সাজেদ রহমান
যেকালে ডেপুটি হওয়া ছিল জীবনের লক্ষ্য, সেকালে তাঁর ধ্রুব লক্ষ্য ছিল কবি হওয়া। যেকালে বাঙালিরা অহঙ্কারে ফেটে পড়তেন সদর দেওয়ানি আদালতের উকিল হয়ে, সেকালে তিনি কেবল ব্যারিষ্টার হবার উদ্দেশ্য নিয়ে বাঙালিদের মধ্যে প্রথম বিলেত গেছেন।১ এবং সে সময়ের তুলনায় বিত্তও উপার্জন করেছেন যথেষ্ট। কিন্তু তা দিয়ে আর পাঁচ জনের মত জমি কেনেননি। দু’হাতে তা উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি এমন অসাধারণ ছিলেন যে, সে সময়ের লোকেরা কেউ তাঁকে ঘৃণা করেছেন, কেউ ভালোবেসেছেন, কেউ বা করুণা করেছেন। কিন্তু কেউ তাকে অস্বীকার করতে পারেনি। বলছিলাম মাইকেল মধুসূদন দত্তের কথা। এই মহাকবির শেষ জীবন কেটেছে অনাদর আর অবহেলায়। বিনা চিকিৎসায় বলা যায় তাঁর মৃত্যু হয়েছে। ১৮৭৩ সালের মার্চ মাস নাগাদ কবির স্বাস্থ্য একেবারে ভেঙ্গে পড়ে। যোগীন্দ্রনাথ বসু বলেছেন ,‘ঢাকা থেকে ফেরার পর।২ হেনরিয়েটার স্বাস্থ্যও খারাপ হতে থাকে। এই প্রথম তিনি অনুভব করলেন, সত্যিসত্যি মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে। অপরিমিত মদ্যপান করে মৃত্যুকে তিনি তরান্বিত করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু মৃত্যুর পদধ্বনি শুনে, বিশেষ করে সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে, তিনি ব্যাকুল হয়েযান। এতো আদরের দুই পুত্র এক কালে বিলাসিতার মধ্যে মানুষ হয়ে শেষে কি অনাহারে মারা যাবে, অথবা ভিক্ষে করবে অন্যের দ্বারে? আর বয়ঃসন্ধিতে উপনীতা আদরের কন্যা শর্মিষ্ঠার বা কি উপায় হবে? কন্যার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে হেনরিয়েটাও শিউরে ওঠেন। পরিস্থিতিতে কবি মরিয়া হয়ে বালিকা কন্যার বিয়ে ঠিক করেন। মে মাসের ৭ তারিখে মাত্র ১৩ বছর ৭ মাস ২২ দিন বয়সে একটি প্রতিশ্রুতিতে ভরা কিশোরীর বিয়ে হলো তার ঠিক দ্বিগুণ বয়সী একটি সামান্য-শিক্ষিত অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান যুবকের সাথে। বর এবং কনের বয়সের পার্থক্য বিবেচনা করেই বোধ হয় বিয়ের দলিলে পাত্রের বয়স লেখা হয়নি। শর্মিষ্ঠার বিয়ের ঠিক পর ভাঙ্গা মন আর অক্ষম দেহ নিয়ে সপরিবারে যানকলকাতার উত্তরপাড়ায়। চার বছর আগে যেখানে উঠেছিলেন, এবারেও উঠলেন সেই একই জায়গায় লাইব্রেরির ওপর তলায়।২ কিন্তু সেবার আর এবারের মধ্যে কতো পার্থক্য! সেবারে চোখে ছিলো অফুরন্ত স্বপ্ন! এবারে চোখে কেবল মৃত্যুপথযাত্রীর অন্তহীন হতাশার নিষ্প্রভ আলো। উত্তরপাড়ায় তাঁর আশ্রয়দাতাদের অন্যতম রাসবিহারী মুখোপাধ্যায়। কবি সেখানে ছিলেন ছয় সপ্তাহ।