বাংলার ভোর প্রতিবেদক
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর সহিংসতায় যশোরের ২৯টি স্থানে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নির্যাতন, বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাংচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছে ‘বৈষম্যবিরোধী সংখ্যালঘু ছাত্র আন্দোলন’ যশোরের নেতৃবৃন্দ। সোমবার বিকেলে ভৈরব চত্বরে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভ সমাবেশে এ দাবি জানানো হয়। একই সাথে ঢাকায় ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’র কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ ‘ বৈষম্যবিরোধী সংখ্যালঘু ছাত্র আন্দোলনের দাবির সাথে সহমত পোষণ করে সরকারের উপদেষ্টাদের সাথে আলোচনার উদ্যোগ নেয়ায় চলমান কর্মসূচি স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে।
এদিকে, ‘বৈষম্যবিরোধী সংখ্যালঘু ছাত্র আন্দোলন’ যশোরের সাত সদস্যের সমন্বয়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা হলেন, প্রধান সমন্বায়ক হলেন মৃদুল হালদার। অন্য ৬ সমন্বায়ক হলেন- তন্ময় দত্ত, সাগর শীল, তমা দাস, কাজল মণ্ডল, সৌরভ বিশ্বাস ও স্মিতা ভদ্র।
সমাবেশ থেকে ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণে বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে ছাত্ররা অবিলম্বে সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় ও সংখ্যালঘু সুরক্ষা কমিশন গঠনসহ ৮ দফা দাবি জানিয়ে যশোরের ঘটে যাওয়া ২৯টি এলাকায় শতাধিক সনাতনীর উপর নির্যাতন ও লুটপাটের তথ্য উপস্থাপন করেন ‘বৈষম্যবিরোধী সংখ্যালঘু ছাত্র আন্দোলন’ যশোরের প্রধান সমন্বায়ক মৃদুল হালদার।
তিনি বলেন, ৫ আগস্ট দুপুরের পর থেকে যশোরের প্রায় সবকটি উপজেলায় শতাধিক হিন্দু বাড়ি এবং হিন্দুদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, ডাকাতি ও লুটপাট করা হয়। পরের দিন মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত এ সব ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় হিন্দুদের মধ্যে ভয়-আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পরে সাম্প্রদায়িক হামলা থেকে রক্ষা পেতে বৈঠক করে হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামে রাত জেগে পাহারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
তিনি বলেন, ৫ আগস্ট রাত সোয়া নয়টার দিকে যশোর শহরের বেজপাড়ার বনানী সড়কে লক্ষ্মী রানী বাড়িতে হামলা হয়। বাড়ির প্রধান ফটক ভেঙে লক্ষ্মী রানীর আয়ের একমাত্র অবলম্বন সেলাই মেশিন, রান্নার চুলা, গ্যাসের সিলিন্ডার এবং আলমারিতে রাখা ভাইয়ের সদ্যবিবাহিত স্ত্রীর ১০ ভরি সোনার গয়না লুট করে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। একই দিন রাতে যশোর শহরের বেজপাড়ার বাসিন্দা চাকুরিজীবী শংকর কুমার মল্লিক ও ব্যবসায়ী গোবিন্দ সাহা নামের দুজনের বাড়ির ফটক ভেঙে দুর্বৃত্তরা প্রবেশ করার চেষ্টা করে। মূল ফটক ভাঙতে ব্যর্থ হয়ে জানালার থাই কাচ ভাঙচুর করে। যশোর শহরের রেলসড়কে অবস্থিত সুকুমারের ‘এফএল শপ’ নামের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও লুটপাট হয়। ওইদিন বিকেলে কয়েকশ লোক বাঘারপাড়া উপজেলার নারিকেলবাড়িয়া বাজারের অন্তত ২৫টি দোকানে হামলা চালায়। এর মধ্যে ২০টি হিন্দুদের দোকান। তারা এ সময় দোকানে থাকা সব মালামাল লুট করে নিয়ে যায়।
