মণিরামপুর সংবাদদাতা
যশোরের মনিরামপুরে আঙুলের ছাপ নিয়ে নতুন প্রতিবন্ধী ভাতাভোগীদের ভাতা দেয়ার সময় অফিস খরচের কথা বলে ১ হাজার ৬০০ টাকা করে কেটে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। বুধবার উপজেলার খেদাপাড়া ইউনিয়ন পরিষদে এ ঘটনা ঘটে। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল আলীম জিন্নাহর পরামর্শে পরিষদের আউটসোর্সিংয়ের কাজ করা ও ব্যাংক এশিয়ার এজেন্ট সৌরভ বিশ্বাস উপকারভোগী অন্তত ৩০ জনের কাছ থেকে এই টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ।
এদিকে প্রতিবন্ধী ভাতাভোগীদের কাছ থেকে আঙুলের ছাপের নামে টাকা কেটে রাখার খবর জানতে পেরে স্থানীয় আমির হোসেন নামে এক যুবক মোবাইল ফোনে ঘটনার ভিডিও ধারণ করতে গিয়ে চেয়ারম্যান আব্দুল আলীম জিন্নাহর হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন। এ সময় চেয়ারম্যান ওই যুবকের ব্যবহৃত ফোন ভেঙে দিয়েছেন বলে অভিযোগ আমির হোসেনের। এ ঘটনায় তিনি বুধবার বিকেলে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তার দপ্তরে মৌখিক অভিযোগ করেছেন।
দুপুরে পরিষদে হট্টগোলের পরপরই ভাতার টাকা প্রদানের কাজ বন্ধ করে চলে যায় ব্যাংক এশিয়ার প্রতিনিধিদল। এরপর টাকা না পেয়ে হতাশ হয়ে শতাধিক মানুষ বাড়ি ফিরে গেছেন।
আমির হোসেন নামে ওই যুবক অভিযোগ করে বলেন, ‘আমার বাবা-মা দুজনের নাম প্রতিবন্ধী ভাতার তালিকায় নতুন করে যুক্ত হয়েছে। সমাজ সেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে তাদের হিসাব নম্বরে ১০ হাজার ১০০ টাকা ঢুকেছে। খেদাপাড়া ইউনিয়ন পরিষদে ভাতার বই ও টাকা দেয়ার খবর পেয়ে বুধবার সকালে পরিষদে টাকা তুলতে যান তারা। বাবা-মায়ের ফিরতে দেরি দেখে দুপুরে আমি পরিষদে যাই। সেখানে গিয়ে শুনতে পাই ব্যাংক এশিয়ার এজেন্টের মাধ্যমে চেয়ারম্যান প্রত্যেক উপকারভোগীর কাছ থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকা কেটে রাখছেন। আমি টাকা নেয়ার ঘটনার ভিডিও মোবাইল ফোনে ধারণ করতে কক্ষে ঢুকি। টের পেয়ে ওই কক্ষের দায়িত্বরতরা কাজ রেখে দৌঁড়ে চেয়ারম্যানের কক্ষে যান। এরপর চেয়ারম্যান এসে আমাকে লাঞ্ছিত করে আমার মোবাইল ফোন ভেঙে ফেলেন। আমি সমাজসেবা কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ দিয়েছি।’
ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চলতি বছরে খেদাপাড়া ইউনিয়নের ১৩৩ জন প্রতিবন্ধীর নাম ভাতার তালিকায় যুক্ত হয়েছে। সম্প্রতি তাদের ব্যাংক এশিয়ার হিসাব নম্বরে ১০-১২ হাজার টাকা যুক্ত হয়েছে। বুধবার আঙুলের ছাপ দিয়ে বই ও টাকা আনতে পরিষদে যান উপকারভোগীরা। পরিষদের একটি কক্ষে আঙুলের ছাপ নেয়া ও টাকা দেয়ার কাজ শুরু হয় এই দিন বেলা ১১টা থেকে। কক্ষে চারজন লোক এই কাজে নিযুক্ত ছিলেন। তাদের মধ্যে দুজন ব্যাংক এশিয়ার কর্মকর্তা।
তারা আঙুলের ছাপ নিয়ে টাকার জন্য পাশের টেবিলে তাদেরই ব্যাংকের নিয়োজিত স্থানীয় প্রতিনিধি সৌরভ বিশ্বাসের কাছে লোকজনকে পাঠান। সৌরভ ব্যাংকের কাজের পাশাপাশি খেদাপাড়া ইউনিয়ন পরিষদে আউটসোর্সিংয়ের কাজও করেন।
