হাসান আদিত্য
যশোর শহরের কাজিপাড়াস্থ কাঁঠালতলা মোড়। মোড়ে দাঁড়িয়ে উত্তর দিকে তাকালেই গ্লাস আর অ্যালুমিনিয়ামের পাতের বহিরাবরণে তিনতলা বিশিষ্ট বাড়ি। বাড়িটির মালিক যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য শাহীন চাকলাদার। বাড়িটির গা ঘেঁসেই সাদা রঙের এক তলা বিশিষ্ট ভবন। সেটিও শাহীন চাকলাদারের। এই ভবনটি তিনি ব্যক্তিগত, দলীয় রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক কার্যালয় হিসেবে চালাতেন।
গত সোমবার বিকেলে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দুবৃর্ত্তরা ভবনটি ভাংচুর করে। অগ্নিসংযোগের পর লুটপাটও করেছেন। দুই দিন আগেও ভবন দুটি ঘিরে যশোরকেন্দ্রিক আওয়ামী লীগ ও প্রশাসনের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রিত হতো। সকাল থেকে গভীর রাতপর্যন্ত নেতাকর্মীদের পদচারণায় মুখর থাকতো : সেই ভবনদুটিতে এখন সুনশান নীরবতা।
স্থানীয়রা ও সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ভবনদুটিতে আগুন দেয়ার আগে দুবৃর্ত্তরা তার পাঁচ তারকা হোটেলে আগুন দেয়। সেই আগুনের খবরেই শাহীন চাকলাদারের এই ভবন দুটিতে থাকা কর্মচারিরা পালিয়ে যায়। আর সোমবার সকালেই যশোর ছাড়েন শাহীন চাকলাদার। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে আগেই স্ত্রী দুই মেয়েকে নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দেন। জেলার দেড় দশক ধরে আধিপত্যে থাকা শাহীনের অবস্থান জানেন না নেতাকর্মীরা। এমনকি তার মোবাইল ফোনও বন্ধ পাওয়া গেছে।
শুধু শাহীন চাকলাদারই না, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং দেশ ছাড়ার পর আত্মগোপনে চলে গেছেন যশোরের ৬ সংসদ সদস্য, পৌরসভা-উপজেলার জনপ্রতিনিধি, আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনগুলোর শীর্ষ নেতারা। তাদের সবার মোবাইল ফোন বন্ধ রয়েছে। বাড়িতেও কাউকে পাওয়া যায়নি। ভাংচুর হওয়া এসব নেতাদের ব্যক্তিগত ও রাজনীতির অফিসও বন্ধ পাওয়া গেছে।
সরেজমিনে, বুধবার বিকেলে যশোর শহরের কাজিপাড়াতে শাহীন চাকলাদারের বাসায় ভাংচুর ও অগ্নিকাণ্ডের ক্ষত দেখা গেছে। প্রধান ফটক তালাবদ্ধ। পাশেই শাহীন চাকলাদারের রাজনৈতিক কার্যালয়ও তালাবদ্ধন্ধ। সেখানেও ভাংচুর করা হয়েছে। উৎসুক কিছু লোকজন তাকিয়ে বাড়ির অবস্থা দেখছেন। বাড়িতে শাহীনের পরিবারের কেউ নেই। ২-৩ জন কর্মচারী বাড়িতে রয়েছেন। অনেককেই মোবাইলে ছবি ও ভিডিও করতে দেখা গেছে।
স্থানীয়রা জানান, দৃষ্টিনন্দন কাঁঠালতলার বাসাতে শাহীন পরিবার নিয়ে উঠেন ২০১৬ সালের দিকে। এর আগে পরিবার নিয়ে ভাইদের সঙ্গে কাজীপাড়া পুরাতন বাসায় থাকতেন। তবে কাঁঠালতলায় একতলাবিশিষ্ট ভবনটি রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত দলীয় কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করে আসছিলেন দুই দশক ধরে। এই অফিসকে ঘিরেই শাহীন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন।
নেতাকর্মীদের তথ্যমতে, পুরনো ব্যবসার সাথে গত দেড় দশক এখানে বসে যশোরের রাজনীতি, ঠিকদারি কাজ নিয়ন্ত্রণ, চাকরিতে নিয়োগ ও বদলি, ব্যবসা-বাণিজ্য, সবকিছু নিয়ন্ত্রণ হতো। আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনগুলো এমনকি পেশাজীবী সংগঠনগুলো চলতো এই অফিসের নির্দেশনায়। দলের কমিটিগুলো গঠন করে দিতেন তারাই। শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে দলের তার শীর্ষ অনুসারীরাও আত্মগোপনে।
