হাসান আদিত্য
টানা কয়েক বছর নতুন বছরের প্রথম দিন নতুন বইয়ের গন্ধ নিয়ে আনন্দে বাড়ি ফিরলেও এবার শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে বই নিতে এসে খালি হাতে ফিরতে হয়েছে যশোরের অধিকাংশ শিক্ষার্থী। চলতি বছরের প্রথম দিন বুধবার প্রাথমিকস্তরে চতুর্থ শ্রেণীর তিনটি বিষয় আর মাধ্যমিকে সপ্তম শ্রেণীর তিনটি বই পেলেও বাকি শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মলিন মুখে খালি হাতে ফিরে যেতে দেখা গেছে। শিক্ষাবিভাগ বলছে, প্রাথমিকে চাহিদার এক চতুর্থাংশ আর মাধ্যমিকে এক শতাংশ বই বিতরণ হয়েছে। ৫ আগস্ট পতিত আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ছাপানো জটিলতায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টির হয়েছে। নতুন শিক্ষাবর্ষে দেরিতে বই পাওয়া নিয়ে অভিভাবকরা শঙ্কা প্রকাশ করলেও কর্তৃপক্ষ বলছে চলতি মাসেই শিক্ষার্থীদের হাতে উঠবে নতুন বই।
জেলা মাধ্যমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের তথ্যমতে, যশোর জেলা মাধ্যমিক, দাখিল ও ইবতেদায়ী, ভোকেশনাল, এসএসসি ভোকেশনাল, দাখিল ভোকেশনালে ৩ লাখ ৯০ হাজার ১৭৮ শিক্ষার্থীর জন্য বইয়ের চাহিদা ৪০ লাখ ৬৫ হাজার ২৭৫ পিস আর প্রাথমিকে বইয়ের চাহিদা ১৩ লাখ ৩৬ হাজার ৫০ পিস। এর বিপরীতে প্রাথমিকে চতুর্থ শ্রেণীর বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে বই আসে তিন লাখ ৪৬ হাজার। আর মাধ্যমিকে সপ্তম শ্রেণীর তিনটি বিষয়ের এক শতাংশ বই পেয়ে শিক্ষকদের হাতে বুধবার পৌঁছ দেয়া হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিজ উদ্যোগে এই বই বিতরণ করেছে। তবে ইবতেদায়ি শাখার শিক্ষার্থীদের কোনো বই উপজেলায় পৌঁছায়নি।
মণিরামপুর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবুল বরকত মোহাম্মদ ফকর উদ্দিন বলেন, আমরা সপ্তম শ্রেণির জন্য ৩ বিষয়ে ৭০ সেট বই হাতে পেয়েছি। তার মধ্যে বুধবার ৩৩ জন শিক্ষার্থী বই নিয়েছে। বাকি কোনো শ্রেণির বই দিতে পারেনি। টেংরামারি সম্মিলনী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেণির ছাত্রী লামিয়া খাতুন বলে, আমাদের ৩ বিষয়ের বই দিয়েছে। বাকি বই পরে দেবে বলেছে। আজ থেকে নতুন বই পড়ব। এদিকে খালি হাতে মলিন মুখে ফিরে যেতে দেখা গেছে একই প্রতিষ্ঠানের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী রাকিব হোসেনসহ অনেককে। রাকিব বলে, নতুন বই পাওয়ার আশায় সকাল সকাল স্কুলে এসেছি।
শিক্ষকেরা জানিয়েছেন, আমাদের শ্রেণির কোনো বই আসেনি। কবে বই পাব তাও নিশ্চিত করে জানানো হয়নি। রাকিব আরও বলে, নবম শ্রেণির পুরোনো বই খুঁজে নিয়েছি। আপাতত এটার সঙ্গে ইংরেজি গ্রামার পড়া শুরু করব।
সদর উপজেলার দত্তপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুর জব্বর বলেন, ‘এবারে প্রথম শ্রেণী থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত ১৪৩ শিক্ষার্থীর বই চাহিদা পাঠানো হয়। এর মধ্যে চতুর্থ শ্রেণীর তিনটি করে বই পেয়েছিলাম, ওগুলো বিতরণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘প্রথম দিনই ছেলে মেয়েরা আসছে, তারা বলছে স্যার বই দিবেন না? বই কই? কবে দিবেন সব সময়? তাদের প্রশ্নের জবাব দিতে পারছি না। বই না পেলে ক্লাস করাও কঠিন।
মণিরামপুর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আবু মোতালেব আলম বলেন, শুধুমাত্র চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের তিন বিষয়ের বই দিতে পেরেছি। অন্য কোনো শ্রেণির বই পাওয়া যায়নি।
নুরুজ্জামান নামে এক অভিভাবক বলেন, মেয়ে নতুন কারিকুলামে নবম শ্রেণিতে পরীক্ষা দিয়ে দশম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছে। এবার বছরের মাথায় আবার এটি বাদ হয়ে আগের কারিকুলাম শুরু হচ্ছে। যেখানে মাত্র এক বছর পড়েই এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে। তার মধ্যে বছরের শুরুতে বই পাচ্ছে না। সবমিলিয়ে সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কার মধ্যে রয়েছি।
যশোর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক বলেন, বছরের প্রথমদিনে নতুন বই নিয়ে সবার বাড়তি আগ্রহ থাকে। কিন্তু বই না পাওয়াতে মন খারাপ। তিনি বলেন, বারবার কারিকুলাম পরিবর্তনে সবচেয়ে ক্ষতির মুখে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষাবর্ষের সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে যদি সিলেবাস প্রণয়ন করা হয় তাহলে শিক্ষার্থীদের জন্য কিছুটা হলেও সুবিধা হবে। সংশ্লিষ্ট দপ্তর যদি বিষয়গুলো গুরুত্ব দেন আমরা উপকৃত হবো।
জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মাহফুজুল ইসলাম বলেন, ‘এবার আনুষ্ঠানিকভাবে বই উৎসব হয়নি। জেলায় এক শতাংশ বই এসেছে। জেলায় চাহিদার সম্পূর্ণ বই আসতে এই মাস লেগে যাবে। তবে যখনি বই আসছে, সাথে সাথে বিদ্যালয়গুলোতে পাঠানো হচ্ছে।
আর প্রাথমিকে চাহিদার এক চতুর্থাংশ বই এসেছে সেগুলো বিতরণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আশরাফুল আলম। জানুয়ারির মধ্যে বাকি বই পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এদিকে সকাল থেকে জেলার বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে নতুন বই পেয়ে শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের মাঝে উচ্ছ্বাস দেখা গেছে। আবার অনেকে বই না পেয়ে ফিরেছেন মলিন মুখে।