♦ কোচিং সেন্টার তো আমাদের অনুমতি নিয়ে চালু হয় না। আমাদের হাতে কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না- অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি)
♦ ছোট রুমে মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি থাকে। স্কুলের ক্লাস রুমগুলো অপেক্ষাকৃত বড়। কোচিং এ অসুস্থ হওয়ার ভয়টা বেশি থাকে- সচেতন নাগরিক কমিটি যশোরের সভাপতি
স্বাধীন মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ
সকাল ৮টা। ঘুম থেকে উঠেই কোচিং এ যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে সাকিব। বেলা বাড়ার সাথে সাথে বাইরে প্রচন্ডণ্ড রোদ ও তাপ বাড়ে। তাই মা মনে করে ছেলের স্কুল ব্যাগে ছাতা আর এক বোতল ঠাণ্ডা পানি ভরে দিচ্ছেন। রিকসা চড়ে কোচিং এ যাওয়ার সময় রিকসার হুড নামিয়ে বসতে বলছেন বাবা। আরেক অভিভাবক জবেদ আলী প্রতিদিন ভরদুপুরে মোটরসাইকেল চড়ে মেয়েকে কোচিং সেন্টারের সামনে নামিয়ে দিয়ে আসছেন। তীব্র তাপপ্রবাহে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হলেও কোচিং সেন্টার বন্ধ হয়নি। কোচিংয়ে যাওয়া বন্ধ করলে সন্তান পিছিয়ে পড়তে পারে, এমন শংকায় অভিভাবকরাও নিষেধ করছেন না। তীব্র তাপপ্রবাহের মধ্যে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা ছুটছেন কোচিং সেন্টারে। এই চিত্র গোটা যশোর জেলার। রমরমা কোচিং সেন্টার চালু থাকলেও এ বিষয়ে কোন নজরদারি নেই প্রশাসনের।
সোমবার যশোর জেলায় ৪০ দশমিক ৬ ডিগ্রি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। এর আগে শনিবার যশোরে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়। এক সপ্তাহ ধরে জেলায় ৩৮ থেকে ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যেই তাপমাত্রা উঠানামা করছে। ফের সারাদেশে তিনদিনের হিট অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। এই অবস্থার মধ্যে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ৭ দিন বন্ধ ঘোষণা করেছে মন্ত্রণালয়। সেই ধারাবাহিকতায় যশোরের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। তবে, দেদারসে চলছে কোচিং সেন্টারগুলো। সেদিকে কারো কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সরকার শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করেছে। কিন্তু কোচিং সেন্টার বন্ধ না হওয়াতে বাধ্য হয়ে শিক্ষার্থীদের টানা রোদে ব্যাগ কাঁধে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়তে হচ্ছে। কোচিং সেন্টারগুলোর এমন খাম খেয়ালি আচরণে অভিভাবকসহ সচেতন নাগরিক সমাজের অনেকেই দ্বিমত পোষণ করেছেন। শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে সরকার তৎপর হলেও তা পুরোপুরি ভাবেই মুখ থুপড়ে পড়ছে।
সোমবার সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে যশোর শহরের প্রায় সব কোচিং সেন্টার খোলা। সকাল ৮ টা থেকে রাত অবধি এই সব কোচিং সেন্টারে ব্যাচ ভাগ করে ক্লাস নেয়া হয়। রোদে পুড়ে, ছাতা মাথায় দিয়ে দূর দূরন্ত থেকে শিক্ষার্থীরা কোচিং এ ক্লাস করতে আসছে। অনেক অভিভাবকরা তাদের সন্তানকে ক্লাস রুমে দিয়ে পড়া শেষ হওয়ার অপেক্ষায় বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। শহরের জজকোর্ট মোড়, পোস্ট অফিস মোড়, মুজিব সড়ক, এমএম কলেজের দক্ষিণ গেটসহ বেশ কিছু এলাকায় ছোট বড় অর্ধ শতাধিক কোচিং সেন্টার রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ইউনিক একাডেমি কেয়ার, (প্রাইমারি) প্যারাডাইস স্পেশাল ব্যাচ, মেধা বিকাশ কোচিং সেন্টার, দৃষ্টি ক্যাডেট কোচিং, ম্যাক্স, এক্সপার্ট, ডিফেন্স কেয়ার, অক্সিন নার্সিং ও ম্যাটস্ ভর্তি কোচিং, কনফিডেন্স বিসিএস, রাইজিং স্টার, থ্রী ডক্টর, আইরিশ নার্সিং, গণিত স্পেশাল কোচিং, মোমিনুর স ইংলিশ, সুব্রত স স্পেশাল ব্যাচ, রতন ক্যামেস্টি, আমিনুর স্পেশাল ইংলিশ, মামুন স গাইড লাইন, মাসুম স্পেশাল ব্যাচ, প্যারাগন বিশ^বিদ্যালয় কোচিং, প্রতিভা, রেটিনা, উদ্ভাস। এই সব কোচিং সেন্টারে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও বিসিএস, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং, নার্সিং ভর্তি সহায়ক কোর্স চালু রয়েছে। যেখানে শিশু থেকে শুরু করে কিশোর-কিশোরী, যুবক সকল বয়সের শিক্ষার্থীর আনাগোনা দেখা গেছে। তবে তীব্র গরম ও তাপদাহে বেশি বিপাকে পড়তে দেখা গেছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের।
