বাংলার ভোর প্রতিবেদক
যশোরের চৌগাছা উপজেলার একটি গ্রাম রাণীয়ালি। গ্রামটিতে কয়েকটি পাড়ার বাসিন্দাদের শরীরে জ্বালাপোড়া আর জ্ঞান হারানোর মতো ঘটনা শুরু হয়েছে গেল সপ্তাহ থেকে। এসব ব্যক্তিদের হাত ও পায়ে লাল দাগ আবার দাগ ছাড়াও কেউ কেউ আক্রান্ত হচ্ছেন। কেউ কাজ করার সময় আক্রান্ত হচ্ছেন, কেউবা ঘুম থেকে উঠে। এরপর গ্রাম জুড়েই ছড়িয়ে গেছে এই অজানা কিছুর কামড়ের আতঙ্ক। গত এক সপ্তাহে গ্রামটিতে অজানা বস্তুর কামড়ে আক্রান্ত হয়েছেন অন্তত ৩০ ব্যক্তি। এর মধ্যে যশোর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ১০ জন। বাকিরা স্থানীয় ওঝা ও কবিরাজের কাছে চিকিৎসা নিয়েছেন।
গ্রামে কথিত জিনসাপের দংশনে যারা হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন খাইরুজ্জামানের স্ত্রী ফেরদৌসি বেগম (৪৫), রিতনা বেগম (৪০), ৯ম শ্রেণির ছাত্রী সুফল মন্ডলের মেয়ে পল্লবী মন্ডল (১৫), নারায়ণ চন্দ্র (৪৫), শরজেত মন্ডলের মেয়ে তমা মন্ডল (১৫), কোমর মন্ডলের মেয়ে অনিতা মন্ডল (২০), গৌতম মন্ডলের স্ত্রী রমা মন্ডল (২৫), প্রসেনজিত মন্ডলের মেয়ে মৌসুমি মন্ডল (২০), সুফল মন্ডলের মেয়ে কেয়া মন্ডল সহ (১৬) গ্রামের প্রায় অর্ধশতাধিক নারী-পুরুষ কথিত জিনসাপের দংশনের পরে গ্রাম্য চিকিৎসকসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।
এ বিষয়ে স্থানীয় ইউপি সদস্য ও কবিরাজ আব্দুল মজিদের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, আমি তো কারো চিকিৎসা দিতে যাচ্ছি না। সবাই আমার কাছে আসছে। আমিই রোগীদের হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি।
সোমবার বিকেলে স্থানীয় পাশাপোল ইউনিয়নের ইউপি সদস্য গোবিন্দ চন্দ্র ঢালী মুঠোফোনে বলেন, ‘গত বুধবার রাতে সাপে দংশনের শিকার হন রাণিয়ালি গ্রামের আব্দুর হকের স্ত্রী রাবেয়া বেগম। এর পর যশোর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাবেয়ার পরের দিন মৃত্যু হয়। তার পর থেকে এলাকায় সাপ আতঙ্ক বিরাজ করছে। অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছেন। কিন্তু কেউ সাপ দেখেনি। শরীরে জ্বালাপোড়া আর জ্ঞান হারানো ঘটনা ঘটলেই ওঝা কবিরাজদের কাছে যাচ্ছেন। ওঝারা শরীরে বিষের উপস্থিতি নিশ্চিত করলেই কেউ হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন, কেউ বা স্থানীয় পল্লী চিকিৎসক ও কবিরাজের কাছে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এ পর্যন্ত গ্রামটিতে ৩০ জন আক্রান্ত হয়েছেন। ১০ জনের মতো যশোর সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে।’
যশোর জেনারেল হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, শুধুমাত্র চৌগাছা উপজেলার পাশাপোল ইউনিয়নের রাণিয়ালি গ্রাম থেকে রোববার ও সোমবার ১০ জন রোগী কোন কিছুর দংশনের শিকার হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে নারী ৮ জন ও দুই জন পুরুষ। হাসপাতাল কতৃপক্ষ বলছে, এসব ব্যক্তিদের হাত ও পায়ে লাল দাগ আবার দাগ ছাড়াও কেউ কেউ ভর্তি হয়েছেন। ১০ জনকেই ভর্তি রেখে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। সাপে কামড়ানোর তেমন কোন উপসর্গ দেখা যায়নি। তাই অ্যান্টিভেনাম ইনজেকশন দেয়া হয়নি তাদের।
যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি রাণিয়ালি পশ্চিমপাড়ার এলাকার মিথুন মন্ডলের স্ত্রী প্রান্ত মন্ডল (৩৩) বলেন, ‘গতকাল সকালে রান্নাঘরের শুকনা কাঠ সাজাচ্ছিলাম। ওমন সময় হাতে কিছু একটা কামড় দিলে জ্বলে ওঠে। হাতের ডান হাতের কবজিতে লাল দাগ সৃষ্টি হয়। বাড়ির লোকজনের পরামর্শে স্থানীয় ওঝার কাছে গেলে তিনি আমার শরীরে বিষের উপস্থিতি টের পান। এর পর গতকাল রাতে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি।’
রাণীয়ালি হাই স্কুলপাড়া এলাকার উৎপল মন্ডলের স্ত্রী তমালিকা (২২) বলেন, ‘রাতে ঘুমিয়ে ছিলাম। সকালে দেখি হাতে জ্বলছে। একপর্যায়ে হাত অবশ হয়ে যায়। সেখানে কিছু একটা কামড়ের দাগ রয়েছে। ওঝার কাছে গেলে বিষের উপস্থিতি পেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি। এখন অনেকটা সুস্থ রয়েছি।’
স্থানীয় সন্তোষ কুমার মন্ডল বলেন, ‘কয়েকদিন আগে একজন মারা যাওয়ার পর থেকে সাপ আতঙ্কে রয়েছি আমরা। কিন্তু সাপ দেখেনি কেউ। কবিরাজ ওঝার কাছে গেলে তারা বলছে, জ্বীন সাপে কেটেছে। জ্বীন সাপ তার নাতনীর পায়ে কামড়ায়। এর পর ঝিকরগাছার বাঁকড়া ওঝার কাছে নিয়ে গেলে ঝাড়ফুঁক করেছেন। চার হাজার টাকার বিনিময়ে ওঝার থেকে কাঁড় পড়া নেন। কিছুটা সুস্থ হলেও স্থানীয়দের পরামর্শে নাতনীকে হাসপাতালে এনেছি। এই বৃদ্ধার ভাষ্য তাদের পরিবারের একজনসহ গত এক সপ্তাহে রাণিয়ালি গ্রামে প্রায় অর্ধশতাধিক মানুষকে জ্বীন সাপ কামড়েছে।
যশোর জেনারেল হাসপাতালের মহিলা মেডিসিন বিভাগের সিনিয়র নার্স শিউলি সরকার বলেন, ‘মহিলা মেডিসিন ওয়ার্ডে বর্তমানে ৮ জন রোগী ভর্তি রয়েছেন। তারা বলছেন, তাদের সাপে কেটেছে। তবে সাপে কাটার তেমন কোন উপসর্গ দেখা যায়নি। তাদরে ২৪ ঘন্টা পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। তারা সবাই সুস্থ্য রয়েছেন।’
এদিকে, গ্রামের বেশ কয়েকজন জানান, সাপে কাটার কথা শোনা গেলেও কেউ এখনও সে সাপ দেখেননি। কবিরাজ-ওঝারা বলছেন, এটি জ্বীন সাপ। গ্রামের সাধারণ মানুষ তা বিশ্বাসও করছেন। ব্যাস!! রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। অনেকেই স্থানীয় ওঝা কবিরাজের কাছে চিকিৎসা নিচ্ছেন। অনেকেই হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হচ্ছেন। জ্বীন সাপে আতঙ্কের সুযোগ নিয়েছেন স্থানীয় ওঝা, সাপুড়ে, কবিরাজরাও। জ্বীন সাপে দংশিত হচ্ছে মানুষ- এমন আতঙ্ক ছড়িয়ে তারা লুটে নিচ্ছে জনসাধারণের অর্থ।
যশোর জেনারেল হাসপাতালের তত্বাবধায়ক ডা. হারুন অর রশিদ বলেন, ‘অনেকেই আতঙ্কে ভর্তি হচ্ছেন। ভর্তি রোগীরা সবাই সুস্থ রয়েছেন। তিনি বলেন, মানুষকে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হতে হবে। বাড়িঘরের ঝোপঝাড় পরিষ্কার রাখতে হবে। কোনও সাপ কামড়ালে সরাসরি হাসপাতালে চলে আসা উচিত। এছাড়া সাপে কামড়ালে সেটির ছবি তুলে রাখতে পারলে চিকিৎসা দেওয়া অনেকটাই সহজ হয়। হাসপাতালে সাপে কাটার ওষুধের কোন সংকট নেই।’