বাংলার ভোর ডেস্ক
উপজেলা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়ে গেছে। তবে নির্বাচন নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনও সিদ্ধান্ত জানাতে পারছে না বিএনপি। দলটি উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেবে কি না- এ প্রশ্নের উত্তরে স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য ‘না’ জবাব দিয়েছেন। তবে এই সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিকভাবে কবে ঘোষণা করা হবে- জানতে চাইলে উত্তর এড়িয়েই যাচ্ছেন তারা। শেখ হাসিনার অধীনে কোনও নির্বাচনে অংশ না নেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত থাকলেও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দলের বেশিরভাগ নেতা, বিশেষ করে তৃণমূল নেতাকর্মীরা স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচনে অংশ নেয়ার পক্ষে। নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য কেন্দ্রে চাপও দিচ্ছেন তারা। তবে উপজেলা নির্বাচনে দলের কেউ অংশ নিলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য। দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচনে অংশ নিলেও কৌশলগত কারণে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা নমনীয় থাকতে পারে দলটি- এমন গুব্জন থাকলেও নেতারা বলছেন, দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গেলেই ‘ডাইরেক্ট একশন’।
উপজেলা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়ে গেছে, বিএনপি কি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে- এমন প্রশ্নে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আব্দুল মঈন খান সকাল সন্ধাকে বলেন, ‘‘শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে না যাওয়া আমাদের নীতিগত সিদ্ধান্ত। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আমরা বর্জন করেছি। আমাদের আন্দোলনের ধারা এখন ভিন্ন। জনগণকে নিয়ে আমরা যুগান্তকারী আন্দোলনে নেমেছি। এমন অবস্থায় এই সরকারের অধীনে কোনও ধরনের নির্বাচনে যাওয়ার সুযোগ নেই। উপজেলা নির্বাচনেও অংশ নেওয়ার কোনও ভাবনা নেই আমাদের।’’ একই প্রশ্নের জবাবে স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এটার একটাই জবাব। সেটি হলো- না। যেহেতু আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এখনও দেওয়া হয়নি। তাই সরাসরি বলতে পারছি না। শিগগিরই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হবে জানিয়ে এই নেতা আরও বলেন, যারা সিদ্ধান্ত অগ্রাহ্য করবে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য কঠোর নির্দেশনা রয়েছে হাইকমান্ডের। সেখানে কোনও ছাড় নয়। হাইকমান্ডের এই কঠোর নির্দেশনার বিষয়ে নেতাকর্মীদের স্পষ্টত জানিয়ে দিয়ে সচেতন করা হবে বলে জানিয়েছেন দলটির জেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি বলেন, আমাদের একটাই মতামত।
নো ইলেকশন আন্ডার দিজ সার্কামস্ট্যান্সেস। আর দলের যারা এই সিদ্ধান্তের বাইরে যাবে তাদের বিরুদ্ধে ডাইরেক্ট একশন নেওয়ার নির্দেশ আছে হাইকমান্ড থেকে। আনুষ্ঠানিক ঘোষণা তাহলে কবে- এ প্রশ্নে রুহুল কবির রিজভী প্রথমে কিছুটা বিরক্ত হলেও পরে জবাব দেন । তিনি বলেন, “আরেহ এ এক জ্বালা, বড়ই জ্বালা। শিগগিরই ঘোষণা হবে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। বিএনপির বর্জন ও আন্দোলনের মধ্যে গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় পায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। গত বছরের ২৮ অক্টবরের মহাসমাবেশের পরে থেকে জোরালো কর্মসূচি নিয়ে এখনও মাঠে নামতে পারেনি।
এমন প্রেক্ষাপটে দলটির তৃণমূল নেতাকর্মী উপজেলা পরিষদ নির্বাচনকে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ বলে মনে করছেন। তারা মনে করেন, নির্বাচনে গেলে বিএনপির রাজনীতিতে চাঙ্গাভাব ফিরে আসবে। এলাকায় তাদের কদর বাড়বে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক তৃণমূল নেতা বলেন, কারচুপি হলেও নির্বাচন সবসময় উৎসবের আবহ তৈরি করে।