তীব্র তাপদাহে সারাদেশে যখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ তখন যশোরে কোচিং সেন্টারগুলো দুর্বার গতিতে পাঠ কার্যক্রম চালানোর ফলে সন্তানের স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে প্রশ্নের জবাবে সৌমিত্র সেন নামে এক অভিভাবক বলেন, বাইরে প্রচণ্ড তাপ। কড়া রোদের ভিতরে ছাতা মাথায় দিয়ে বাচ্চাকে কোচিং এ এনেছি। যে রোদের তাপ তাতে বড় মানুষ টিকতে পারছে না। বাচ্চাটাকে নিয়ে বড় বিপদে আছি। এই গরমে কোচিং বন্ধ থাকলে বাচ্চাসহ নিজেও একটু স্বস্তি পেতাম।
নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক যশোর জিলা স্কুলের ৯ম শ্রেণীর এক শিক্ষার্থী বলেন, প্রতিদিন ৩ টায় কোচিং এ যাই। সোমবার সকাল ৮ টায় ক্লাস নিয়েছে। রোদে ৩ টার সময় যেতে কষ্ট হয়। স্কুল বন্ধ কিন্তু কোচিং খোলা। গরমে বাধ্য হয়ে বের হতে হয়েছে।
উজ্জ্বল কোচিং সেন্টারের দায়িত্বরত পরেশ নামে এক ব্যক্তি বলেন, আমাদের কোচিং সেন্টার নিয়মিত চলছে।
এক্সপার্ট কোচিং সেন্টারের পরিচালক দীন ইসলাম বলেন, আমরা এখনও পর্যন্ত কোনো নির্দেশনা পাইনি। সরকারি নির্দেশনা পেলে অবশ্যই আমরা কোচিং বন্ধ রাখব। সরকারি কোনো দফতর থেকে আমরা কোনো চিঠি বা বন্ধের নোটিশ পাইনি।
সচেতন নাগরিক কমিটি যশোরের সভাপতি শাহিন ইকবাল বলেন, গরমে যাতে শিক্ষার্থীরা অসুস্থ না হয়ে পড়ে সে জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করেছে সরকার। এই গরমে বাড়ি থেকে বের হয়ে গ্যাদারিংয়ে না যাওয়া ভালো সেটা কোচিং হোক বা বাজার হোক। কিন্তু এই কোচিংটা করে সেটা তো হয়েই যাচ্ছে। আর স্কুলে সাধারণত যেভাবে বসে তার থেকে অধিকাংশ কোচিংয়ে গ্যাদারিংটা বেশিই হয়। ছোট রুমে মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি থাকে। স্কুলের ক্লাস রুমগুলো অপেক্ষাকৃত বড়। কোচিং এ অসুস্থ হওয়ার ভয়টা বেশি থাকে। কোচিংটাও শুরু হয় অসময়ে। স্কুলটা সাধারণ শুরু হয় সকাল ৯টা থেকে। অধিকাংশ কোচিং সেন্টারগুলো শুরু করে তিনটার দিকে। যখন পুরোপুরি তাপমাত্রা থাকে। এ ব্যাপারে অভিভাবক আবার যারা কোচিং করাচ্ছে তাদেরও সচেতন হতে হবে। প্রয়োজনে সরকারের পদক্ষেপ নিতে হবে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় অনলাইনে ক্লাস শুরু করে দিয়েছে। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফরম ফিলাপের সময় বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশেষ প্রয়োজনে অনেক করতে হয়। প্রয়োজন হলে পরীক্ষার সময় পিছিয়ে দিতে হবে।
এ বিষয়ে মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মাহফুজুল হোসেন বলেন, কোচিং সেন্টারগুলো সরকারি না। সরকারি কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা থাকলে আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবো। তারপরও তীব্র তাপদাহে শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে আমরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ ব্যাপারে সচেতন হতে বলব।
জানতে চাইলে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মোছা. খালেদা খাতুন রেখা বলেন, কোচিং সেন্টার তো আমাদের অনুমতি নিয়ে চালু হয় না। আমাদের হাতে কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তাছাড়া আমাদের কাছে তেমন কোনো নির্দেশনা নাই, যেটা দিয়ে আমরা তাদের কার্যক্রম বন্ধ করবো। তারপরও বিষয়টি যেহেতু উঠেছে, আমরা দ্রুত ব্যবস্থা নেব।