কাঁঠালতলা থেকে আধা কিলোমিটার দূরে যশোর-৩ আসনের সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদের বাসা ও রাজনৈতিক কার্যালয়। ভবনটিতে কোন ভাংচুর না করা হলেও কাউকে পাওয়া যায়নি। তার এক অনুসারী জানান, নাবিল দেশের শীর্ষ ব্যবসায়িক গ্রুপ জেমকন গ্রুপের ভাইস প্রেসিডেন্ট। বর্তমান পরিস্থিতিতে পরিবার নিয়ে কিছুদিন আগে ভারতে গিয়ে সমালোচনায় পড়েন। সেখানে তার পরিবার থাকতে পারেন।
তবে নাবিল আহমেদ এখন কোথায় সেটা বলতে পারেননি।
শহরের ঘোপস্থ পিলু খান সড়কস্থ বাসভবনে পাওয়া যায়নি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলনের। বাড়ির সামনে তার ব্যক্তিগত কার্যালয়ও বন্ধ পাওয়া গেছে। বিভিন্ন সময়ে টাঙানো ব্যানারও দেখা যায়নি। স্থানীয়রা জানান, বাড়িতে মিলন ও তার পরিবারের কেউ নাই। কোথায় আছেন সেটাও জানেন না তারা।
আত্মগোপনে চলে গেছেন দ্বাদশ সংসদের সদ্য বিলুপ্ত হওয়া যশোর -১ (শার্শা) আসনের সংসদ শেখ আফিল উদ্দিন, যশোর-২ (ঝিকরগাছা-চৌগাছা) আসনের সংসদ ডা. তৌহিদুজ্জামান তুহিন, যশোর-৪ (বাঘারপাড়া-অভয়নগর) আসনের সংসদ এনামুল হক বাবুল, যশোর-৫ (মণিরামপুর) ইয়াকুব আলী ও যশোর -৬ (কেশবপুর) আসনের সংসদ আজিজুল ইসলাম। তাদের সকলেই মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।
এদিকে যশোর সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহিত কুমার নাথের খোঁজ মিলছে না মঙ্গলবার থেকেই। শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবরের পরে শহরের রেলরোডের মদের দোকান ও নাথ কম্পিউটারে হামলা চালায়। একইসঙ্গে সব কম্পিউটার ও ল্যাপটপ লুট করে নিয়ে যায়। এছাড়া সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহারুল ইসলামের বাড়িতেও হামলা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। সদর উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বিপুল সোমবার সন্ধ্যায় দুর্বৃত্তদের ছোড়া গুলিতে গুলিবিদ্ধ হন বলে খবর চাউর হয়।
তবে এখন পর্যন্ত তাদের কোনো অবস্থান সম্পর্কে জানা যায়নি। এছাড়া যশোরের আট উপজেলার আওয়ামী লীগের সভাপতি-সম্পাদকসহহ শীর্ষ নেতৃবৃন্দ, আট উপজেলার চেয়ারম্যান ও পৌরসভার মেয়র ও জনপ্রতিনিধিরা আত্মগোপনে রয়েছেন। সোমবার দুপুরের পর থেকে তাদের মুঠোফোন বন্ধ রয়েছে। এদের বেশির ভাগ নেতাকর্মীদের বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও ভাংচুর চালানো হয়েছে বলে জানাগেছে।
এই বিষয়ে বিএনপির খুলনা বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত বলেন, ‘আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের অফিস ও বাসা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাংচুরের সঙ্গে বিএনপির কোন নেতাকর্মী জড়িত না। টানা ১৫ বছরে ক্ষমতায় থেকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা যে শাসন নির্যাতন করেছে, সেটা ক্ষুব্ধ জনগণের বহিঃপ্রকাশ এটি। জনগণের রোষাণলের ভয়ে আতংকে তারা আত্মগোপনে। যশোরে ভাংচুর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ও প্রাণহানির ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে অনিন্দ্য ইসলাম অমিত। হতাহতদের উদ্ধারে আমরা তৎপর ছিলাম। আহতদের হাসপাতালে চিকিৎসা নিশ্চিত করেছি। সংখ্যালঘুদের বাড়ি উপসানলয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছি।’