উত্তরপাড়ায় কবির কার্যকলাপের যে-বিবরণ পাওয়া যায়, তাতে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, তাঁর সেখানে না-গিয়েপ্রথমেই যাওয়া উচিত ছিলো আলিপুরের জেনারেল হসপিটালে। কারণ এ সময়ে তিনি এবং হেনরিয়েটা উভয়ই খুব অসুস্থ ছিলেন। ওই বছরের গোড়ার দিকে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে গৌরদাস বসাক বদলি হয়ে এসেছিলেন হাওড়ায়। তিনি এ সময়ে একাধিক বার উত্তরপাড়ায় গিয়ে মাইকেলকে দেখে আসেন। শেষ বার সেখানে তিনি যে-দৃশ্য দেখতে পান, স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি তার বিবরণ দিয়েছেন: ‘মধুকে দেখতে যখন শেষ বার উত্তরপাড়া সাধারণ পাঠাগারের কক্ষে যাই, তখন আমি যে-মর্মস্পর্শী দৃশ্য দেখতে পাই, তা কখনো ভুলতে পারবো না। সে সেখানে গিয়েছিলো হাওয়া বদল করতে। সে তখন বিছানায় তার রোগযন্ত্রণায় হাঁপাচ্ছিলো। মুখ দিয়ে রক্ত চুইয়ে পড়ছিলো। আর তার স্ত্রী তখন দারুণ জ্বরে মেঝেতে পড়েছিলো। আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখে মধু একটুখানি উঠে বসলো। কেঁদে ফেললো তারপর। তার স্ত্রীর করুণ অবস্থা তার পৌরুষকে আহত করেছিলো। তার নিজের কষ্ট এবং বেদনা সে তোয়াক্কা করেনি। আমি নুয়ে তার স্ত্রীর নাড়ী এবং কপালে হাত দিয়ে তাঁর উত্তাপ দেখলাম। তিনি তাঁর আঙুল দিয়ে তাঁর স্বামীকে দেখিয়ে দিলেন। তারপর গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে নিম্নকণ্ঠে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। বললেন: “আমাকে দেখতেহবে না, ওঁকে দেখুন, ওঁর পরিচর্যা করুন। মৃত্যুকে আমি পরোয়া করিনে।’৩ বাল্যবন্ধুর অন্তিম দশা দেখে গৌরদাস স্বভাবতই বিচলিত বোধ করেন।
তিনি যে তাঁর জন্যে বেশি কিছু করতে পারতেন, তা নয়। তবু তিনি তাঁকে অবিলম্বে কলকাতায় নিয়ে যেতে চাইলেন। শুনলেন, পরের দিন ২০/২১ জুন (১৮৭৩) তারিখে কলকাতায় ফেরার ব্যবস্থা মধু নিজেই করে রেখেছেন। পরিবার নিয়ে কবি বজরায় করে পরের দিন কলকাতা যাত্রা করলেন। হেনরিয়েটাকে ওঠানো হলো তাঁর জামাতা উইলিয়াম ওয়াল্টার এভান্স ফ্লয়েডের বাড়িতে, ইংরেজ আর অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান পাড়ায় ১১ নম্বর লিন্ডসে স্ট্রীটে। আর কবির নিজের ওঠার মতো কোনো জায়গা ছিলো না। উত্তরপাড়ায় যাবার আগেই তিনি তাঁর এন্টালির বাড়ি ছেড়ে দিয়েছিলেন বলে মনে হয়। উঠলেন গিয়ে আলিপুরের জেনারেল হসপিটালে। মনোমোহন ঘোষ এবং উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় কিছু তদবির করাতে এবং তাঁর নিজের সাহেবী পরিচয়ের দরুন তিনি এ হাসপাতালে শেষ কটা দিন কাটানোর অনুমতি পান।
