♦ আমি তো সাক্ষী দিতে এসেছি, কিছুই জানি না : সিলিস্তি
♦ চিকিৎসা নয়, বন্ধুর ডাকে ব্যবসায়িক কাজে কলকাতা যান আনার
♦ ব্যসায়িক ক্ষোভের কথা জানতেন না আনার
বাংলার ভোর ডেস্ক
ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার সঙ্গে বন্ধু ও হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী আক্তারুজ্জামান শাহীনের ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল। ব্যবসায়িক লেনদেন ছাড়াও কিছু বিষয়ে আনারের ওপর ক্ষোভ ছিল শাহীনের। এছাড়া শিমুল ভূঁইয়া শিহাব ওরফে ফজল মোহাম্মদ ভূঁইয়া ওরফে আমানুল্লাহ সাইদের সঙ্গেও রাজনৈতিক মতাদর্শগত পার্থক্য ছিল আনারের। উভয়ই আনারকে কলকাতায় নিয়ে হত্যার পরিকল্পনা করেন।
পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্যবসায়িক বৈঠকের জন্য আনারকে কলকাতায় যেতে বলা হয়। গত ১২ মে আনার কলকাতায় যান এবং সেখানে তার এক বন্ধুর বাসায় ওঠেন। সেখান ১৩ মে সকালে ব্যবসায়িক বৈঠকের কথা বলে শাহীনের কলকাতার নিউটাউন এলাকার ভাড়া বাসায় যান তিনি। সেখানে ওইদিনই আমানুল্লাহ সাইদ, তানভীর, সিলিস্তি রহমানসহ অজ্ঞাতনামা আসামিদের সহযোগিতায় আনারকে হত্যা করা হয়। পরে মরদেহ গুম করতে হাড় থেকে মাংস আলাদা করা হয়।— মামলার রিমান্ড আবেদনে এ তথ্যই উল্লেখ করেছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার মাহফুজুর রহমান।
এ ঘটনায় গ্রেফতার সৈয়দ আমানুল্লাহ আমান ওরফে শিমুল ভূঁইয়া, ফয়সাল আলী সাজী ওরফে তানভীর ভূঁইয়া ও সিলিস্তি রহমানকে শুক্রবার ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করে পুলিশ। এসময় মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য তাদের দশদিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার মাহফুজুর রহমান।
রিমান্ড আবেদনে এসব কথা উল্লেখ করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট দিলরুবা আফরোজ তিথি তাদের আটদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
রিমান্ড শুনানির আগে আদালতের হাজতখানা থেকে তিনজনকে আদালতে হাজির করা হয়। এসময় কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সিলিস্তি রহমান বলেন, আমাকে এখানে কেন আনা হয়েছে জানতে চাই। আমাকে বলা হয়েছে সাক্ষী দিয়ে চলে যাবো। আমিতো সাক্ষী দিতে এসেছি। আমি কিছু জানি না। তবে অপর দুই আসামি কোনো কথা বলেনি। আসামিদের পক্ষে কোনো আইনজীবীও ছিল না।
খণ্ড-বিখণ্ড আনারের মরদেহ
শুনানি শেষে ঢাকা মহানগর আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর (এপিপি) আব্দুস সাত্তার দুলাল বলেন, আনারকে ব্যবসায়িক আলোচনা কথা বলে কৌশলে ভারতে নিয়ে যায় আসামিরা। সেখানে অভিযুক্ত শাহিন তাকে হত্যা করে। আজ আদালতে শাহীনসহ গ্রেফতার তিনজনের বিরুদ্ধে ১০দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হয়। আদালত শুনানি শেষে তাদের আটদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। বর্তমান অপহরণ মামলায় তাদের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। হত্যা প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করা হবে।
ফোনে ইন্দোনেশিয়ার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর চালু পাওয়া যায়
মামলার রিমান্ড আবেদনে তদন্ত কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, মামলার তদন্তভার গ্রহণ করে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় ও গুপ্তচরের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ২৩ মে আসামি শিমুল ও তানভীরকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে তাদের দেওয়া তথ্যমতে, একই দিন বেলা সাড়ে ১২টার দিকে রাজধানীর উত্তরা এলাকা হতে আসামি সিলিস্তি রহমানকে গ্রেফতার করা হয়।
গ্রেফতার আমানুল্লাহর কাছে দুটি পাসপোর্ট, একটি আইফোন পাওয়া যায়। এ ফোনটিতে ইন্দোনেশিয়ার দুটি নম্বরে হোয়াটসঅ্যাপ চালু পাওয়া যায়।
ব্যবসায়িক ক্ষোভের কথা জানতেন না এমপি আনার
মামলার রিমান্ড আবেদনে তদন্ত কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা জানিয়েছে, ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার সঙ্গে তার বন্ধু ও হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী আক্তারুজ্জামান শাহীনের ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল। ব্যবসায়িক লেনদেন ছাড়াও কিছু বিষয়ে আনারের ওপর ক্ষোভ ছিল শাহীনের, যা জানতেন না আনার। অন্যদিকে, শিমুল ভূঁইয়া শিহাব ওরফে ফজল মোহাম্মদ ভূঁইয়া ওরফে আমানুল্লাহ সাইদের সঙ্গেও রাজনৈতিক মতাদর্শগত পার্থক্য ছিল। উভয়ই আনারকে কলকাতায় নিয়ে হত্যার পরিকল্পনা করেন।
