বাংলার ভোর প্রতিবেদক
অবসর নিলেও চার বছর ধরে পেনশন পাচ্ছেন না এক মাদ্রাসার শিক্ষক। মাসের পর মাস বিভিন্ন দপ্তর ঘুরে পেনশন না পেয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে কষ্টে দিনাতিপাত করেছেন তিনি। অর্থাভাবে ঠিকমতো চিকিৎসা করাতে পারেননি প্রিয়তমা স্ত্রীকেও। শেষমেষ বৃহস্পতিবার বিনা চিকিৎসায় মারা গেলেন ওই অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকের স্ত্রী। মানবিক ও হৃদব্যথিত ঘটনাটি ঘটেছে যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার উত্তর শ্রীরামপুরে।
যে শিক্ষকের অনেক শিক্ষার্থী ইঞ্জিনিয়ার হয়ে দেশ-বিদেশে চাকরি করছে, সেই শিক্ষকের জীবন সায়াহ্নে চরম সংকটে মেনে নিতে পারছেন না। ঘটনার পর থেকে ওই শিক্ষক দম্পত্তির ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করে পেনশন সংশ্লিষ্টদের সমালোচনা করতেও দেখা গেছে। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক নজরুল ইসলাম (৬৫) ও তার স্ত্রী তোহরা খাতুন (৫৫)। নজরুল ইসলাম যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার নারিকেলবাড়িয়া ইউনিয়নের উত্তর শ্রীরামপুর গ্রামের বাসিন্দা। তিনি এমপিওভুক্ত খানপুর দাখিল মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক ছিলেন।
স্থানীয়ভাবে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে নজরুল ইসলামের স্ত্রী তোহরা খাতুন বার্ধক্যজনিতসহ নানা রোগে আক্রান্ত ছিলেন। অর্থের অভাবে চিকিৎসা করাতে না পারা তোহরা এতোদিন বাড়িতেই শয্যাসায়ী ছিলেন। বৃহস্পতিবার (১৩ জুন) সকাল ১০টার দিকে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ভর্তির কিছু সময় পর দায়িত্বরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। সন্ধ্যায় স্থানীয় মসজিদে জানাযা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়েছে।
জানা গেছে, নজরুল ইসলাম দীর্ঘ ৩৫ বছর মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং একটি এমপিওভুক্ত দাখিল মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেছেন। বছর চারেক আগে অবসরে যান এই শিক্ষক। কিন্তু শিক্ষা দিয়ে অনেকের জীবনের পরিবর্তন করা এই শিক্ষকের অবসরের পরের জীবন পতিত হয় চরম সংকটের মধ্যে। অবসরে যাওয়ার পরে আজ পর্যন্ত পেনশনের কোনো টাকা পাননি তিনি। পেনশনের টাকার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন এই মানুষ গড়ার কারিগর। পেনশনের টাকা না পাওয়ায় চিকিৎসা বন্ধ হয়ে শয্যাশায়ী অসুস্থ স্ত্রী মারা গেলেন। তার এক মেয়েও অসুস্থ।
শিক্ষক নজরুল ইসলাম জানান, তিনি ১৯৮২ সাল থেকে শ্রীরামপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। সেখানে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে দুই বছর দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৯৮৪ সালে বাঘারপাড়ার এমপিওভুক্ত খানপুর দাখিল মাদ্রাসায় সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। সেখান থেকে ২০২০ সালের ২১ জুন অবসর গ্রহণ করেন শিক্ষক নজরুল। অবসরে যাওয়ার পর কল্যাণ তহবিলের ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা পেলেও, আজ পর্যন্ত পেনশনের একটি টাকাও পাননি তিনি।
নজরুল ইসলাম বলেন, অর্থের অভাবে আমার অসুস্থ স্ত্রী এবং মেয়ের চিকিৎসা বন্ধ হয়ে যায়। তাদের প্রতি মাসে চিকিৎসা সেবার জন্য ১০-১৫ হাজার টাকা প্রয়োজন হয়। বাঘারপাড়ার একটি এনজিওতে ৩ হাজার টাকা বেতনে একটি চাকরি নিয়েছি। তাই দিয়ে আপাতত কোনোরকম ডালভাত খেয়ে বেঁচে আছি। তিনি বলেন, আমার পরিবারের তিন সদস্যের সবাই রোগী। পেনশনের টাকার জন্য কয়েকবার ঢাকার ব্যানবেইসে গিয়েছি। সেখান থেকে আমার কাগজপত্র অস্পষ্ট বলে ফিরিয়ে দিয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার ছাত্র অনেকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হয়ে দেশ-বিদেশে চাকরি করছে। কেউ আজ পর্যন্ত আমার খোঁজখবর নেয়নি। সম্প্রতি আমি ফেসবুক লাইভে এসে কথা বললে অনেকে যোগাযোগ করেছে, সহোযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। কিন্তু কেউ এখনও সহযোগিতা করেনি। আজ অর্থাভাবে বিনা চিকিৎসায় আমার স্ত্রী মারা গেলো’- আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন নজরুল ইসলাম।
বন্দবিলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও খানপুর দাখিল মাদ্রাসার সভাপতি সবদুল হোসেন খান বলেন, ‘আমাকে নজরুল স্যার কিছু জানাননি, আর আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না। বিষয়টি আমি খতিয়ে দেখবো। বাঘারপাড়া উপজেলা ভারপ্রাপ্ত শিক্ষা কর্মকর্তা আশিকুজ্জামান বলেন, ‘অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক নজরুল ইসলামের বিষয়টি নিয়ে আমাদের মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের কিছুই করার ছিল না। পেনশনের জন্য ওই মাদ্রাসার সভাপতির স্বাক্ষরসহ ঢাকা কল্যাণ বোর্ডে আবেদন করতে হয়। তার স্ত্রীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করছি।’