স্বাধীন মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ
নতুন ভোরের এই আলো ছড়িয়ে পড়ুক সবখানে, সবপ্রাণে প্রতিপাদ্য স্লোগান নিয়ে যশোরে ১০ দিনব্যাপি লোকজ সংস্কৃতিক উৎসব ও বৈশাখী মেলা ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। তীব্র গরম উপেক্ষা করে প্রতিদিনই মেলার মাঠে মানুষের উপচেপড়া ভিড় ছিল। বিকেল থেকেই ভক্তদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে মেলা প্রাঙ্গণ। কর্মব্যস্ত মানুষ একটু মানসিক শান্তি ও স্বস্তির জন্য স্বপরিবারে টাউন হল মাঠে উপস্থিত হন। শিশু কিশোরদের জন্য মেলার মাঠে বিনোদনের কমতি ছিলো না। ছোট্ট বাচ্চাকে নিয়ে সমাবেত হয়েছেন অভিভাবকরাও। আজ শেষ হচ্ছে ১০ দিনের এই আয়োজন।
জেলা প্রশাসনের সহায়তায় ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট এবং যশোর ইন্সটিটিউটের উদ্যোগে এই মেলার আয়োজন করা হয়। টাউন হল রওশন আলী মঞ্চে বিকেল ৪ টা থেকে যশোরের স্বনামধন্য সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মোট ১৩০ টি সংগঠনের পরিবেশনা দর্শক স্রোতাদের মাঝে মুগ্ধতা ছড়িয়েছে। টানা ১০দিনের সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় ছিলো কবিগান, পটগান, সঙযাত্রা, লাঠি খেলা, সাপ খেলা, কবিতা, গান, নৃত্য, নাটকসহ নানান আয়োজন। প্রতিদিন বিকেল ৪ টা থেকে শিশুদের নিয়ে আয়োজন করা হয়েছে শিশুতোষ পরিবেশনা।
মেলায় প্রবেশ পথেই চোখে পড়েছে আধুনিক যশোরের রুপকার রায় বাহাদুর যদুনাথ মজুমদারকে স্মরণ দৃশ্য। মঞ্চ ও প্যাভিলিয়ন করে গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয়ে যশোরের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের পুরোধা ব্যক্তিত্বদেরকে। মঞ্চ করা হয়েছে, কবি আজীজুল হক চন্দ্রাতপ, অধ্যাপক মো. শরীফ হোসেন চন্দ্রাতপ, অধ্যাপক মো. ইয়াকুব চন্দ্রাতপ এর নামে। সেখানে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে তাদের ছবি সংযোজন করা হয়েছে। ছবি সংবলিত প্যাভিলিয়নে স্মরণ করা হয়েছে, আব্দুল হাসিব, ওস্তাদ মোশাররফ হোসেন, ডা. কাজী রবিউল হক, এ্যাড. কাজী আব্দুস শহীদ লাল, রুহুল হক খোকা, শাহ্ মোহাম্মদ মোর্শেদ, ইকরামুল হক চৌধুরি ফকো, অজিত গোস্বামী, প্রণব ঘোষ, মধুসূদন শাঁখারী, গোলক বিহারী বর্মণ, গৌর গোপাল হালদার, নিবাস মন্ডল, হায়দার আলী চৌধুরি সনু, ফরহাদ করিম আবু ইউসুফ মুরাদ, সেলিম হোসেন, আবু সালেহ তোতা, সুকুমার দাস, ডিএম শহিদুজ্জামানসহ ফখরে আলমদের মত গুণীজনদেরকে। ব্যতিক্রমী এই আয়োজনে নতুন প্রজন্মের মাঝে তুলে ধরা হয়েছে এই সব সুধী ও গুণীজনদের।
মেলার বিশেষ আকর্ষণ ছিলো শিশু বিনোদন। বিকেলে শিশুদের নিয়ে অভিভাবদের মেলার মাঠে হাজির হতে দেখা গেছে। ঢাকা ফেয়ার রাইড নামে একটা প্রতিষ্ঠান ৫০ টাকার বিনিময়ে শিশুদের বিনোদনের জন্য স্লিপার, ড্রাগন ট্রেন, নৌকা দোলনার আয়োজন করে। এখানে ৩০ টাকার বিনিময়ে নাগর দোলায় দোলার সুযোগও ছিলো। ভূতের বাড়ি নামে ভিন্ন একটা রাইড সকলের নজর কাঁড়ে।
