বাংলার ভোর প্রতিবেদক
প্রায় আট বছর আগে ঢাকঢোল পিটিয়ে যশোরকে দেশের ভিক্ষুকমুক্ত জেলা হিসেবে ঘোষণা করেছিল যশোর পৌরসভার তৎকালিন মেয়র জহিরুল ইসলাম চাকলাদার রেন্টু। কিন্তু বাস্তব চিত্র পুরো উলটো, যশোরে এখন ভিক্ষুকের ছড়াছড়ি। অভিযোগ রয়েছে, ভিক্ষুক পুনর্বাসনের নামে ওই সময় সরকারি অর্থ লোপাট করেছিলেন তৎকালিত ক্ষমতাসীন ফ্যাসিষ্ট নেতাকর্মীরা।
সরেজমিনে দেখা যায়, যশোর শহরের রাস্তাঘাট, অলিগলি, গুরুত্বপূর্ণ মোড়, বাণিজ্যিক কেন্দ্র, বাস টার্মিনাল, ট্রেন স্টেশন, হাসপাতাল, মসজিদ, কবরস্থান সবখানেই ভিক্ষুকের ছড়াছড়ি। বাজার দরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ভিক্ষার পরিমাণ। কয়েক বছর আগে ভিক্ষুকদের দুই টাকা দিলেও তারা হাসিমুখে নিত। এখন পাঁচ/দশ টাকার নিচে ভিক্ষুকরা আর ভিক্ষা নিতে চান না। পাঁচ টাকার কম দিলে অনেক ভিক্ষুক তা রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে। আবার ভিক্ষা না দিলে অনেক ভিক্ষুক গালমন্দও করেন। এ কারণে পথচারীসহ সাধারণ মানুষকে প্রায়শই বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হচ্ছে।
পৌর এলাকায় প্রবেশের পর দেখা মিলবে ভিক্ষুকের সারি। ভিক্ষাবৃত্তিতে সহজ পন্থায় বেশি আয় করা যায় বলেই ভিক্ষুকরা পেশা ছাড়ছে না এমনটি মনে করেন পৌরকর্তৃপক্ষ। তারা বলছেন, হাজার হাজার ভিক্ষুককে ভিন্ন পেশায় পুনর্বাসনের চেষ্টা করছি আমরা। পৌরবাসীর উচিৎ ঢালাওভাবে ভিক্ষা না দেয়া।
পৌরসভার প্রশাসনিক কর্মকর্তা জানান, ২০১৭ সালের ১৩ জুন যশোর পৌরসভাকে ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষণা করা হয় এ ঘোষণার আগে ৫ লাখ ভিক্ষুককে ক্ষুদ্র ব্যবসার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করার জন্য বিভিন্ন সামগ্রী দেয়া হয়। সামগ্রীর মধ্যে ছিল হাঁস, মুরগি, রিকশা ভ্যান, সেলাই মেশিন, কাঁচামাল, শাড়ি লুঙ্গি ও নগদ টাকা। এসব সামগ্রী গ্রহণের সময় ভিক্ষুকরা শপথ করেছিলেন তারা আর ভিক্ষা করবেন না। কর্ম করে জীবিকা নির্বাহ করবেন। শপথ গ্রহণকারী ভিক্ষুকদের মধ্যে হাতে গোনা দুই-একজন পেশায় আছেন। বাকিরা টাকা পয়সা নষ্ট করে পূর্বের পেশা বহাল রেখেছেন। পৌরকর্তৃপক্ষ জানায়, অনেকে নিজেদের পাশাপাশি অবুঝ সন্তানদেরও ভিক্ষার পেশায় নামিয়েছেন। যাদের এখন প্রাথমিক স্কুলে পড়ার সময় শহরের দড়াটানায় এসব ছোট বাচ্চাদের ভিক্ষা করতে দেখা যায়। এরা আবার এশার নামাজের সময় যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের মসজিদের গেটে বসে ভিক্ষা করে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৬ সালের ১ আগস্ট খুলনা বিভাগকে ভিক্ষুকমুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। ২০১৭ সালের ১৩ জুন যশোর পৌরসভাকে ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষণা করেন মেয়র জহিরুল ইসলাম চাকলাদার রেন্টু। এর আগে ২০১৭ সালের ১৬ এপ্রিল যশোর সদর উপজেলার ১৫টি ইউনিয়ন ভিক্ষুক মুক্ত ঘোষনা করেন খুলনা বিভাগীয় কমিশনার মো. আবদুস সাত্তার। এই ভিক্ষুক মুক্ত অনুষ্ঠানে যশোর পৌর এলাকার বাইরের ১৫টি ইউনিয়নের ৪৬৪ জন ভিক্ষুককে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে আয়বর্ধক বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী দেওয়া হয়। এর মধ্যে ১৮৭ জনকে ছাগল, ২৫ জনকে ভ্যান, ৮৮ জনকে হাঁস-মুরগি, ৩৪ জনকে মুদি ও ৩২ জনকে চা-দোকানের সামগ্রী দেওয়া হয়। পাশাপাশি অন্যদের মধ্যে বিভিন্ন ব্যবসার পণ্য বিতরণ করা হয়। এসব পণ্যসামগ্রী হাতে নিয়ে তাঁরা আর কখনো ভিক্ষা না করার অঙ্গীকার করেন।
যশোর জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তর সূত্র জানা যায়, ২০১৭ সালে জেলার ৮টি উপজেলায় ভিক্ষুকদের বিভিন্ন ভাবে পুনর্বাসন সামগ্রী, সেলাই মেশিন, ভ্যান-রিকশা, হাঁসমুরগি, মুদি দোকান, পুরাতন কাপড় বিক্রি, ডিম বিক্রি, কাঁচামালের ব্যবসা, পিঠা তৈরি, ওজন মাপা মেশিন, ঝাল-মুড়ি ও চানাচুর বিক্রি, আগরবাতি তৈরির মালামাল, টক দই বিক্রি, ঠোঙা বিক্রি, হাঁড়ি-পাতিল বিক্রি, শাকসবজি বিক্রির ভ্যানগাড়ি, চায়ের দোকানের উপকরণ দেওয়া হয়েছিল। ঐ বছরই যশোর জেলাকে ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষণা করা হয়। এ সময় জেলা প্রশাসক পেশাদার ভিক্ষুকদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ারও ঘোষণা দেন।
যশোরের দড়াটানা এলাকায় ভিক্ষাবৃত্তি করা জহুরা নামের এক বৃদ্ধা ভিক্ষুক জানান, তার বাড়ি সাতক্ষীরা জেলার দেবহাটায়। ছেলেমেয়ে নেই। বর্তমানে তিনি প্রায় ১৫ বছর শংকরপুর এলাকার এক বস্তিতে থাকেন। তিনি সরকারের পুনর্বাসন প্রকল্পের কোনো সুযোগ-সুবিধা পাননি।
মোল্লাপাড়া বৌবাজার এলাকার বস্তিতে বসবাসকারী ভিক্ষুক ইউনুস আলী (৬৮) বলেন, ‘অসুস্থতার কারণে গত চার-পাঁচ বছর ধরে ভিক্ষা করতে বাধ্য হইছি। ভিক্ষা না করলি খাবো কি?’ সত্তরোর্ধ্ব ফকির জাফর থাকেন যশোর রেলস্টেশনে। ১০ বছরের বেশি সময় ধরে তিনি এখানে ভিক্ষা করছেন। তিনি বলেন, ‘বাড়িঘর নেই, কাজ করতে পারি না। তাই ভিক্ষা করেই আমার জীবন চলে।’
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মহসিন বলেন, শহরের মধ্যে কোনো জায়গায় কেনাকাটা করতে গেলেই ভিক্ষুকরা ঘিরে ধরে। ভিক্ষুকদের কারণে মানুষকে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হচ্ছে।
যশোরের গাড়ীখানা রোড়ের ওয়ালটন এর ম্যানেজার মিজান বলেন, দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, ভিক্ষুকমুক্ত জেলা যশোরে এখন ভিক্ষুকের ছড়াছড়ি। ভিক্ষুক ছাড়া কোনো জায়গা নেই। এমনটি রাস্তায় চায়ের দোকানে গেলেও তাদের অত্যাচারে দাড়ানো দায় হয়ে দাড়ায়।
যশোর শাহজালাল ব্যাংকের অফিস সহকারি মেহেদী মাসুদ বলেন, দিন যত যাচ্ছে ভিক্ষুকের সংখ্যা তত বাড়ছে। ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ করার জন্য রাষ্ট্র ও প্রশাসনকে আবারো উদ্যোগ নিতে হবে। সরকার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করলে ভিক্ষাবৃত্তি কমিয়ে আনা সম্ভব।
যশোর সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক অসিত কুমার সাহা বলেন, আমি অল্পকিছুদিন যশোরের এই পদে আছি, তবে শুনেছি ২০১৭ সালে যশোরকে ভিক্ষুক মুক্ত ঘোষনা করা হয়। এর পর থেকে তৎকালিন সরকার আর কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। ফলে এখন আমাদের কাছে বর্তমানে কতজন ভিক্ষুক আছে ও কতজনকে পুর্নবাসন করা হয়েছে তার সঠিক তথ্য নাই। তবে আমাকে কিছু দিন সময় দিলে আমি পূর্বের তথ্যগুলি আমি জানাতে পারবো।