপর।
রাজস্ব আহরণে এনবিআর বিদায়ী অর্থবছরের লক্ষ্যের চেয়ে পিছিয়ে থাকলেও অর্থমন্ত্রী আশা করছেন, নতুন অর্থবছরের সম্ভাব্য ব্যয়ের প্রায় ৬৮ শতাংশ তিনি রাজস্ব খাত থেকে পাবেন। তার প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব খাতে আয় ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। এই অংক বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত রাজস্ব আয়ের ১৩.১৮ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে কর হিসেবে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা আদায় করা যাবে বলে আশা করছেন মাহমুদ আলী। ফলে এনবিআরের কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ছে ১৭ শতাংশের বেশি। টাকার ওই অংক মোট বাজেটের ৬০ শতাংশের মত।
গতবারের মত এবারও সবচেয়ে বেশি কর আদায়ের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট থেকে, ১ লাখ ৮২ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা। এই অংক বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১৫.৬৩ শতাংশ। বিদায়ী অর্থবছরের বাজেটে ভ্যাট থেকে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরা ছিল ১ লাখ ৬৩ হাজার ৮৩৭ কোটি টাকা। সংশোধনে তা বাড়িয়ে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৬৬ কোটি টাকা করা হয়। আয়কর ও মুনাফার উপর কর থেকে ১ লাখ ৭৫ হাজার ৬২০ কোটি টাকা রাজস্ব পাওয়ার আশা করা হয়েছে এবারের বাজেটে। বিদায়ী সংশোধিত বাজেটে এর পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা। নতুন বাজেটে আমদানি শুল্ক থেকে ৪৯ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা, সম্পূরক শুল্ক থেকে ৬৪ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা, রপ্তানি শুল্ক থেকে ৭০ কোটি টাকা, আবগারি শুল্ক থেকে ৫ হাজার ৮০৫ কোটি টাকা এবং অন্যান্য কর ও শুল্ক থেকে ১ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা আদায়ের পরিকল্পনা করেছেন অর্থমন্ত্রী। এছাড়া বিদেশি অনুদান থেকে ৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকা পাওয়া যাবে বলে বাজেট প্রস্তাবে তিনি আশা প্রকাশ করেছেন।
বিদায়ী অর্থবছরের মূল বাজেটে মোট রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ৫ লাখ কোটি টাকা, সংশোধনে তা সামান্য কমিয়ে ৪ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা করা হয়, যদিও মার্চ পর্যন্ত সময়ে লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৭০ শতাংশ অর্জিত হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় বলেন, “আমাদের কর-জিডিপি অনুপাত অপেক্ষাকৃত কম। এ অনুপাত ৮ শতাংশের নিচে রয়েছে। মধ্যমেয়াদে সরকারের ব্যয় সক্ষমতা বৃদ্ধি ও উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহ পূরণ করার জন্য কর-জিডিপি অনুপাত ১০ শতাংশে উন্নীত করা জরুরি। ২০২২-২৩ অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার ছিল ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। সংশোধনে তা ৭ লাখ ১৪ হাজার ৪১৮ কোটি টাকায় নেমে এসেছে।
নতুন অর্থবছরের জন্য অর্থমন্ত্রী যে বাজেট প্রস্তাব সংসদের সামনে তুলে ধরেছেন, তাতে আয় ও ব্যয়ের সামগ্রিক ঘাটতি থাকছে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা, যা মোট জিডিপির ৪.৬ শতাংশের সমান। সাধারণত ঘাটতির পরিমাণ ৫ শতাংশের মধ্যে রেখে বাজেট প্রণয়নের চেষ্টা হয়। তবে টাকা যোগানোর চাপ থাকায় ২০১৩-১৪ অর্থবছরের পর থেকে প্রতিবারই ঘাটতি ৪ দশমিক ৯ শতাংশের বেশি ছিল। বিদায়ী অর্থবছরও এর পরিমাণ ছিল ৫.২ শতাংশ। এবার সেই ধারায় যতি টানলেন মাহমুদ আলী। বরাবরের মতই বাজেট ঘাটতি পূরণে অর্থমন্ত্রীকে নির্ভর করতে হবে অভ্যন্তরীণ এবং বিদেশি ঋণের ওপর। তিনি আশা করছেন, বিদেশ থেকে ১ লাখ ২৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৬০ হাজার ৯০০ কোটি টাকা ঋণ করে ওই ঘাটতি তিনি মেটাবেন। অভ্যন্তরীণ খাতের মধ্যে ব্যাংকিং খাত থেকে রেকর্ড ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, সঞ্চয়পত্র থেকে ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা এবং অন্যান্য খাত থেকে আরও ৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ধরা হয়েছে বাজেটে।
বিদায়ী অর্থবছরের বাজেটে ৭.৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ঠিক করেছিলেন অর্থমন্ত্রী। ৬ মাসের প্রাক্কলনের ভিত্তিতে অর্থবছর শেষে তা ৫.৮ শতাংশ হবে বলে সরকার ধারণা করছে। আর মে মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯.৮৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অর্থমন্ত্রী আশা করছেন, তার নতুন বাজেট বাস্তবায়ন করতে পারলে মূল্যস্ফীতি ৬.৫ শতাংশের মধ্যে আটকে রেখেই ৬.৭৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি পাওয়া সম্ভব হবে।