নগেন্দ্রনাথ সোম লিখেছেন যে, হাসপাতালে আসার পর প্রথম দিকে শুশূষা এবং ওষুধপত্রের দরুন তাঁর রোগ লক্ষণের খানিকটা উপশম হয়েছিলো।তবে অচিরেই তাঁর স্বাস্থ্য দ্রুত অবনতির দিকে যায়। যকৃৎ, প্লীহা এবং গলার অসুখে তাঁর দেহ অনেক দিন আগেই জীর্ণ হয়েছিল। কিন্তু যখন হাসপাতালে ভর্তি হন তখন যকৃতের সিরোসিস থেকে দেখা দিয়েছিলো উদরী রোগ। হৃদরোগও ছিল তাঁর।মারা যাচ্ছেন শুনে আলিপুরের হাসপাতালে মনোমোহন ঘোষ, উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সূর্য গুডিব চক্রবর্তী এবং কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ অনেকে এসেছিলেন তাঁকে দেখার জন্যে। তাঁর চরম দুরবস্থার খবর শুনেও এতো দিন যাঁরা খোঁজখবর নিতে পারেননি, তাঁদেরও অনেকে। রক্তের আত্মীয়তা সত্ত্বেও যাঁরা একদিন তাঁকে ত্যাগ করেছিলেন, এ সময়ে তাঁদের মনেও করুণা দেখা দিয়েছিলো। শেষ কদিন তাঁকে যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের স্মৃতিচারণ থেকে মনে হয়, মারা যাচ্ছেনএ কথা কবি ভালো করে অনুভব করতে পেরেছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও মাঝেমধ্যে তিনি ভালো হয়েউঠবেন বলে স্বপ্ন দেখতেন। কল্পনা করতে ভালোবাসতেন বলে একেবারে অন্তিম দশায় পৌঁছেও যা অনিবার্য তাকে সহজে স্বীকার করে নিতে পারেননি। হাসপাতালে তাঁর সঙ্গে একদিন দেখা করতে এসেছিলেন মনিরুদ্দীন। তাঁর এক সময়ের মুন্সি। সেই সুবাদে কবির কাছে তাঁর ৪শ’ টাকা পাওনা ছিল।কবি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, তাঁর কাছে কোন টাকা পয়সা আছে কিনা। শুনলেন, আছে দেড় টাকা। সেই পয়সাই তিনি চাইলেন তাঁর কাছে। তারপর তা বকশিশ হিসেবে দান করলেন তাঁর শুশ্রƒষাকারিণী নার্সকে। কেউ কেউ বলেন, টাকা তিনি চেয়েছিলেনমনোমোহন ঘোষের কাছে। কিন্তু যাঁর কাছেই টাকা চেয়ে থাকুন না কেন, ধার করে বকশিশ দেবার এই আচরণ সঙ্গতিপূর্ণ তাঁর সারা জীবনের আচরণের সঙ্গে।
হাসপাতালে তিনি ছিলেন সাত অথবা আট দিন। এ সময়ে তিনি কিছু সেবাযত্ন পেলেও, খুব মানসিক শান্তিতে ছিলেন বলে মনে করার কারণ নেই। পরিবার সম্পর্কে তাঁর দুশ্চিন্তা এবং হেনরিয়েটার স্বাস্থ্য সম্পর্কে তাঁর উদ্বেগ তাঁকে নিঃসন্দেহে খুব বিচলিত করেছিলো। এরই মধ্যে ২৬ জুন (১৮৭৩) তারিখে এক পুরোনো কর্মচারীর কাছে খবর পেলেন হেনরিয়েটা শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন। ৫তাঁর বয়স হয়েছিলো মাত্র ৩৭ বছর ৩ মাস ১৭ দিন। বয়ঃসন্ধিকালে মা মারা যাবার পর থেকে সুখের মুখ তিনি কমই দেখেছিলেন। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব এবং পরিচিত পরিবেশ ত্যাগ করে তিনি মাদ্রাস থেকে কলকাতায় এসেছিলেন মাইকেলের ভালোবাসার টানে। চার্চে গিয়ে সেই ভালোবাসার কোনো স্বীকৃতি পর্যন্ত তিনি আদায় করতে পারেননি। বস্তুত, জীবনকে উপভোগ করার জন্যে তিনি যদি কবিকে জীবনসঙ্গী হিশেবে বরণ করে থাকেন, তা হলে মস্তো একটা ভুল করেছিলেন। তিনি অনেক দিন থেকে মুমূর্ষু ছিলেন। সুতরাং তাঁর মৃত্যুসংবাদ কবির কাছে খুব অপ্রত্যাশিত ছিলো না। তবু কবি ব্যাকুল হয়ে বলেছিলেন: বিধাতঃ, তুমি একই সঙ্গে আমাদের দু’জনকে নিলে না কেন? হেনরিয়েটার ভালোবাসা এবং নীরব ত্যাগের কথা অন্য সবার চেয়ে তিনিই ভালে করে জানতেন। সুতরাং যতো অনিবার্য হোক না কেন, হেনরিয়েটার প্রয়াণে মৃত্যুপথযাত্রী কবি মর্মাহত এবং বিষন্ন হয়েছিলেন। এর ফলে তাঁর অসহায় যন্ত্রণা আরও তীব্র হয়ে ওঠে। তিনি খুব উৎকণ্ঠিত হয়েছিলেন হেনরিয়েটার শেষকৃত্যের ব্যাপারে। এর জন্যে যে-অর্থ লাগবে, তা কোথা থেকে আসবে? তাঁর তো কোনো সঞ্চয় নেই! কে আছে তাঁর, এই গুরু দায়িত্ব যে কাঁধে নেবে?এই দিন মনোমোহন ঘোষ আসেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। কবি তাঁকে প্রথমেই জিজ্ঞেস করেন, ঠিকমতো অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হয়েছে কিনা। মনোমোহন তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে জানান, সবই যথারীতি হয়েছে। জিজ্ঞেস করেন, বিদ্যাসাগর এবং যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর এসেছিলেন কিনা। মনোমোহন তাঁকে এই বলে সান্তনা দেন যে, এঁদের খবর দেওয়া সম্ভব হয়নি। মনোমোহন নিজে দশ বছর ধরে হেনরিয়েটকে চিনতেন। ইউরোপে থাকার সময়ে তাঁর কাছ থেকে অনেক সেবাযত্নও পেয়েছেন। সে জন্যে হেনরিয়েটার শেষকৃত্যের আয়োজন করাকে তিনি একটা নৈতিক দায়িত্ব বলে বিবেচনা করতেন। প্রবাসে উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও মাইকেল- পরিবারের ঘনিষ্ঠতা হয়েছিলো। শেষ অবস্থায় তিনিও কবির প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে কার্পণ্য করেননি। উত্তরপায়ায় গিয়ে তিনি তাঁকে দেখে এসেছিলেন। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত কবির আর-একটা প্রধান উদ্বেগের কারণ ছিল তাঁর দুই পুত্রের ভবিষ্যৎ। একটির বয়স বারো, অন্যটির ছয়। মনোমোহন এবং উমেশচন্দ্র সে সম্পর্কেও কবিকে আন্তরিকভাবে আশ্বাস দিয়েছিলেন। মনোমোহন বলেছিলেন, তাঁর সন্তানরা খেতে-পরতে পারলে কবির পুত্ররাও পারবে। এ প্রতিশ্রুতি মনোমোহন পরে যথাসম্ভব পালনও করেছিলেন।
৬ ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনের প্রতি তাঁর কোনো আগ্রহ ছিলো না। জীবনের এই একেবারে শেষ মুহূর্তে তিনি এই আস্থার অভাব আর একবার প্রমাণ করেন। তবে রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং লন্ডন মিশনারি সোসাইটির রেভারেন্ড চন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় কবির পারলৌকিক মঙ্গল নিয়ে আপাতদৃষ্টিতে কবির চেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন ছিলেন। তাঁরা, বিশেষ করে চন্দ্রনাথ, তাঁকে এ সময়ে বার বার নাকি পরম ত্রাতা যীশু খৃষ্টের কথা মনে করিয়ে দেন। পারলৌকিক মঙ্গলের ব্যাপারে তাঁদের এই উৎকণ্ঠা দিয়ে নিজেদের অজ্ঞাতে তাঁরা কবির প্রতি যথেষ্ট নিষ্ঠুরতা করেন বলেই মনে হয়। ২৮ জুন সমস্ত আশা-ভরসাহীন, রোগ- কাতর, বিষন্ন কবি যখন মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করে আছেন, তেমন সময়ে কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় এলেন খ্রিস্টান ধর্ম অনুযায়ী তাঁর শেষ স্বীকারোক্তি আদায় করতে। তিনি কোন কোন পাপের কথা স্বীকার করে বিধাতার কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন, কেউ তা জানেন না। জীবনকে যিনি যদ্দুর সম্ভব উপভোগ করতে চেয়েছিলেন, আসন্ন মৃত্যুর কথা ভেবে সেই কবি কতোটা আকুল হয়েছেন তাও আমাদের অজানা। কিন্তু কৃষ্ণমোহন এবং চন্দ্রনাথ যখন তাঁকে জানান যে, তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া এবং তাঁকে কোথায় সমাধিস্থ করা হবে, তা নিয়ে গোলযোগ দেখা দিতে পারে, তখন কবি যে-নির্ভীক উত্তর দিয়েছিলেন, তা আমাদের জানা আছে। তিনি বলেছিলেন: মানুষের তৈরি চার্চের আমি ধার ধারিনে। আমি আমার স্রষ্টার কাছে ফিরে যাচ্ছি। তিনিই আমাকে তাঁর সর্বোত্তম বিশ্রাম-স্থলে লুকিয়ে রাখবেন। আপনারা যেখানে খুশি আমাকে সমাধিস্থ করতে পারেন-আপনাদের দরজার সামনে অথবা কোনো গাছ তলায়। আমার কঙ্কালগুলোর শান্তি কেউ যেন ভঙ্গ না-করে। আমার কবরের ওপর যেন গজিয়ে ওঠে সবুজ ঘাস।
৭ কৃষ্ণমোহন এবং চন্দ্রনাথের আশঙ্কা অমূলক ছিল, তা নয়। কিন্তু এই সমস্যার সমাধান করা কবির পক্ষে সম্ভব ছিল না।২৯ জুন রোববার মাইকেলের অন্তিম অবস্থা ঘনিয়ে এলো। তাঁর হিতাকাঙ্খী এবং সন্তানরা এলেন তাঁকে শেষ বারের মতো দেখতে। এমন কি, জ্ঞাতিদেরও একজন এসেছিলেন তাঁকে দেখতে। জীবনের শেষ দু’বছর তাঁর নিদারুণ দুর্দশায় সহায়তার হাত প্রসারিত না-করলেও, শেষ মুহূর্তে মৃত্যুপথযাত্রীকে দেখে অনেকেই করুণায় বিগলিত হয়েছিলেন। কিন্তু বিশ্রামহীন এবং রোগজীর্ণ দেহ কবি আর ধরে রাখতে পারছিলেন না। বেলা দুটোর সময়ে তিনি ঘুমিয়ে পড়েন চিরদিনের জন্যে।
কৃষ্ণমোহনদের আশঙ্কা অমূলক ছিলো না। তাঁর মৃত্যুর পর সত্যি সত্যি তাঁর শেষকৃত্য নিয়ে সমস্যা দেখা দিলো। কলকাতার খ্রিস্টান সমাজ তাঁর দীক্ষার ঘটনা নিয়ে ঠিক তিরিশ বছর আগে একদিন মহা হৈচৈ করলেও, মৃত্যুর পর তাঁকে মাত্র ছয় ফুট জায়গা ছেড়ে দিতেও রাজি হলো না।ইংলিশম্যানের মতো পত্রিকাগুলো তাঁর মৃত্যুর খবর পর্যন্ত ছাপলো না।মিশনারিদের কাগজ ‘ফ্রেন্ড অব ইন্ডিয়া’য় তাঁর মৃত্যুর খবর খুব সংক্ষেপে প্রকাশিত হয়। কিন্তু তাঁর কবি-কৃতি নয়, বিশেষ করে যা এ পত্রিকার নজরে পড়লো, তা হলো তাঁর জীবন যাপনের অভ্যাসগুলো ছিলো অনিয়মে ভরা আর তিনি তাঁর পৈতৃক সম্পত্তি উড়িয়ে দিয়েছিলেন। এ ছাড়া আর-একটি প্রসঙ্গ এ পত্রিকায় উল্লিখিত হয়েছিলো। তিনি তাঁর তিনটি সন্তানের জন্যে কিছু রেখে যেতে পারেননি।তাঁর প্রতি খ্রিস্টান সমাজ যে-মনোভাব দেখায়, তা অসাধারণ। বস্তুত, মৃত্যুর পরে মৃতের প্রতি এ রকমের রোষের ঘটনাখুব কম দেখা যায়। কবি-সাহিত্যিকদের বেশির ভাগ তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় আসেননি।কিন্তু ফরাসি সমাজ তাঁর মৃতদেহ সৎকারে বাধা দেবার এমন অসাধারণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেনি। দারুণ গ্রীষ্মের সময়ে তাঁর মৃত্যু হলেও, খ্রিস্টান সমাজের সৃষ্টি ছাড়া আক্রোশের দরুন সেদিন এবং সেদিন রাতে তাঁর মরদেহ পড়ে থাকলো দুর্গন্ধ-ভরা নোংরা মর্গে। কৃষ্ণমোহন ছিলেন কলকাতার ধর্মযাজকদের মধ্যে একজন প্রবীণ সদস্য, যদিও তিনি এর অনেক বছর আগে থেকেই সরাসরি ধর্মযাজকের কাজ ছেড়ে দিয়ে বিশপস কলেজে অধ্যাপনা করেছিলেন। মাইকেল মারা যাবার আগে অধ্যাপনা থেকেও তিনি অবসর নিয়েছিলেন। তিনি নিজে গিয়ে এ ব্যাপারে তদবির করলেন লর্ড বিশপ রবার্ট মিলম্যানের (১৮১৬-৭৬) কাছে। মিলম্যান এর ছয় বছর আগে বিশপ হয়ে কলকাতায় আসেন। দেশীয়দের সঙ্গে তাঁর বেশ ভালো সম্পর্ক ছিলো। তিনি বাংলাসহ বেশ কয়েকটি দেশীয় ভাষাও শেখেন। কিন্তু চার্চ প্রশাসন সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে তিনি আর্চবিশপসহ অনেকের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন। তা ছাড়া, তিনি তাঁর ধর্মযাজকদের কোনো বিতর্কিত বিষয়ে যোগ দানে বাধা দিতেন। সুতরাং তিনি নিজে দুই খন্ডে মাইকেলের প্রিয় কবি ত্যাসোর জীবনী লিখলেও (১৮৫০), পরের দিন সকালেও বিতর্কিত কবির মৃতদেহ খ্রিষ্টানদের গোরস্থানে সমাহিত করার অনুমতি দিলেন না। ওদিকে, তাঁর স্বদেশবাসী তাঁকে গঙ্গার ঘাটে পোড়াবেন তিনি তার পথ নিজেই রুদ্ধ করে গিয়েছিলেন। সুতরাং আষাঢ় মাসের ভেপসা গরমের মধ্যে তাঁর অসহায় মরদেহ মর্গেই পচতে থাকে। তখন সাহস নিয়ে এগিয়ে আসেন একজন ব্যাপটিস্ট ধর্মযাজক। তিনি কবির মরদেহ সমাধিস্থ করার সংকল্প প্রকাশ করেন। প্রায় একই সময়ে অ্যাংলিকান চার্চের একজন সিনিয়র চ্যাপলেইন রেভারেন্ড পিটার জন জার্বোও বিশপের অনুমতি ছাড়াই তাঁর দেহ সামাধিস্থ করার উদ্যোগ নেন। ডক্টর জার্বো ছিলেন ৮৪ নম্বর লোয়ার সার্কুলার রোডে অবস্থিত সেইন্ট জেমসেস চার্চেরপ্রধান পাদ্রী। ১৮৬০ সালের জুলাই মাসে তিনি এই চার্চে তাঁর ধর্মযাজকের জীবন শুরু করেছিলেন। লর্ড বিশপের অপ্রসন্নতা পরোয়া না-করে তাঁর মৃতদেহ সৎকার করতে চেয়ে এই প্রবীণ এবং উচ্চশিক্ষিত ধর্মযাজক অসাধারণ সাহস দেখিয়েছিলেন। ৩০ জুন বিকেলে-মৃত্যুর ২৪ ঘণ্টারও পরে কবির মরাদেহ নিয়ে তার ভক্ত এবং বন্ধু বান্ধবসহ প্রায় হাজার খানেক লোক এগিয়ে যান লোয়ার সার্কুলার রোডের গোরস্থানের দিকে। সেকালের বিবেচনায় এই সংখ্যা কম নয়। বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্যে কলকাতার বাইরে থেকেও অনেক লোক এসেছিলেন বলে জানা যায়। নানা ধর্মের এবং বর্ণের লোক ছিলেন এঁদের মধ্যে। তবে একদিন শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসার নিদর্শন- স্বরূপ নিজের গ্রন্থ উৎসর্গ করে কবি যাঁদের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিখ্যাত করেছিলেন, তাঁদের কেউ এই ভিড়ের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন না। লোয়ার সার্কুলার রোডের গোরস্থানে এর চার দিন আগে হেনরিয়েটাকে সমাধিস্থ করা হয়েছিলো। কবির জন্যে কবর খোড়া হয় তাঁর কবরের পাশে। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া যখন নিশ্চিতভাবে হতে যাচ্ছে, মোটামুটি তেমন সময় লর্ড বিশপের অনুমতি এলো। কিন্তু অ্যাংলিকান চার্চের অন্য কোনো পাদ্রী অথবা নাম-করা ধর্মীয় নেতা তাঁর শেষকৃত্যে এসেছিলেন বলে জানা যায় না। কৃষ্ণমোহনও নন। অনেক পাদ্রী বরং তাঁদের অসন্তোষ প্রকাশ করতে থাকেন। ডক্টর জার্বোই তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সমাধা করেন। গেরাস্থানের রেজিস্টারেতাঁর নাম লেখা হলেও, অ্যাংলিকান চার্চেরব্যুরিয়াল রেজিস্টারে তাঁর নাম পর্যন্ত উঠলো না। (লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে যে-চার্চের কাগজপত্র আছে, তাতে কবিকে অথবা হেনরিয়টাকে সমাধিস্থ করার কোনো তথ্য নেই।) কিন্তু তাঁর ব্যাপটিজমের তথ্য এই রেজিস্টারেআছে।সেকালের দেশীয় সমাজে তাঁর চারদিকে যাঁরা বাস করতেন, তাঁদের তুলনায় তিনি ছিলেন অনেক প্রতিভাবান। জনারণ্যে সবাইকে ছাড়িয়ে তাঁকে চোখে পড়ার মতো গুণাবলী তিনি প্রচুর পরিমাণে আয়ত্ত করেছিলেন। বাংলা সাহিত্যকে তিনি একা যতোটা এগিয়ে দিয়েছিলেন, পরবর্তী কালে রবীন্দ্রনাথ ছাড়া অন্য কেউ তা করেননি। বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্ব হিসেবেও তিনি জীবদ্দশাতেই কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছিলেন। জীবনের শেষ দুতিন বছরে তিনি ঈর্ষার অযোগ্য যে-করুণ পরিণতি লাভ করেছিলেন এবং তাঁকে সমাধিস্থ করার ঘটনা নিয়ে যে-কুৎসিত নোংরামি দেখা দিয়েছিলো, তা থেকে তাঁর নিঃসঙ্গতার অভ্রান্তপ্রমাণ যাওয়া যায়। আগেই বলেছি, নিজের সমাজ থেকে নিজেকে তিনি পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করেছিলেন। তাঁর অসামান্য প্রতিভা এবং আকাশচুম্বী আত্মবিশ্বাস তাঁকে যে সীমাহীন অহঙ্কার দিয়েছিলো, তাও তাঁর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার অন্যতম কারণ। বিত্ত দিয়ে গত শতাব্দীতে অনেকেই জাতে উঠেছেন, সামাজিক মর্যাদা লাভ করেছেন। যতোদিন মাইকেল সচ্ছল ছিলেন, ভোজ দিতেন, মদ্যপান করাতেন, বিনে পয়সায় মামলা করে দিতেন, ততোদিন দেশীয় সমাজে তাঁকে খাতির করার লোকের অভাব হয়নি। কিন্তু তিনি যখন নিঃস্ব রিক্ত হয়েমৃত্যুর দিন গুনেছেন, তখন খুব কম লোকই তাঁর খবর নিয়েছেন। তিনি যদি অনেক সঞ্চিত অর্থ রেখে মারা যেতেন, তা হলে সমাধিস্থ করার ব্যাপারে সম্ভবত এতোটা বিরোধিতা দেখা দিতো না।
নিঃসন্দেহে মাইকেল মধুসূদন দত্ত ছিলেন তাঁর সময়ের সবচেয়ে বড় কবি। এমন কি, এক শতাব্দীর ব্যবধানে আজও কবি হিসেবে তাঁর প্রতিষ্ঠা কিছু হ্রাস পেয়েছে বলে মনে হয় না । কিন্তু তা সত্ত্বেও, মৃত্যুর ঠিক আগে এবং পরে তাঁর প্রতি বাঙালি সমাজ অবিমিশ্রপ্রশংসা অথবা প্রীতি প্রদর্শন করেনি।
তথ্যনির্দেশ:
১. বাঙালিদের মধ্যে প্রথম ব্যারিষ্টার হন জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুর, ১৮৬২ সালে, মাইকেল বিলেত যাত্রা করার দুইদিন পর। তবে তিরি কেবল ব্যারিষ্টারি পড়ার উদ্দেশ্য নিয়ে বিলেত যাননি। তিনি লিঙ্কন্স ইনে ভর্তি হন ১৮৫৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর। ব্যারিষ্টার হবার পর প্রথমে তিনি কিছুকাল লন্ডনে প্র্যাক্টিস করেন। তারপর কলকাতা হাই কোর্টে ব্যারিষ্টার হিসাবে প্র্যাক্টিস করার অনুমতি লাভ করেন ১৮৬৫ সালের ২৮ নভেম্বর।
২. মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত-পৃষ্ঠা-৪২১
৩. গৌরদাস বসাকের স্মৃতিচারণ, মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত, পৃষ্ঠা ৪৬৪
৪. মাইকেল মধুসূদন দত্ত: জীবন ও সাহিত্য, নগেন্দ্রনাথ সোম, পৃষ্ঠা ২৬৪
৫. মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত, পৃষ্ঠা ৪২৭
৬. মধু স্মৃতি, নগেন্দ্রনাথ সোম, পৃষ্ঠা ২৬২
৭. ঐ পৃষ্ঠা ২৬৯