♦ একই প্রতিষ্ঠানে বারবার প্রকল্প
♦ ৩০-৪০ শতাংশ হারে ঘুষ আদায়
♦সরকারি বরাদ্দের টাকা নয়ছয়
♦ প্রকল্পফলকে সরোয়ারের নাম
প্রতীক চৌধুরী
যশোর জিলা পরিষদের অফিস সহায়ক সরোয়ার উদ্দিনের গ্রামে প্রকল্পের ছড়াছড়ি। একই প্রতিষ্ঠানে বারবার বরাদ্দ, মোটা অংকের ঘুষ আদায় ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে ওই অফিস সহায়কের বিরুদ্ধে। নিজেকে এলাকায় ‘দানবীর’ হিসেবে তুলে ধরতে জিলা পরিষদের প্রকল্পের ফলকে বসিয়ে দিয়েছেন নিজের নাম। এলাকায় প্রচার করেছেন তিনিই বরাদ্দ দিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। শুধু নিজের গ্রাম নয়, জিলা পরিষদেও রয়েছে তার দাপট। অফিস সহায়ক পদে কর্মরত থাকলেও ছড়ি ঘোরান উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ওপরেও। তাই বড় কর্তাদের অনেকেই তাকে সমীহ করে চলেন। জনপ্রতিনিধি ও কতিপয় কর্তার ছত্রছায়ায় বেপরোয়া এই সরোয়ার উদ্দিন। তার বিরুদ্ধে জেলা পরিষদের গাছ চুরির অভিযোগও রয়েছে।
সরেজমিনে যশোরের চৌগাছা উপজেলার স্বরুপদাহ গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, হাফেজিয়া মাদরাসা, ঈদগাঁ, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও রাস্তার উন্নয়নে অসংখ্য প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে জিলা পরিষদ। ২০১৬-২০১৭ অর্থ বছর থেকে ২০২৩-২০২৪ অর্থ বছর পর্যন্ত স্বরুপদাহ গ্রামে প্রায় ৫০ লাখ টাকার প্রকল্প বরাদ্দ দিয়েছে জিলা পরিষদ। প্রত্যেকটি উন্নয়ন প্রকল্পের নামফলকে নিজের নাম লিখেছেন জিলা পরিষদের অফিস সহায়ক সরোয়ার উদ্দিন। জিলা পরিষদের টাকায় তিনি এলাকায় ‘দানবীর’ হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন। গত ৮ বছরে স্বরুপদাহ গ্রামে কত টাকার মোট প্রকল্প বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, সেই তথ্য জিলা পরিষদ দিতে পারেনি। তবে অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে স্বরুপদাহ সরদারপাড়া ঈদগাহ ময়দান উন্নয়নে এক লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে জিলা পরিষদ। ২০২০-২০১ অর্থবছরে স্বরুপদাহ গ্রামের শাহ আলমের বাড়ি থেকে তরিকুল সরদারের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা সলিংকরণে তিন লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। এই রাস্তা নির্মাণের সময় জোরপূর্বক রাস্তা ঘুরিয়ে পাশের জমির ভিতরে ঢুকিয়ে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। রাস্তার নামফলক স্থাপন করা হয়েছে শাহ আলমের বাড়ির উঠানে। এই শাহ আলমের সঙ্গে সরোয়ার উদ্দিনের গভীর সখ্যতা রয়েছে। এজন্য তাকে সুবিধা দিতেই ক্ষমতার অপব্যহার করেছেন সরোয়ার উদ্দিন।
২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে স্বরুপদাহ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শহিদ মিনার নির্মাণে তিন লাখ টাকা বরাদ্দ, ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে স্বরুপদাহ হাফেজিয়া মাদরাসায় তিন লাখ টাকা, ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরে স্বরুপদাহ হাফেজিয়া মাদরাসায় ১০ লাখ টাকা, ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে স্বরুপদাহ হাফেজিয়া মাদরাসায় ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থ বছরে স্বরুপদাহ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে