বাংলার ভোর প্রতিবেদক:
যশোরের অভয়নগর থানা পুলিশের হেফাজতে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। রোববার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে অভয়নগর থেকে যশোর জেনারেল হাসপাতালে আনার পথে তার মৃত্যু হয়। এর আগে শনিবার রাত দেড়টার দিকে উপজেলার নওয়াপাড়া গ্রাম থেকে তাকে গ্রেফতার করে থানা হাজতে রাখা হয়। স্বজনদের দাবি, ইয়াবা দিয়ে ফাঁসিয়ে গ্রেফতারের পর নির্মম নির্যাতনে তার মৃত্যু হয়েছে। তবে পুলিশ বলছে, ইয়াবাসহ আটক ওই নারী হৃদরোগে অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন। পুলিশ চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিল। মারা যাওয়া আফরোজা বেগম (৪০) নওয়াপাড়া মহাশ্মশান নর্থবেঙ্গল রোডের বাসিন্দা আবদুল জলিল মোল্লার স্ত্রী।
পুলিশ জানায়, শনিবার রাত দেড়টার দিকে অভিযান চালিয়ে নওয়াপাড়া গ্রামের বাড়ি থেকে আফরোজাকে গ্রেফতার করা হয়। তার কাছে ৩০টি ইয়াবা পাওয়া যায়। অভয়নগর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বে সহকারী উপপরদির্শক (এএসআই) সিলন আলী, শামসুল হক ও নারী কনস্টেবল রাবেয়া খানম অভিযানে ছিলেন। গ্রেফতারের পর থানা হাজতে রাখা হয়। এ ঘটনায় রবিবার সকালে আফরোজার বিরুদ্ধে অভয়নগর থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ৩৬ (১) ১০ (ক) ধারায় মামলা করা হয়েছে। সকাল ৮টা ২০ মিনিটের দিকে আফরোজা থানা হাজতে অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসার জন্য অভয়নগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসার পর সুস্থ বোধ করলে থানায় ফিরিয়ে আনা হয়। সকাল পৌনে ১০টার দিকে আবার অসুস্থ হন। আবার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক উন্নত চিকিৎসার জন্য যশোর জেনারেল হাসপাতালে নিতে বলেন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে হাসপাতালে নেয়ার পর তাকে মৃত ঘোষণা করেন জরুরি বিভাগের চিকিৎসক।
যশোর জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসা কর্মকর্তা হাসিব মো. আলী হাসান বলেন, ‘বেলা ১১টা ৩৫ মিনিটে আফরোজাকে হাসপাতালে আনা হয়। এখানে আনার আগেই তার মৃত্যু হয়েছে। অভয়নগর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে যে ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে, তাতে বলা হয়েছিল রক্তচাপ ছিল। ময়নাতদন্তের জন্য লাশ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। কী কারণে মৃত্যু হয়েছে, তা ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পাওয়ার পর বলা যাবে।’
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আফরোজার বড় ছেলে ইজিবাইকচালক মুন্না মোল্লা বলেন, ‘স্থানীয় একটি মহলের ইন্ধনে অভয়নগর থানার এএসআই সিলন আলী, শামসুল হক ও কনস্টেবল রাবেয়া খানম শনিবার মধ্যরাতে আমাদের বাড়িতে আসেন। এরপর নিজেদের কাছে থাকা ইয়াবা দিয়ে মাকে গ্রেফতার দেখান। এ সময় ওই দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ আরও কয়েকজন পুলিশ সদস্য মায়ের চুল ফ্যানের সঙ্গে বেঁধে ঝুলিয়ে মারধর করা হয়। রাত আড়াইটার দিকে থানায় নিয়ে যায়। সকালে থানায় গিয়ে দেখতে পাই, মা খুব অসুস্থ। পুলিশকে বারবার অনুরোধ করলে তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। চিকিৎসকরা কয়েকটি টেস্ট দিলেও পুলিশ সদস্যরা সেগুলো করতে না দিয়ে আবার থানায় নিয়ে যান। এরপর আবারও অসুস্থ হয়ে পড়লে যশোর জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। আসার পথেই মায়ের মৃত্যু হয়।’
মুন্নার অভিযোগ, ‘পুলিশ আমাদের ঘরে থাকা ইজিবাইক বিক্রির এক লাখ ৮০ হাজার টাকা নিয়ে গেছে। আরও দুই লাখ টাকা ঘুষের দাবিতে নির্যাতন করে মাকে হত্যা করেছে। আমি এ ঘটনার বিচার চাই।’
আফরোজার ছোট ছেলে নওয়াপাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র সাব্বির মোল্লার ভাষ্য, ‘রাতে আম্মু বাড়ির পাশে পানি আনতে যান। এ সময় বাড়িতে পাঁচ জন পুলিশ আসেন। এর মধ্যে সিলন দারোগা (এএসআই সিলন আলী) আম্মুকে তার কাছে যা আছে, বের করে দিতে বলেন। তার কাছে কিছু নেই জানালে তিনি (সিলন আলী) একজন নারী পুলিশকে ফোন করে ডেকে আনেন। তিনি আম্মুর শরীর তল্লাশি করেও কিছু পাননি। এরপর সিলন দারোগা আম্মুকে চড় দিতে দিতে মাটিতে ফেলে দেন। আম্মুকে মারতে নিষেধ করলে সিলন দারোগা আমাকেও দুটি চড় মারেন। সেই সঙ্গে খুব বাজেভাবে গালিগালাজ করেন। এরপর আমার চোখের সামনে মায়ের চুল ফ্যানের সঙ্গে বেঁধে ঝুলিয়ে রেখে মারধর করেছিল পুলিশ।’
আফরোজাকে নির্যাতন করার অভিযোগের বিষয়ে এএসআই সিলন আলী জানিয়েছেন, ‘আফরোজাকে মারধর কিংবা ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে নির্যাতনের কোনও ঘটনা ঘটেনি। তার পরিবারের সদস্যরা নির্যাতনের মিথ্যা অভিযোগ করেছেন।’
এ ব্যাপারে অভয়নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এসএম আকিকুল ইসলাম বলেন, ‘৩০টি ইয়াবাসহ আফরোজাকে রাত দেড়টার দিকে গ্রেফতার করা হয়। রাতে থানা হাজতে রাখা হয়। সকালে অসুস্থ হয়ে পড়লে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়া হয়। অবস্থার অবনতি হলে যশোর জেনারেল হাসপাতালে নেয়ার পর মৃত্যু হয়। চিকিৎসক বলেছেন, উচ্চ রক্তচাপ ছিল। থানায় অস্বাভাবিক কোনও কিছু ঘটেনি। ময়নাতদন্তের জন্য লাশ মর্গে আছে। প্রতিবেদন পাওয়ার পর মৃত্যুর কারণ জানা যাবে।’
পুলিশ হেফাজতে নারীর মৃত্যুর বিষয়ে অভয়নগর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাহিদুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘ওই নারী হৃদরোগে অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন বলে শুনেছি। পুলিশ তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিল। যদি নির্যাতনের ঘটনা ঘটে থাকে, তাহলে তদন্ত করে দেখা হবে।’