বিশেষ প্রতিনিধি
বিশাল একটা বট এবং পাকুড় গাছ জড়াজড়ি করে বেড়ে উঠেছে। আর এদের ভেতর মাথা উঁকি দিয়ে আকাশছোঁয়ার চেষ্টা করছে গাবগাছ! এই গাছের গোড়া থেকে শুরু করে আশপাশের প্রায় ১০ একর জায়গাজুড়ে ধলগাঁ (ধলগ্রাম) বাজার। লোকমুখে প্রচার আছে, দেড়শ’ বছরের অধিক সময়কাল ধরে চলে আসছে এই ধলগাঁর হাট।
যশোর শহর থেকে প্রায় ৩০ কিমি পূর্ব-পশ্চিমে বাঘারপাড়া উপজেলার ধলগ্রাম ইউনিয়নের ধলগ্রাম বাজার। এই বাজারের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে চিত্রা নদী। নদীর এই বাজারের প্রধান অংশে রয়েছে একটি ঘাট। যে ঘাটে ভেড়ে নৌকা, ট্রলার। হাটে আসা লোকজন ব্যবহার করেন বহু পুরনো এই ঘাটটি।
কথিত আছে, মাদারীপুর, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ প্রভৃতি জেলার কারবারিরা এই হাটে আসতেন বজরা নৌকা নিয়ে। এক একটি নৌকায় তারা একশ’ থেকে পাঁচশ’ মণ ধান বা পাট খরিদ করে নিয়ে যেতেন। নদীর ঘাটে বাঁধা থাকতো শ’য়ে শ’য়ে নৌকা।
স্থানীয় লোকজন জানান, সপ্তাহের দুইদিন ধলগাঁর হাট, অন্যদিনগুলোতে নিয়মিত বাজার বসে। বাঘারপাড়া উপজেলা শহর থেকেও লোকজন বাজার করতে এই হাটে আসেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
এই হাটে কথা হয় নদীর ওপারের বাসিন্দা কৃষক শহিদুল ইসলামের (৭২) সঙ্গে। ধলগাঁর হাটের স্মৃতি হাতড়ে তিনি বলেন, পাকিস্তান আমলে আব্বার ছিকেবাঁকের (এটি হচ্ছে বাঁশের তৈরি, দুইপাশে ঝুঁড়িতে মালামাল কাঁধে ঝুলিয়ে লোকজন মালামাল পরিবহন করে) ডালায় বসে হাটে আসতাম। ধান বিক্রি করে আব্বা বাজার-সদাই করতেন। আর আমাকে কিনে দিতেন রসগোল্লা, জিলাপি, বাতাসা বা দানাদারের মতো মিষ্টি। কখনো সখনো সেই সময়কার বিখ্যাত নিমতলার ভাজা কিনে দিতেন শালপাতায় মোড়া।
তিনি জানান, বাবা-দাদাদের কাছে শুনেছি এই হাটে অনেক দূর থেকে লোকজন আসতো। তারা মূলত এখানকার পাট ও ধান কেনার জন্যে বড় বড় নৌকা নিয়ে ঘাটে দুই একদিন থাকতো।
দশপাখিয়া গ্রামের বাসিন্দা শতবর্ষী (!) মোসলেম মুন্সী চোখে খুব একটা ভালো দেখেন না। শ্রবণশক্তি প্রবল। এই বয়সেও তিনি এসেছেন হাটে। হাট থেকে পান ও তামাক কিনবেন বলে। বাবা মিরাজ খাঁর সঙ্গে ৮-১০ বছর বয়স থেকেই আসেন এই হাটে। বাবার নামে খাঁ আর তার নামের শেষে মুন্সী কেন-বললেন, আমি হাফেজ পাস, মাওলানা। সেই কারণে লোকে আমাকে মুন্সী উপাধী দেয়।
মোসলেম মুন্সীর ঘরে অসুস্থ স্ত্রী, দেখভাল করার জন্যে ছোট মেয়ে (বিধবা) রয়েছেন। তাই হাটে এসেছেন টুকটাক বাজারও করবেন। এই বাজারের সবাই তাকে চেনে- বলেন তিনি। সবাই দেখিয়ে দেয়, ভ্যানে উঠিয়ে দেয় বাড়ি যাবার জন্য।
তিনি বলেন, খুব ছোটকাল থেকে দেখেছি-এখানকার হাটে বাইরের জেলার লোক আসতো পাট, ধান আর গুড় কিনতে। ঘাটে দেখতাম শয়ে শয়ে নৌকা বাঁধা। সেই সময় অবশ্য এতো দোকানঘর ছিল না।