পরিকল্পনা অনুযায়ী শাহীন গ্রেফতারদের সঙ্গে নিয়ে ৩০ এপ্রিল কলকাতার নিউটাউন এলাকায় যান এবং সেখানে একটি বাসাভাড়া করে বসবাস করা শুরু করেন এবং ব্যবসায়িক বৈঠকের জন্য আনারকে কলকাতায় যেতে বলা হয়। এরপর ১০ মে বাংলাদেশে চলে আসেন শাহীন, যা ভিকটিম জানতেন না। আসার সময় গ্রেফতার আমানুল্লাহ সাইদকে দায়িত্ব দিয়ে আসেন তিনি। বলে আসেন কোনোভাবেই যেন কাজটা মিস না হয়, প্রমাণ যেন না থাকে।
গত ১২ মে আনার কলকাতায় যান এবং সেখানে তার এক বন্ধুর বাসায় ওঠেন। ১৩ মে সকালে ব্যবসায়িক বৈঠকের কথা বলে শাহীনের কলকাতার নিউটাউন এলাকার ভাড়া বাসায় যান। সেখানে ওইদিনই আমানুল্লাহ সাইদ, তানভীর, সিলিস্তি রহমানসহ অজ্ঞাতনামা আসামিদের সহযোগিতায় আনারকে হত্যা করা হয়। পরে মরদেহ গুম করতে হাড় থেকে মাংস আলাদা করা হয়। এ ঘটনায় কলকাতায় হত্যা মামলা রুজু হয়।— মামলার রিমান্ড আবেদনে এ তথ্যই উল্লেখ করেছেন তদন্ত কর্মকর্তা।
শিমুলের নামে রয়েছে ৩ হত্যা মামলা, তানভীরের দুটি অস্ত্র মামলা
রিমান্ড আবেদনে উল্লেখ করা হয়, সিডিএমএস ও রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা করে এক নম্বর আসামি শিমুল ভুইয়া ওরফে শিহাব ওরফে ফজল মোহাম্মদ ভুইয়া আমানুল্লাহ সাইদের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা পাওয়া গেছে। যশোর জেলার অভয়নগর থানায় দুইটি ও খুলনার ফুলতলা থানায় একটি হত্যা মামলা রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এছাড়াও দুই নম্বর আসামি তানভীর ভূইয়ার বিরুদ্ধে খুলনা জেলার ফুলতলা থানায় মাদক ও অবৈধ অস্ত্রের দুইটি মামলা রয়েছে। এর আগে বৃহস্পতিবার (২৩ মে) তাদের এমপি আনোয়ারুল অপহরণ মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়।
গত ১২ মে চিকিৎসার জন্য ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ থেকে চুয়াডাঙ্গার দর্শনার গেদে সীমান্ত দিয়ে ভারতে যান এমপি আনার। ওঠেন পশ্চিমবঙ্গে বরাহনগর থানার মণ্ডলপাড়া লেনে গোপাল বিশ্বাস নামে এক বন্ধুর বাড়িতে। পরদিন ডাক্তার দেখানোর কথা বলে বাড়ি থেকে বের হন। এরপর থেকেই রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ আনোয়ারুল আজীম।
বাড়ি থেকে বেরোনোর পাঁচদিন পরে, গত ১৮ মে বরাহনগর থানায় আনোয়ারুল আজীম নিখোঁজের বিষয়ে একটি জিডি করেন বন্ধু গোপাল বিশ্বাস। এরপরও খোঁজ মেলেনি তিনবারের এই সংসদ সদস্যের। বুধবার (২২ মে) হঠাৎ খবর ছড়ায়, কলকাতার পার্শ্ববর্তী নিউটাউন এলাকায় বহুতল সঞ্জীবা গার্ডেনস নামে একটি আবাসিক ভবনের বিইউ ৫৬ নম্বর রুমে আনোয়ারুল আজীম খুন হয়েছেন। ঘরের ভেতর পাওয়া গেছে রক্তের ছাপ। তবে ঘরে মেলেনি মরদেহ।
এ ঘটনায় আনোয়ারুল আজীম ভারতে খুন হওয়ার ঘটনায় বুধবার ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেন তার মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন।
মামলার এজাহারে এমপির মেয়ে উল্লেখ করেন, ৯ মে রাত ৮টার দিকে আমার বাবা মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর সংসদ সদস্য ভবনের বাসা থেকে গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হন। ১১ মে ৪টা ৪৫ মিনিটে বাবার সঙ্গে মোবাইলে ভিডিও কলে কথা বললে বাবার কথাবার্তায় কিছুটা অসংলগ্ন মনে হয়। এরপর বাবার মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন দিলে বন্ধ পাই।
১৩ মে আমার বাবার ভারতীয় নম্বর থেকে হোয়াটসঅ্যাপে একটি মেসেজ আসে। মেসেজে লেখা ছিল- ‘আমি হঠাৎ করে দিল্লি যাচ্ছি, আমার সঙ্গে ভিআইপি আছে। আমি অমিত শাহের কাছে যাচ্ছি। আমাকে ফোন দেওয়ার দরকার নেই। পরে ফোন দেবো।
‘এছাড়া আরও কয়েকটি মেসেজ আসে। মেসেজগুলো বাবার মোবাইল ফোন ব্যবহার করে অপহরণকারীরা করে থাকতে পারে।’
এজাহারে আরও উল্লেখ করা হয়, আমরা বিভিন্ন জায়গায় বাবার খোঁজখবর করতে থাকি। আমার বাবার কোনো সন্ধান না পেয়ে বাবার বন্ধু গোপাল বিশ্বাস কলকাতার বারানগর পুলিশ স্টেশনে সাধারণ ডায়েরি করেন। বাবাকে খোঁজাখুজি অব্যাহত রাখি। পরবর্তীসময়ে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানতে পারি অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিরা পূর্ব-পরিকল্পিতভাবে বাবাকে অপহরণ করেছে। বাবাকে সম্ভাব্য সব স্থানে খোঁজাখুঁজি করেও পাইনি।