বাংলার ভোর প্রতিবেদক
পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে ফুলের রাজধানী খ্যাত যশোরের গদখালিতে দুই কোটি টাকার ফুল বেচাকেনা হয়েছে। ফুলের বেচাকেনা জমজমাট হওয়ার কথা থাকলেও, এবারের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ব্যবসা মন্দাভাব বিরাজ করছে। শুধু এই বছর নয়; বেশ কয়েক বছর ধরেই নানা কারণে বাংলা নববর্ষে ভালো ব্যবসা হচ্ছে না বলে জানান ফুল ব্যবসায়ীরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফুলের পর্যপ্ত যোগান থাকলেও দাম নেই। রাজনৈতিক অস্থিরতায় সামাজিক অনুষ্ঠানগুলো জমজমাট না হওয়ায় বেচাকেনায় প্রভাব পড়েছে।
বাংলাদেশে যেসব উৎসব ও দিবসকে ঘিরে ফুলের ব্যবসা জমজমাট থাকে তার মধ্যে বাঙালি জাতির সর্বজনীন উৎসব পহেলা বৈশাখ অন্যতম। এ দিনটিকে ঘিরে পাড়ায় পাড়ায় শহরে তৈরি হয় আনন্দঘন আবহ। সেই আনন্দে পূর্ণতা যোগ করে ফুল। ফুল দিয়ে হয় সাজসজ্জা, শুভেচ্ছা বিনিময়, প্রেম নিবেদন, সৌন্দর্য্যবর্ধনসহ আরও কত কী! ফলে উৎসবের আমেজে জমে উঠে ফুলের ব্যবসা। কিন্তু এবারের চিত্র ভিন্ন; দেশের সর্ববৃহৎ ও ফুলের রাজধানীখ্যাত যশোরের গদখালি পানিসারাতে ফুলের বাজারে নেই ক্রেতাদের আনাগোনা। পহেলা বৈশাখের আগে পাইকারি হাটবার ছিলো শনিবার ও রোববার। সাধারণ যেকোন উৎসবের আগের দুইদিন জমজমাট বেচাকেনা হলেও এবারের চিত্র ছিল ভিন্ন। যশোরের বাইরে থেকে তেমন একটা পাইকারদের আসতে দেখা যায়নি। স্থানীয় ব্যবসায়ী ও চাষীদের পরিবহনের মাধ্যমে ফুল পাঠাতে দেখা গেলেও সেটা কাক্সিক্ষত নয়।
বিক্রেতারা বলছেন, গত কয়েক বছর ধরে বৈশাখকে কেন্দ্র করে ভালো যাচ্ছে না ফুলের বাজার। কোভিড মহামারি, রোজার মধ্যে বৈশাখ, এবার রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে বৈশাখ হওয়াতে জমেনি ফুলের বেচাকেনা।
উত্তর নাভারণ মাঠপাড়ার কৃষক মশিউর রহমান জানান, ‘সাড়ে ছয় বিঘা জমিতে রজনিগন্ধা, গোলাপ, মল্লিকা ফুল চাষ করেছি। পর্যপ্ত চাষাবাদ করে ফুল উৎপাদন করলেও বেঁচাকেনা নেই। কাক্সিক্ষত দাম পাচ্ছি না। রোববার ৫ হাজার গোলাপ, মল্লিকা হাঁটে নিয়ে গেলেও কাক্সিক্ষত দাম পাইনি। পাইকার না আসাতে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে পানির দরে সাড়ে তিন হাজার ফুল বিক্রি করে দিয়েছি। দাম না পাওয়াতে দেড় হাজার বাড়ি ফিরিয়ে এনেছি। সম্মিলিতভাবে বলতে গেলে দেশের একটি অংশের মানুষের মধ্যে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে না। রাজনৈতিক অস্থিরতায় অনুষ্ঠান জাঁকজমকভাবেও হচ্ছে না। ফলে বেচাকেনাতেও প্রভাব পড়েছে।’
রোববার গদখালিতে প্রতি পিস গোলাপ বিক্রি হয়েছে একটাকা থেকে তিন টাকা পর্যন্ত। যা গত বছর ছিলো ৫ থেকে আট টাকা পর্যন্ত। এদিন রজনীগন্ধা বিক্রি হয়েছে প্রতি পিস দেড় টাকা, যা গত বছর ছিলো আড়াই থেকে তিন টাকা পর্যন্ত। প্রতি পিস জারবেরা বিক্রি হয়েছে ৪ থেকে ৫ টাকা, যা গত বছর ১০ টাকার উপরে। প্রতি গ্লাডিওলাস বিক্রি হয়েছে চার থেকে পাঁচ টাকা। গত বছর ৮ থেকে ১২ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছিলো। আর গাদা বিক্রি হয়েছে দেড় শ’ টাকা হাজার।