আন্দোলবাড়িয়া গ্রামের পুলিন বিশ্বাস (৭৫) এসেছেন বাজার করতে। তিনি সবজি আর মাছ কিনবেন। তিনিও জানান, বাবা-ঠাকুরদারাও এই বাজারে আসতেন। বহু বছর ধরে এখানে হাট চলে আসছে।
প্রায় ৫০ বছর ধরে এই ধলগাঁর হাটে নিয়মিত পসরা সাজিয়ে বসেন চম্পক কুণ্ডু (৬৫)। তিনি বলেন, সপ্তাহের দুইদিন নিয়মিত আসি। গরম মসলা, জিরা, হলুদ, ডাল, লবণ, সরিষার তেল, সয়াবিন তেল, শুকনা মরিচ ইত্যাদি বিক্রি করি। সাধারণত ঘানিভাঙা সরিষার তেল বিক্রি করি। প্রতি হাটে কমপক্ষে ১০ কেজি সরিষার তেল বিক্রি হয়।
তিনি জানান, খুব ছোটবেলায় বাবার কাঁধে চড়ে আসতেন হাটে। দু’ পয়সার ভাজা, বিস্কুট কিংবা মিষ্টি- সন্দেশ পদ্মপাতায় মুড়ে দিতো দোকানিরা। সেই দুই চার পয়সার মিষ্টি খেয়ে উঠা দুষ্কর ছিল।
বল্লারমুখ গ্রামের বাসিন্দা বাসুদেব কুমার দে (৬৬) হাটের দিন ধলগাঁ বাজারে তার পৈতৃক দোকানের বারান্দায় বসেন পসরা সাজিয়ে। অন্যদিনগুলো মালামাল থাকে দোকানের ভেতরে। তিনি তামাক পাতা, জর্দা ও খাবারের মসলা এবং বিভিন্ন ধরনের রশি বিক্রি করেন।
তিনি বলেন, ৫০ বছরের অধিক সময় ধরে আমি এখানে ব্যবসা করছি। তারও আগে বাবার সঙ্গে আসতাম। ১৯৭৯ সালে নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে ইন্টারমিডিয়েট পাস করি। সেইসময় সোনালী ব্যাঙ্কে আইও পদে চাকরি হয়। কিন্তু দশ হাজার টাকা ঘুষ দিতে পারিনি বলে চাকরি করা হয়নি। দারিদ্র্যের কারণে নিজের পড়াশুনা না এগোলেও তিন মেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন বাসুদেব দে।
কথা হয় ধলগ্রাম বাজার বণিক সমিতির সভাপতি ওসমান সরদারের সঙ্গে। তিনি বলেন, পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে শুনেছি এই হাটের কথা। দেড় থেকে দুইশ’ বছরের পুরনো তো হবেই। একসময় এই হাটটি বিখ্যাত ছিল পাট ও ধানের জন্যে। আমরা দেখেছি ধলগাঁ বাজারের ঘাটে বড় বড় নৌকা থাকতো পাট ও ধান কিনে নেয়ার জন্যে।
তিনি বলেন, সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে এখানে প্রায় ১০ একর জায়গায় দোকানপাট ও হাট বসে। প্রায় সাড়ে তিনশ’ স্থায়ী দোকান রয়েছে। মৌসুমে এই বাজারে হাটের পরদিন কমপক্ষে ১০-১২ ট্রাক পাট আর ৮-১০ ট্রাক ধান লোড হয়ে থাকে। অন্য সময় গড়ে এক বা দুই ট্রাক মাল লোড হয়। পাট প্রতিটি ট্রাকে আড়াইশ থেকে তিনশ মণ এবং ধান ৫০০ মণ লোড করা হয়।
যেহেতু অনেক ব্যাপারী এখনও নৌপথ ব্যবহার করেন এবং তারা এখানে গোসলও করেন- সেকারণে ভেঙে যাওয়া ঘাটটি দ্রুততম সময়ের মধ্যে নতুন করে বানানোর আহ্বান জানান তিনি।
যোগাযোগ করা হলে ধলগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম বলেন, আমাদের এই ধলগাঁ বাজার ঐতিহ্যবাহী ও সুপ্রাচীন। বাবা-দাদাদের কাছে শুনেছি, তারাও বহুকাল ধরে এই হাটে বিকিকিনি করেছেন। নদীর ঘাট উন্নয়নে কাজ করার ইচ্ছে আছে বলে তিনি জানান।