তিন লাখ টাকা, ২০২১-২২ অর্থ বছরে স্বরুপদাহ পূর্বপাড়া ঈদগাহে তিন লাখ টাকা, ২০২১-২২ অর্থ বছরে স্বরুপদাহ সরদারপাড়া ঈদগাহে তিন লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে স্বরুপদাহ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার নির্মাণে ফের তিন লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে এই বরাদ্দের টাকায় কাজ না করে শিক্ষকদের ৩ হাজার টাকা করে ঈদের বোনাস, শিক্ষার্থীদের বেতন সমন্বয় ও শিক্ষার্থীদের পিকনিকের ব্যবস্থা করেন সরোয়ার উদ্দিন। তিনি এই বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য ছিলেন। পরবর্তীতে অ্যাডহক কমিটির সভাপতি হওয়ার জন্য জিলা পরিষদের টাকা অপব্যবহার করেন। যদিও তথ্য গোপন করে সভাপতি হওয়ায় পরে যশোর শিক্ষাবোর্ড তাকে অব্যাহতি দেয়। নিয়ম অনুযায়ী একই প্রতিষ্ঠানে পরপর দুই অর্থবছরে প্রকল্প বরাদ্দ দেয়ার নিয়ম নেই। কিন্তু সেটি মানা হয়নি স্বরুপদাহ গ্রামের একাধিক প্রতিষ্ঠানে বরাদ্দের ক্ষেত্রে। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে জিলা পরিষদের মালিকানাধীন গাছ কেটে আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে চৌগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার তদন্তে সত্যতাও মিলেছে। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
স্বরুপদাহ গ্রামের বাসিন্দা সানোয়ার হোসেন বকুল বলেন, সরোয়ার উদ্দিন ক্ষমতার অপব্যবহার করে জিলা পরিষদের টাকা তছরুপ করেছে। প্রত্যেক প্রকল্পের বরাদ্দের জন্য ৩০-৪০ শতাংশ হারে ঘুষ আদায় করেছে। প্রত্যেকটি প্রকল্প ফলকে সরোয়ার উদ্দিনের নাম লেখা হয়েছে। জিলা পরিষদের একজন পিয়নের ক্ষমতার উৎস কোথায়? আর নাম ফলকে কিভাবে তার নাম লেখা হলো। এই বিষয়টি তদন্ত করে দেখা দরকার।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক গ্রামবাসী বলেন, সরোয়ার একজন পিয়ন হলেও তিনি দাপট দেখান কর্মকর্তার। তার বিশাল ক্ষমতা, সেটা প্রমাণ করার জন্যই এসব প্রকল্প নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছেন। তার মাধ্যমে সরকারি টাকা লুটপাট হয়েছে। জিলা পরিষদের উচিত বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেয়া।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন জিলা পরিষদের অফিস সহায়ক সরোয়ার উদ্দিন। তার দাবি, প্রকল্প বাস্তবায়নে কোন অনিয়ম দুর্নীতি হয়নি। সুযোগ ছিল এলাকার মানুষের জন্য উন্নয়নমূলক কাজ করেছি। তবে প্রকল্পফলকে আমার নিজের নাম লেখা উচিত হয়নি।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জিলা পরিষদের সহকারী প্রকৌশলী মো. ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, জিলা পরিষদের উন্নয়ন প্রকল্পের নামফলকে সরোয়ার উদ্দিনের নাম লেখার কোন সুযোগ নেই। আর প্রকল্প বরাদ্দের সঙ্গেও তার কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। তারপরও কিভাবে প্রকল্পফলকে তার নাম লেখা হলো জানা নেই।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, স্বরুপদাহ গ্রামে জিলা পরিষদ কতটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে সেটি আমার জানা নেই। নথিপত্র যাচাই করে দেখতে হবে।
এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি যশোর জিলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান।