হাসান আদিত্য
ঘড়ির কাটা তখন বেলা ১২ টা। যশোর পুলিশ লাইন্সের প্রধান ফটকের সামনে অভিভাবকদের জটলা। সেখানে বাবাকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করছেন লিজা খাতুন। বাবাও মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে গুমরে কাঁদছেন আর গায়ে থাকা চাঁদর দিয়ে চোখের জল মুছছেন। বাবা মেয়ের এমন আবেগাপ¬ুত হওয়ার কারণ মেয়ের পুলিশে চাকরি হয়েছে। সকল পরীক্ষা উতরে পুলিশ সুপারের কাছ থেকে নিয়োগপত্র নিয়ে পুলিশ লাইন্সের বাইরে অপেক্ষা করা বাবাকে জড়িয়ে ধরে আনন্দাশ্রুতে সিক্ত হন লিজা।
লিজা বলেন, ‘আমার বাবা ভ্যানচালক। অনেক কষ্ট করে আমারে মানুষ করেছে। অনলাইনে আবেদন করেছি। এরপরে মাঠে এসেছি, শারীরিক, লিখিত, মৌখিক পরীক্ষা দিয়েছি। এর মধ্যে কারও সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করিনি। আমার কাছে এই চাকরিটা এখনও স্বপ্নের মতো লাগছে। কান্নাজড়িত কন্ঠে তিনি বলেন, বাবার মাথার চুল দাড়ি সাদা হয়েছে, শরীরে বয়সের ভার দৃশ্যমান। এখন বাবাকে বলতে পারবো, ‘বাবা তোমার আর ভ্যান চালাতে হবে না; তোমার দায়িত্ব এখন থেকে আমার।’
শুধু লিজা নয়; তার মতো চাকরি পাওয়া ৮১ জন মধ্যবিত্ত এবং দরিদ্র পরিবারের সন্তানেরা পুলিশে চাকরি পাওয়াতে একদিকে যেমন উচ্ছ্বসিত; অন্যদিকে আবেগাপ¬ুতও। মাত্র ১২০ টাকা খরচ করেই পুলিশে চাকরি পাওয়ায় চোখে নেমে এসেছে আনন্দধারা। আবেগ ধরে রাখতে না পেরে পুলিশ লাইন্সের প্রধান ফটকে কেঁদেছেন চাকরি প্রার্থীসহ অভিভাবকেরা। এ সময় তারা এ নিয়োগে সরকার ও পুলিশ বিভাগের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন তারা। স্বজনেরা জানান, পুলিশে নিয়োগ পেতে Oসুদিন ফিরেছে। আর স্বচ্ছতার মাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার আশ্বাস সংশি¬ষ্টদের।
জেলা পুলিশ জানায়, এবার ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল (টিআরসি) পদে যশোর জেলায় চার হাজার ৯শ’ ৭৪ জন অনলাইনে আবেদন করে। মাঠ পর্যায়ে পরীক্ষায় তিন হাজার ৯শ’ ৫৭ জন চূড়ান্ত হয়। এরপর যাচাই-বাছাই শেষে ১৭৬ জনের মধ্যে শারীরিক, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার মধ্যে ৮১ জন নিয়োগ পেয়েছেন। এর মধ্যে ৬ জন নারী ও পুরুষ ৭৪ এবং একজন মুক্তিযোদ্ধা কোটা।
পুলিশ লাইন্সের প্রধান ফটকের সামনে দাদীকে জড়িয়ে কাঁদতে দেখা যায় মহিনুর রহমান ইমনকে। তাকেও জড়িয়ে কাঁদছেন দাদিও। শার্শার উলাসী গ্রামের হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান ইমন জানান, ‘তার বাবা স্ট্রোক করে শয্যাশায়ী। পরিবারের একমাত্র ছেলে হওয়ায় সংসারের সব ভার আমার কাঁধে। এতদিন অসুস্থ দাদা আমার পরিবারকে দেখাশোনা করতো। অনেক কষ্ট করেছি, এবার চাকরি হয়েছে। এতে আমি খুশি। আবেগাপ¬ুত হয়ে তিনি বলেন, এই চাকরিটা হয়ে আমার যে কত উপকার হলো; সেটা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। একেবারেই বিনা টাকায়। মাত্র ১২০ টাকা আবেদন ফিটা লেগেছে শুধু।’
পাশেই ছেলে আবির হোসেনকে জড়িয়ে কাঁদতে দেখা যায় চৌগাছার ব্যারাকপাড়ার ড্রাইভার আসাদুল ইসলামকে। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘অনেক কষ্ট করে ছেলেটারে মানুষ করেছি। ছেলেটারে টাকা দিয়ে কোথাও চাকরিতে ঢুকিয়ে দিবো; এমন সামর্থ্য আমার নেই। বিনা টাকায় চাকরির সুযোগ হয়েছে বলে ছেলেটা আজ যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকরি পেয়েছে। অভাবের সংসারে ছেলেটা হাল ধরতে পারবে আবার দেশের জন্য কাজ করতে পারবে ভেবেই পিতা হিসাবে আজ গর্ববোধ করছি। পাশেই আবিরের মা বেবি নাজনীন দাঁড়িয়ে কাঁদছেন। ছেলের চাকরির ফলাফল দিবে বলে তিনি আজ (বৃহস্পতিবার) রোজা রেখেছিলেন। সৃষ্টিকর্তাকে শুকরিয়া জ্ঞাপন ও পুলিশ কর্মকর্তাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে এই মা বলেন, ‘আমার ছেলের চাকরি হয়েছে; কোনো প্রকার ঘুষ-সুপারিশ কিছুই লাগেনি। আমরা খুব খুশি হয়েছি।’
বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১ টার দিকে পুলিশ লাইন্স চত্বরে আয়োজিত ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল (টিআরসি) পদে চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ করেন পুলিশ সুপার জিয়াউদ্দিন আহম্মেদ। ফলাফল ঘোষণা শেষে নিয়োগপ্রাপ্তদের ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান। এই স্বচ্ছ ও দুর্নীতি মুক্ত কনস্টেবল নিয়োগ পরীক্ষা গ্রহণে সমর্থ হওয়ায় যশোরবাসীকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি জনগণের পাশে থাকার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জিয়াউদ্দিন আহম্মেদ বলেন, ‘নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকে গোয়েন্দা পুলিশসহ জেলা পুলিশের সব সদস্য সতর্ক ছিল। কোনো প্রকার টাকা পয়সার লেনদেন বা অনিয়ম রোধে সবাই একসঙ্গে কাজ করেছি। সব মিলিয়ে এই নিয়োগ প্রক্রিয়া খুবই স্বচ্ছতার সঙ্গে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে হয়েছে। এখানে কোনো প্রকার অবৈধ লেনদেন বা স্বজনপ্রীতি হয়নি। ভবিষ্যতেও এভাবে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার আশ্বাস দেন ওই কর্মকর্তা।’