বাংলার ভোর প্রতিবেদক
‘কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ (২য় পর্যায়)’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মাধ্যমে হরিহর নদী পুনঃখনন কাজ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অথচ নীতিমালা অনুযায়ী যথাযথ উল্লম্ব-অনুভূমিক জায়গা না রেখে হরিহর নদের উপরে যশোর সদর উপজেলার গোয়ালদাহ বাজারে আরেকটি অপরিকল্পিত সেতু নির্মাণ করছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)।
একই অভিযোগে গত বছরের মে মাসে উচ্চ আদালত যশোরের পাঁচটি নদীর উপরে নির্মাণাধীন আট সেতুর কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন। সেতুগুলো অসম্পূর্ণ অবস্থায় পড়ে রয়েছে। সেই একই পথে হেটে আরো একটি অপরিকল্পিত সেতু নির্মাণ করছে এরজিইডি’র কর্মকর্তারা। এই নদ খননের সময় এই সেতুটিও অত্যন্ত ঝুঁকিতে পড়ার শঙ্কা রয়েছে। কারণ এখন নদীটির তলদেশ যে অবস্থায় রয়েছে সেখান থেকে আরো সাত থেকে আট ফুট গভীর করে খনন করা হবে। সেক্ষেত্রে সেতুটি দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে নাকি তা নিয়ে ঝুঁকি রয়েছে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলীদের শঙ্কা রয়েছে।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ভবদহ এলাকার জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে সেনাবিহিনীর সরাসরি তত্ত্ববধানে চারটি নদী খননের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এরমধ্যে যশোর সদর উপজেলার সীমান্ত দিয়ে প্রবাহিত হরহর নদও রয়েছে। অথচ পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাথে আলোচনা ছাড়াই এলজিইডি এই নদের উপরে কম দীর্ঘ ও উচ্চতার একটি সেতু নির্মাণ করছে যশোরের পুলেরহাট-রাজগঞ্জ সড়কের গোয়ালদাহ বাজারে। যা নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদেরও ক্ষোভ রয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, প্রায় ১৪০ ফুট প্রশস্ত নদের বুকে ৯১ ফুট দৈর্ঘের একটি সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। সেতুর মাঝখান বরাবর যেখান থেকে পানি চলাচল করে সেখানকার ফাকা জায়গা রাখা হচ্ছে মাত্র ৩০ ফুটের মত। এছাড়া সেতুর উচ্চতা হচ্ছে সমতল ভূমির সমান। যে কারণে বর্ষা মৌসুমে এ নদ দিয়ে পানি নিষ্কাষণ বাধাগ্রস্ত হবে বলে স্থানীয় বাসিন্দারা জানান।
স্থানীয় বাসিন্দা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘ঐক্য-বন্ধন’ প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘বর্ষা মৌসুমে এই নদী দিয়ে কয়েকটি গ্রামের পানি নেমে ভবদহ বিলে গিয়ে মেশে। এ সময় ব্যাপক স্রোত থাকে নদীতে। আগে এখানে একটা কালভার্টের মত সেতু ছিলো। এলাকাবাসীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সেটি অপসারণ করে নতুন সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার। কিন্তু নতুন নির্মাণাধীন সেতুটিও অগের মতনই নির্মাণ করা হচ্ছে। আমরা এলজিইডি ইঞ্জিনিয়ারকে বিষয়টি বলেছি, কিন্তু তারা আমাদের কথা আমলে নিচ্ছে না’।
স্থানীয় গোহালদাহ বাজারের উদ্যোক্তা আশরাফুল আলম বলেন, ‘নদীর ভিতরেই পাইলিং করার সময়ে আমরা বাঁধা নিয়ে ছিলাম। কিন্তু ঠিকাদার ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আমাকে বলেন, “তুমি কি ইঞ্জিনিয়ার, ইঞ্জিনিয়ারের নকশার বাইরে কিছু হচ্ছে না”।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, সেতু নির্মাণের পাশ দিয়ে যানবহন চলাচলের জন্যে আড়াআড়ি নদী ভরাট করে রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। বর্ষার সময়ে ওই সড়ক তিনবার ভেঙ্গে গেছে। অথচ সেতু নির্মাণ সময় নদীর উপরে অস্থায়ী বেইলি সেতু দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু সেটা করা হয়নি।
এলজিইডি সূত্রে জানা গেছে, এক কোটি ১৬ লাখ টাকা ব্যয়ে এই সেতুটির নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০২৩ সালে নভেম্বর মাসে। যা শেষ হবে চলতি বছরের নভেম্বর মাসে। মোজাহার এন্টারপ্রাইজ, তাহের ব্রাদার্স ও মেসার্স শামীম চাকলাদার যৌথ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, নদী বক্ষে পাইলিং করে সেতু করা হচ্ছে। সেতুর পাটাতন (গার্ডার) স্থাপনের জন্যে নদের ভিতরেই দুই পাশে দুইটি পায়ার (অ্যাবাটমেন্ট) নির্মাণ করা হয়েছে। নির্মাণ কারিগরেরা গার্ডার স্থাপনের জন্যে ক্যাপ নির্মাণের কাজ করছেন।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ কুমার ব্যানার্জী বলেন, ‘ভবদহের জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে সেনাবাহিনীর তত্ত্ববধানে ভবদহ বিলের সাথে সম্পৃক্ত চারটি নদী খনন করা হবে। ওই প্রকল্পের আওতায় হরিহর নদীও রয়েছে। খুব শিগগিরই খনন কাজ বাস্তবায়ন হবে। এরমধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাথে কোনো ধরণের আলোচনা ছাড়াই এলজিইডি কম উচ্চতা ও দৈর্ঘের একটি সেতু নির্মাণ করছে। এমনকি পুরানো সেতুর ইট সিমেন্টর অংশ নদী বক্ষে ফেলে ভরাট করা হয়েছে। যথাযথ নীতিমালা মেনে সেতু নির্মাণ ও নদী বক্ষে ফেলা ইট সিমেন্টর বজ্র অপসারণের জন্যে এনজিইডি নির্বাহী প্রকৌশলীকে চিঠি দেওয়া হয়েছে’।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এলজিইডি যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী আহমেদ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘হরিহর নদের উপরে ৩০ মিটার দৈর্ঘের সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে পানির স্রোত যাওয়ার জন্যে সেতুর মধ্যবর্তী স্থানে ১৫ মিটার মত জায়গা থাকছে। নদীর তলদেশে পানির স্তর থেকে ২ দশমিক ৪৬ মিটার উচ্চতা থাকছে। নীতিমালা মেনেই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে’।
প্রকল্পের অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেতুটির নির্মাণ কাজ ৫৫ শতাংশ শেষ হয়েছে। আগামী জুন মাসের মধ্যে কাজ শেষ করা হবে’।
পাঁচ নদীর আট সেতুর নির্মাণ কাজ বন্ধ, কোনো সুরাহা নেই:
যশোরে পাঁচটি নদীর ওপর আটটি সেতু নির্মাণে অভ্যন্তরীণ জলপথ ও তীরভূমিতে স্থাপনা নির্মাণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা অনুসারে যথাযথ উল্লম্ব-অনুভূমিক জায়গা না রাখার বিষয়ে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী ও যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলীকে নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে বলা হয়েছে। এই সময়ে সব ধরনের নির্মাণকাজ বন্ধ থাকবে বলে আদালতের বিচারক নির্দেশ দেন। পরবর্তী আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত ঠিকাদারদের অর্থছাড়ও বন্ধ থাকবে বলে আদালত আদেশ দেন।
আটটি সেতু হচ্ছে, যশোর সদর উপজেলার ভৈরব নদীতে ছাতিয়ান তলা সেতু, রাজারহাট সেতু ও দাইতলা সেতু; অভয়নগর উপজেলার টেকা নদীতে টেকা সেতু; মনিরামপুর উপজেলার মুক্তেশ্বরী নদীতে হাজরাইল সেতু ও শ্রী নদীতে নেহালপুর সেতু এবং শার্শা উপজেলার বেতনা নদীতে কাজীরবের থেকে ইসলামপুর মোড় আরসিসি গার্ডার সেতু ও শেয়ালঘানা গাতিপাড়া আরসিসি গার্ডার সেতু।সেতুগুলোর নির্মাণ কাজ এখনো বন্ধ রয়েছে। নির্মাণের বিষয়ে পরবর্তী কোনো আদেশ দেননি আদালত।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এলজিইডি যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী আহমেদ মাহবুবুর রহমান বলেন, আগের আটটি সেতু নির্মাণাধীন অবস্থায় রয়েছে। আদালত পরবর্তী কোনো আদেশ দেননি। যে কারণে কোনো অগ্রগতি নেই। মানুষের ভোগান্তি হলেও আদালত যখন নির্দেশনা দিলে কাজ শুরু হবে।’
তাহলে হরিহর নদে আরেক অপরিকল্পিত সেতু নির্মাণের আপনারা একই পথে হাটলেন কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, এটি ১০০ কোটি টাকার প্রকল্প। এই প্রকল্পের মধ্যে একটি সেতু, ২২টি কালভার্ট, ৩৪ কিলোমিটার সড়ক, চারটি ক্রস ড্রেন ও একটি মার্কেট নির্মাণ করা হচ্ছে। এই প্রকল্পটি এলজিইডি ও বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিনিধিরা যৌথভাবে নকশাসহ দেখভাল করছে।
এলজিইডির বারবার দায়িত্বহীনতার কারণে একই ভূল করছেন অভিযোগ যশোরের পাঁচটি নদী বাঁচাও আন্দোলনের উপদেষ্টা ইকবাল কবির জাহিদ। তিনি বলেন, ‘এলজিইডি সরকারের আইন মানে না। আইন থাকা সত্ত্বেও এই অঞ্চলের নদীর উপর সেতু তৈরির নামে কালভার্ট নির্মাণ করছে। এতে নদীকে হত্যা করছে। আমরা কয়েকদফা চিঠি দেওয়া সত্ত্বেও তারা তাদের মতো এসব কাজ করে যাচ্ছে।’