রাতে ১০ থেকে ১২ জন রামদা ও দেশি অস্ত্র নিয়ে যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার নারিকেলবাড়িয়া গ্রামের লিটন কুন্ডুর বাড়ির ঘরের গ্রিল কেটে ঘরে ঢোকে। তাদের সবার মুখ কালো কাপড়ে বাঁধা ছিল। তারা অস্ত্রের মুখে বাড়ির লোকজনদের জিম্মি করে স্বর্ণালংকার ও নগদ টাকা নিয়ে যায়। একই দিন যশোরের মণিরামপুর উপজেলার কুলটিয়া ইউপি চেয়ারম্যান শেখর রায়ের বাড়ির পাশের একটি মন্দিরের সামনে আগুন ধরিয়ে দেয়। এছাড়া ওই দিন যশোরের অভয়নগর উপজেলার পায়রা ইউনিয়নের বারান্দী গ্রামের রবিন বিশ্বাস, যুধিষ্ঠির বিশ্বাস ও মহেন বৈরাগীর বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করা হয়।
অভয়নগর উপজেলার ধোপাদী গ্রামের ব্যবসায়ী কৃষ্ণ দত্তের বাড়িতে হামলা চালায় এবং লুটের ঘটনা ঘটে। একই উপজেলার জয়খোলা গ্রামের রবিশংকর বিশ্বাসের বাড়িতে ১০ থেকে ১২ জনের একটি সশস্ত্র দল ঢুকে স্বর্ণালংকার ও নগদ টাকা নিয়ে যায়। এ সময় বাড়ির তিনজনকে পিটিয়ে জখম করা হয়। বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে যশোরের কেশবপুর উপজেলার পাজিয়া বাজারের চাল ব্যবসায়ী বিকাশ চন্দ্র পালের বাড়িতে ভাঙচুরের পাশাপাশি তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে লুটপাট চালানো হয়। এসময় গুদাম থেকে ২০০ বস্তা চাল, সাড়ে ৪০০ বস্তা খইল, আড়াইশ বস্তা ভুসি এবং আড়াইশ বস্তা আটা লুট হয়। এ ছাড়া নগদ ১ লাখ টাকাও লুট করে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে তাঁর কাছ থেকে আরও ২ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন নতুনহাট এলাকার রিপন নামের এক ব্যক্তি। পরে রিপন তার কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকাও নেয়।
একইদিন যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার শালবরাট গ্রামের হিন্দুপাড়ায় হামলা চালায় ১০ থেকে ১২ জনের একটি দল। এই পাড়ায় ৬৫টি হিন্দু পরিবার বসবাস করে। মুখে কালো কাপড় বেঁধে হাতে রামদা নিয়ে তারা পাঁচ থেকে ছয়টি বাড়িতে যায়। তারা দুটি পরিবারের কাছে চাঁদা দাবি করে। তাৎক্ষণিকভাবে টাকা দিতে না পারায় তারা একজন বৃদ্ধকে পিটিয়ে আহত করে। তারা একজনের বাড়ি থেকে তিনটি গরু এবং অপর একজনের বাড়ি থেকে দুটি ছাগল নিয়ে যায়। এছাড়া রাতে বাঘারপাড়া উপজেলার সেকেন্দারপুর গ্রামে একদল মুখোশধারী তিনটি হিন্দু বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও লুটপাট করে। ওইদিন সন্ধ্যা থেকে ভোর রাত পর্যন্ত যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার ধলগ্রাম ইউনিয়নের পাঁচটি গ্রামের ২০ থেকে ২৫টি হিন্দু বাড়িতে চার দফায় হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়।
একই উপজেলার ধলগ্রাম ইউনিয়নের আন্ধারকোটা গ্রামের দীপংকর বিশ্বাসের বাড়িতে চার দফা হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে। ওই বাড়ি থেকে চারটি গরু, ২৫টি হাঁস, ১৫টি মুরগি, ৪০টি হাঁসের ডিম, দুই বস্তা চাল এবং একটি বৈদ্যুতিক মোটর নিয়ে যায়। তাদের কাছে এক লাখ টাকা দাবি করা হয়। টাকা না পেয়ে তাদের ঘরের মধ্যে রেখে হামলাকারীরা পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিতে যায়। ঘরে থাকা ৫০ হাজার টাকা দিয়ে তাঁরা প্রাণে রক্ষা পান। বাঘারপাড়া উপজেলার নতুনগ্রামের স্বপন কুন্ডু, শেখর ঢালী, বল্লামুখ গ্রামের অরবিন্দু, অমল ও মোহন্ত কুন্ডুর বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর, স্বর্ণালংকার ও মালামাল লুটপাট করা করা হয়।
এরপর গভীর রাতে একদল লোক বাঘারপাড়া উপজেলার সুলতাননগর গ্রামের ঋষিপল্লির কয়েকটি বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও মালামাল লুট করে।