যশোর ও যশোরের বাইরের মোট ৬০ টি প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন মেলায় স্টল নিয়ে বসে। তাদের মধ্যে জয়তী হেঁসেল, সুর নিকেতনের গুড়ের চা, চারুতীর্থ ক্রিয়েটিভ স্কুল, তানাজ হস্তশিল্প, স্পন্দন যশোর, বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার, ঝুমঝুমপুর সমাজ কল্যাণ সংস্থা, চাঁদনী এন্টারপ্রাইজের কাঁচের চুড়ি, শিউলি কুকিং এন্ড বেকিং হাউজ, মাহফুজা’স কেক জোন, ফেয়ার বিউটি সেলুন, ডাচ্ বাংলা ব্যাংক পিএলসি, জনি গোলা হাউজ, ভালোবাসার মৌসুমি চটপটি ফুসকা হাউজ উল্লেখ্যযোগ্য।
মেলার মাঠে হস্তশিল্পের পসরা সাজিয়ে বসা তানাজ হস্তশিল্পের মালিক সাবরিনা ইয়াসমিন বলেন, যশোরে এই প্রথম টাউন হল মাঠের এই মেলায় দোকান নিয়ে বসেছি। খুলনার ডুমুরিয়া থেকে এসেছি। যেমনটা আশা করেছিলাম তার চেয়ে ভালো বেঁচা বিক্রি হয়েছে।
কসমেটিক্সের দোকানি দীন মুহাম্মদ জানান, ছুটির দিন মেলায় একটু ভিড় বেশি হয়। যেমন আশা করেছিলাম তেমন বেঁচা বিক্রি হয়নি। তারপরও মোটামুটি ভালো ব্যবসা হয়েছে।
শিশুদের খেলনা বিক্রির দোকানি আমজাদ হোসেন বলেন, প্রথম কয়েকদিন বেচা বিক্রি কম ছিলো। তবে মেলা শুরুর দুই তিন দিন পর থেকে ক্রেতাদের ভালো সাড়া পেয়েছি।
ফিরোজ আহম্মেদ নামে এক কলেজ পড়ুয়া জানান, বন্ধু বান্ধবদের সাথে নিয়ে মেলার মাঠে এসেছি। আমাদের হারাতে বসা সাংস্কৃতিক যেমন কবিগান, গম্ভীরা এমন আনুষ্ঠানের সাথে পরিচয় হয়েছে। সব মিলিয়ে মেলায় এসে অনেক কিছু জানার সাথে সাথে আনন্দ উপভোগ করেছি।
মেলা দেখতে আসা সোহাগ হোসেন বলেন, শহরের প্রাণকেন্দ্রে এমন সুন্দর পরিবেশে মেলা দেখে ভালো লেগেছে। বিশেষ করে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলো উপভোগ করেছি। বিকেলে যখন সময় পেয়েছি স্ত্রী সন্তান নিয়ে টাউন হল মাঠে চলে এসেছি। শিশুদের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিবেশনা দেখে আমার সন্তান দারুণ আনন্দ করেছে। আমরা মনে করি সুষ্ঠু বিনোদনের এমন অয়োজন প্রতি বছর হওয়া দরকার।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট যশোরের সাধারণ সম্পাদক ও লোকজ সংস্কৃতিক উৎসব ও বৈশাখী মেলা উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব সানোয়ার আলম খান দুলু বলেন, আমরা দীর্ঘ তিন দশক পর লোকজ সংস্কৃতিক উৎসব ও বৈশাখী মেলার আয়োজন করতে পেরে খুশি। আমরা মনে করে পুরোপুরি সফল না হলেও আমরা পুরোপুরি সফল। আমরা চেষ্টা করেছি আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনা বোধ জাগ্রত করা, হাজার বছরের ঐতিহ্য নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। তীব্র গরমের ভিতরে সকল শ্রেণি পেশার মানুষের উপস্থিতি চোখে পড়ার মত ছিলো। আমরা আশা করি এই ধারা আগামীতেও অব্যাহত রাখতে পারবো।