ফুলের ব্যবসা আগের মতো নেই জানিয়ে গদখালি বাজারের ব্যবসায়ী শাহজাহান বলেন, ‘তিন চার বছর আগে বৈশাখের এক সপ্তাহ আগে থেকেই ক্রেতাদের কাছ থেকে অর্ডার আসা শুরু হতো। এবার এরকম একটাও পাইনি। ঈদেও প্রস্তুতি ভালো ছিলো, বেচাকেনা ছিলো না। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে দূর দূরান্তের ব্যবসায়ীরা ফুল নিচ্ছে কম। যা নিচ্ছে; মোবাইলে বলছে, আমরা এখান থেকে পরিবহনের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিচ্ছি’। কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গদখালিতে অনেক ব্যবসায়ীর ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। ফলে নতুন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ঢাকা সিলেট চট্টগ্রামের পাইকারদের সঙ্গে সখ্যতা সৃষ্টি হয়নি। ফলে ওইইসব পাইকাররা এখন গদখালি হাট ছেড়ে দিয়ে পার্শ্ববর্তী জেলা ঝিনাইদহ চুয়াডাঙ্গাতে ভিড়ছেন।
গদখালি ফুলচাষি কল্যাণ সমিতির সভাপতি আব্দুর রহিম বলেন, ‘স্থানীয় চাষীদের প্রস্তুতি ভালো ছিলো। ফুলের যোগানও ভালো। তবে কাক্সিক্ষত দাম পায়নি চাষিরা। অনেক চাষির ক্ষেতে ফুল ফুটে নষ্টও হচ্ছে। এসএসসি পরীক্ষার সময় হওয়াতে সেইসব পরিবারে উৎসব নেই। একই সাথে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সামাজিক অনুষ্ঠানও হ্রাস পেয়েছে। গত দুই দিনে দুই কোটি টাকার ফুল বেচাকেনা হয়েছে দাবি এই নেতার। জমজমাট অনুষ্ঠান না হওয়াতে বেচাকেনায় প্রভাব পড়েছে বলেও জানান তিনি।’
# নববর্ষে ফুলের রাজ্যে নতুন রাণী ‘নন্দিনী’
ফুলটি দেখতে গোলাপের মতো, তবে কাঁটা নেই। গোলাপ শীতকালে ভালো ফোটে; আর জাপানি এই ফুল ফোটে শীত, বর্ষা, গ্রীস্ম সব ঋতুতেই। খরা ও বর্ষাসহিষ্ণু এই ফুলের সংরক্ষণকালও গোলাপের চেয়ে বেশি। অন্তত আট রঙে এই ফুল ফোটে। পানিসারা গ্রামে চাষ করা হচ্ছে নন্দিনী নামের এই ফুল। আমদানিনির্ভর এই ফুলের ব্যাপক বাণিজ্যিক সম্ভাবনা দেখছেন ফুলবিশেষজ্ঞরা।
পানিসারা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, দুই শতক জমিতে নন্দিনী ফুলের চাষ করা হয়েছে। মিন্টু সরদার নামের এক ব্যক্তি ফুল পরিচর্যায় ব্যস্ত। সাদা ও বেগুনি রঙের নন্দিনী ফুল ফুটে আছে। একটি গাছে একটি করে ডাঁটা (স্টিক), প্রতিটি ডাঁটায় ৮ থেকে ১০টি করে কুঁড়ি। কয়েক দিনের মধ্যে এই ফুল কাটা হবে জানালেন মিন্টু গাজী। তিনি জানালেন, দুই শতক জমিতে সাড়ে তিন হাজারের মতো চারা রোপণ করা হয়েছিল। এর মধ্যে কিছু চারা মারা যায়। আড়াই থেকে তিন হাজার গাছে ফুল পাওয়া যাবে। প্রতিটি স্টিক ২০০ থেকে ২৫০ টাকা করে বিক্রি হবে।