তিনি ভাতার বইতে টাকার অঙ্ক তুলে স্বাক্ষর দিয়ে টাকা ভাতাভোগীর হাতে না দিয়ে পাশের টেবিলের পরিষদের এক নারী কর্মীর হাতে দিচ্ছিলেন। সেখান থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকা কেটে নিয়ে ভাতাভোগীর হাতে ৮ হাজার ৫০০ টাকা করে দেয়া হচ্ছিল।
এদিকে ভাতার কেটে নেয়ার বিষয়ে ইউনিয়নের কাশিপুর গ্রামের এমদাদ হোসেন, সাইদুল ইসলাম ও শিরিনা খাতুন নামে তিন উপকারভোগী জানান, তাদের বইতে ১০ হাজার ১০০ টাকা তোলা হয়েছে। কিন্তু হাতে পেয়েছেন ৮ হাজার ৫০০ টাকা। বাকি টাকা ওই রুম থেকে কেটে রাখা হয়েছে। কারণ জানতে চাইলে বলেছেন, ‘এই টাকা অফিস খরচ’। সবার থেকে একইভাবে টাকা কেটে নিচ্ছিলেন। এ জন্য প্রতিবাদ করতে পারেননি।
এদিকে ব্যাংক এশিয়ার প্রতিনিধি সৌরভ বিশ্বাস অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা সব টাকা ভাতাভোগীদের হাতে দিয়েছি। কোনো টাকা কাটা হয়নি।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যাংক এশিয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাইফ আহম্মেদ বলেন, ‘বুধবার আমরা খেদাপাড়া ইউনিয়ন পরিষদে আঙুলের ছাপ নিয়ে প্রতিবন্ধী ভাতা দেয়ার কাজ করছিলাম। ২৮ জনকে ভাতা দেয়ার পর দুপুরে জানতে পারলাম ভাতাভোগীদের কাছ থেকে টাকা কেটে নেয়া হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে আমরা কাজ বন্ধ করে দিয়েছি।’
সাইফ আহম্মেদ আরও বলেন, ‘পরে আমরা ঘটনা তদন্ত করে প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছি আমাদের এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের স্থানীয় প্রতিনিধি সৌরভ বিশ্বাস এই অনিয়মে জড়িত। আমরা তাৎক্ষণিক তার হিসাব নম্বর বন্ধ করে দিয়েছি। সৌরভ আর টাকা লেনদেন করতে পারবেন না। যাদের ভাতা কেটে নেয়া হয়েছে, সৌরভের হিসাব নম্বর থেকে তাদের পাওনা পরিশোধ করা হবে।’
খেদাপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল আলিম জিন্নাহ বলেন, ‘ভাতা দেয়ার সময় আমি পরিষদের অন্য কাজে ব্যস্ত ছিলাম। কারা টাকা কেটে নিচ্ছিল আমার জানা নেই।’
যুবকের মোবাইল ফোন ভেঙে দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে চেয়ারম্যান বলেন, ‘ওই ছেলেটি আমাকে না জানিয়ে ভিডিও করছিল। খবর পেয়ে এগিয়ে গিয়ে আমি তার কাছে কারণ জানতে চেয়েছি। মোবাইল ভাঙা হয়নি।’
উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা রোকনুজ্জান বলেন, ‘খেদাপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের আওতায় প্রতিবন্ধী ভাতার তালিকায় নতুনভাবে যুক্তদের ভাতার বই পরিষদের চেয়ারম্যান আমার অফিস থেকে নিয়ে গেছেন। শুনেছি, পরিষদ থেকে ভাতা দেওয়ার সময় টাকা কেটে রাখা হচ্ছিল।’
যুবকের অভিযোগের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আমি তাকে বলেছি লিখিত অভিযোগ দিতে। ভুক্তভোগী কেউ এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দিলে আমরা খতিয়ে দেখব।’