এছাড়া যশোররের মণিরামপুর উপজেলার আম্রবুটা গ্রামের দিলীপ সিংহের বাড়িতে হামলা চালায় একদল লোক। এ সময় তারা তার দোতলা বাড়িতে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়।
ওইদিন সন্ধ্যায় একদল লোক মণিরামপুর উপজেলার খাটুয়াডাঙ্গা বাজারে দিলীপ সিংহের দুটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর এবং দোকানে থাকা মালামাল নিয়ে যায়।
সোমবার সন্ধ্যায় যশোর মণিরামপুর কাশিমনগর ইউনিয়নের নাদড়া কামারঘাটা বাজারের হিন্দুদের সবকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়েছে। দোকানগুলো হলো-সঞ্জয় দাসের সার ও মুদিখানার দোকান, জগদীশ রায় শাড়ি থ্রিপিচ ও জুতার দোকান ও ডেকরেটরের দোকান, বিধান দাসের চায়ের দোকান, কৃষ্ণ দাসের মুদিখানার দোকান, চঞ্চল দাসের মুদিখানা, বলাইয়ের ওষুধের দোকান, বিদ্যুৎ দাসের মুদিখানার দোকান। এখানে হিন্দুদের দোকান লুটপাটের পর দিন রাতে ইমন নামে এক বিএনপি দোকানে আগুন লাগে, সেই ছেলে ও তার লোকজন এখন সঞ্জয় দাস, জগদীশ দাসদের ওপর দোষারোপ করে হুমকি দিচ্ছে- এরা ভয়ে বাইরে বেরোতে পারে না- আতঙ্কে দিন কাটছে ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দুদের।
এছাড়া ওইদিন যশোর শহরের চিত্তরঞ্জন সড়কে (রেলরোড) অবস্থিত পার্থপ্রতিম নাথের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নাথ কম্পিউটারে হামলা করে লুটপাট করেছে। এ সময় দোকান ও তিনটি গুদামে থাকা কম্পিউটার, ল্যাপটপ, এসি, রাউটার ও আমদানি করা যন্ত্রাংশ লুট করে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। যার মূল্য প্রায় ৫ কোটি টাকা। এছাড়া যশোর শহরের চিত্তরঞ্জন সড়কে (রেলরোড) অবস্থিত মোহিত নাথের ব্যক্তিগত অফিস ও তার প্রকাশনায় প্রকাশিত দৈনিক প্রজন্মের ভাবনা পত্রিকা অফিস ভাঙচুর করে ১০টি কম্পিউটর যায় দুর্বৃত্তরা।
সন্ধ্যায় যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার নারিকেলবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান বাবলু কুমার সাহার বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করা হয়। মণিরামপুর উপজেলার কুলটিয়া ইউপি চেয়ারম্যান শেখর রায়ের বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর করা হয়। অভয়নগর উপজেলার পায়রা ইউপির ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ও বারান্দী গ্রামের মনিশংকর রায়ের বাড়িতে ওইদিন বিকেলে একদল লোক হামলা চালিয়ে ভাঙচুর এবং নগদ টাকা ও স্বর্ণালংকার নিয়ে যায়।
অভয়নগর উপজেলার পায়রা ইউনিয়নের বারান্দী গ্রামে সন্ধ্যায় পায়রা ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান বিষ্ণুপদ দত্তর বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করা হয়। বাঘারপাড়া উপজেলার ধলগ্রাম ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান সুভাষ দেবনাথের মানিকদোয়া গ্রামের বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে একদল লোক। এ সময় তারা গোয়াল থেকে দুটি গরু নিয়ে যায়।
৬ আগস্ট সকালে সকালে যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার নারিকেলবাড়িয়া গ্রামের শিমুল সাহার বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করা হয়। এ সময় তারা বাড়ির লোকজনের কাছে এক লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। পরে নারিকেলবাড়িয়া বাজারে গিয়ে হিন্দুদের অন্তত তিনটি দোকান ভাঙচুর করে।
৮ আগস্ট রাতে যশোরের মণিরামপুর উপজেলার জালালপুর গ্রামের ঘোষপাড়ায় পলাশ ঘোষের বাড়িতে হামলা ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। সেখান থেকে ওই ব্যক্তির স্কুলপড়ুয়া ছেলে অপহরণ করে নিয়ে যায় হামলাকারীরা।