মহাসমাবেশের পরে আমাদের বেশিরভাগ নেতাই আত্মগোপনে আছে। নির্বাচনে দল পাশে থাকলে এলাকায় তাদের অবস্থা ফিরবে। তারা কদর পাবে। দল করে এই লুকায়িত, পরাজিত জীবন আর ভালো লাগে না।
তবে এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়াকে সরকার পতনের আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ চাবিকাঠি হিসেবে দেখছে বিএনপি। তাদের মতে, সংসদ নির্বাচন বর্জনে সেই আন্দোলনের গোড়াপত্তন শুরু। এখন উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিয়ে আন্দোলন থেকে সরতে চান না কোনোভাবেই।
দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য জমির উদ্দিন সরকার বলেন, নির্বাচনে অংশ নেয়া মানেই সরকারের কাছে সারান্ডার করা। তাই তৃণমূলের যতই প্রেশার থাকুক, নির্বাচনে না যাওয়ার যে সিদ্ধান্ত রয়েছে সেটিতেই আমরা এখনও অটল। রোজার মাসে নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করতে বিএনপি পাঁচশ ইফতার অনুষ্ঠান আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানান জমির উদ্দিন। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে শুরুও হয়ে গিয়েছে। এরমধ্যে নির্বাচনের বেড়াজালে আবারও মামলা-হামলায় নেতাকর্মীরা হাঁপিয়ে উঠবে।
তবে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১২ দলীয় জোট চায় বিএনপি কৌশলে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিক। গত ৩ মার্চ জোটের নেতারা বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে গুলশানে দেখা করেন। সেখানে জোটের নেতারা মহাসচিবকে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পরামর্শ দেন। ১২ দলীয় জোটের এক নেতা নাম প্রকাশ না করে বলেন, মহাসচিব ‘হ্যাঁ’ কিংবা ‘না’ কিছুই বলেননি। তিনি বলেন, জোটের নেতার মনে করেন, বিএনপি যদি শেষ পর্যন্ত দলগতভাবে নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয়, সেক্ষেত্রেও নির্বাচন প্রক্রিয়াটি দলের সবার জন্য বিশেষ করে যারা প্রার্থী হতে ইচ্ছুক, তাদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া উচিত। যাতে নির্বাচনে কেউ অংশগ্রহণ করলে তার বিরুদ্ধে কোনও সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হয়।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, বিএনপি এখনও একটি বড় রাজনৈতিক দল। ধার করে চলা দল না। এমন দশা বিএনপির এখনও হয়নি যে উপজেলা নির্বাচনে গিয়ে দলকে সুসংগঠিত কিংবা উজ্জীবিত করতে হবে।
২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনের পরও স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে প্রথম দিকে অংশ নিয়েছিল বিএনপি। পরে উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সরকারের নগ্ন হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলে নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। এর ধারাবাহিকতায় সব সিটি করপোরেশন নির্বাচনও বর্জন করে তারা।
দলটি ২০২১ সালের মার্চের পর থেকে সরকারের অধীনে কোনও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেনি। বরং দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় তৃণমূলের অনেক নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করে বিএনপি।
আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ ১০ দফা দাবি আদায়ে ২০২২ সালে রাজপথে নামে বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো। সেবছর বিএনপি নেতা তৈমূর আলম খন্দকার ও মনিরুল হক সাক্কু নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে দল থেকে তাদের বহিস্কার করা হয়। এছাড়া উপজেলা, পৌরসভা ও ইউপি নির্বাচনেও কিছু নেতা নির্বাচন করেন যাদের পরে দল থেকে বহিষ্কার করে বিএনপি।
নির্বাচন কমিশনের তফসিল অনুযায়ী ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন ১৫ এপ্রিল, ভোটগ্রহণ ৮ মে। দেশের ৪৯৫টি উপজেলার মধ্যে প্রথম ধাপে ১৫২টি, দ্বিতীয় ধাপে ১৬৫টি, তৃতীয় ধাপে ১১১টি ও চতুর্থ ধাপে ৫২টি; মোট ৪৮০টি উপজেলায় ভোট করার কথা রয়েছে। এবারের উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ।