বাংলার ভোর প্রতিবেদক
যশোরের শার্শার পুটখালি সীমান্তে এক সময় গরুর দালালি করতেন নাসির উদ্দিন। ওপার থেকে ভারতীয় গরু এনে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর স্থানীয় সংসদ সদস্য শেখ আফিল উদ্দিনের ছত্রছায়ায় চলে যান। তার আশির্বাদে পুটখালী সীমান্তে গড়ে তোলেন গরুর খাটাল। গরুর খাটালের আঁড়ালে স্বর্ণ চোরাচালানের সিণ্ডিকেট রমরমা ব্যবসা শুরু করে।
প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ও প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাদের ম্যানেজ করে মাফিয়া বনে যান নাসির। তাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। নাসির সিণ্ডিকেট ২০২৩ সালে বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ১৩৫টি স্বর্ণের বার পাচারের সময় ধরা পড়ে যায়। ওই ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে নাসির-ওলিয়ার ও রুহুল আমিন-রেজাউল করিমের ভাই ভাই সিণ্ডিকেটের চাঞ্চল্যকর তথ্য পায় সিআইডি। সিণ্ডিকেটের ৯ জনের বিরুদ্ধে স্বর্ণ চোরাচালান ও অর্থ পাচারের প্রমাণ পায় অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অর্গানাইজড ক্রাইমের ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম স্কোয়াড।
সম্প্রতি সিআইডি’র আবেদনের প্রেক্ষিতে যশোরের সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালত নাসির উদ্দিনসহ সিণ্ডিকেটের ৯ সদস্যের অর্জিত অবৈধ অর্থ-সম্পদ জব্দ করে পুলিশ সুপারকে রিসিভার নিয়োগ দিয়েছেন। আদালতের নির্দেশে তালিকার ক্রোক সম্পদ শনাক্তে সার্ভেয়ার ও সংশ্লিষ্ট বিভাগের সহযোগিতা চেয়েছে পুলিশ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেনাপোল পোর্ট থানার ওসি রাসেল মিয়া বলেন, নাসির উদ্দিনসহ ৯ জনের সম্পদ ক্রোক করেছে আদালত। একই সাথে পুলিশ সুপারকে ওই সম্পদের রিসিভার নিয়োগ দিয়েছে। আদালতের পাঠানো তালিকা অনুযায়ী ক্রোক সম্পদ শনাক্তের কাজ শুরু করেছে পুলিশ।’
গরুর দালাল থেকে মাফিয়া গোল্ড নাসির
শার্শার সীমান্তবর্তী গ্রাম পুটখালির বুদো সরদারের দুই ছেলে ওলিয়ার রহমান ও নাসির উদ্দিন। এলাকায় তারা গরুর দালাল হিসেবেই বেশি পরিচিত ছিল। সীমান্তের ওপার থেকে গরু এনে দেশে বিক্রি করতেন। বিএনপি ঘরানার রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকলেও ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভোল পাল্টে ফেলেন নাসির উদ্দিনের পরিবার। যশোর-১ (শার্শা) আসনের তৎকালীন আওয়ামী লীগের এমপি শেখ আফিল উদ্দিনের আশির্বাদও পেয়ে যান। আর তাকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পুটখালি সীমান্তে গড়ে তোলেন বিশাল গরুর খাটাল। সীমান্তের ওপর থেকে ভারতীয় গরু এনে খাটালে রাখা হত। সেখান থেকে পাঠানো হত দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। ভারত থেকে গরু এনে টাকা পরিশোধ করতেন স্বর্ণের বিনিময়ে। অর্থাৎ গরুর দাম পরিশোধ করতেন চোরাচালানের স্বর্ণের বিনিময়ে। এভাবেই গরুর খাটালের আড়ালে নাসির-ওলিয়ার দুই ভাইয়ের স্বর্ণ চোরাচালান সিণ্ডিকেট গড়ে ওঠে। তাদের সঙ্গে যুক্ত হন কুমিল্লার দুই ভাইয়ের আরেক সিন্ডিকেট রুহুল আমিন-রেজাউল করিম। তারা দুবাই থেকে স্বর্ণ কিনে নাসির-ওলিয়ার সিণ্ডিকেটের মাধ্যমে বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাচার করতেন। দুটি ভাই ভাই সিণ্ডিকেটের মাধ্যমে স্বর্ণ চোরাচালানের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে তাদের। রাজনৈতিক ছত্রছায়া ও প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে নির্বিঘ্নে চালিয়ে গেছেন অবৈধ ব্যবসা।
সিআইডির তদন্তে ‘ভাই ভাই সিণ্ডিকেট’র চাঞ্চল্যকর তথ্য:
২০২৩ সালের জুনে পাচারের সময় বেনাপোল সীমান্তে ১৩৫টি স্বর্ণবারসহ নাজমুল, রাব্বি, জনি, আরিফ মিয়াজী, জাহিদুল ও শাহজালাল আটক হয়। ওই ঘটনার পর পাল্টে যায় চিত্র। তাদের নামে দায়ের হওয়া মামলাটি তদন্ত করে সিআইডি। বেরিয়ে আসে ওই স্বর্ণের প্রকৃত মালিক রুহুল আমিন, রেজাউল করিম, ওলিয়ার রহমান, নাসির উদ্দিন ও রমজান আলীর নাম। একই সাথে তারা কিভাবে মানি লন্ডারিং করে সেটিও বেরিয়ে আসে। পরে সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের তদন্তে নাসির উদ্দিন ও তার সহযোগিদের স্বর্ণ চোরাচালান, হুন্ডিতে ডলার লেনদেন, নামে-বেনামে বিপুল অঙ্কের সম্পদের মালিক হওয়া এবং মানি লন্ডারিংয়ের বিষয়ে নিশ্চিত হয়। এ চক্রের প্রায় ১৪ কোটি টাকার সম্পদের খোঁজ পেয়েছে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সংস্থা। নাসিরুদ্দিনের পাঁচটিসহ চক্রের অন্য সদস্যদের সব ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। এ ছাড়া স্বর্ণ চোরাচালানের মাধ্যমে গড়ে তোলা রিপা ফ্যাশন কর্নার, এম এম জুয়েলার্স, রোহা জুয়েলার্স ও নাসির ফার্মের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। নাসির উদ্দিনের ভাই ভাই সিণ্ডিকেটের সদস্যরা দুবাই থেকে শুরু করে ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিমানবন্দর হয়ে বেনাপোল সীমান্ত পর্যন্ত সক্রিয়। তাদের দলের সদস্যরা দুবাই থেকে স্বর্ণ পাচার করে ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিয়ে আসে। সেখান থেকে চক্রের সদস্যরা বেনাপোল সীমান্তে নিয়ে যায়। সীমান্ত পার করে ভারতের ওপারে গৌতম নামে একজনের হাতে পৌঁছে দেয় চক্রটি। আর এই পুরো সিণ্ডিকেটের আঁড়ালে থাকে রুহুল আমিন, রেজাউল করিম, ওলিয়ার রহমান, নাসির উদ্দিন ও রমজান আলী। স্থানীয় আওয়ামী লীগের এমপি ও জনপ্রতিনিধিদের আশির্বাদপুষ্ট হওয়ায় অবাধে গরুর খাটালের আঁড়ালে স্বর্ণ চোরাচালান চালিয়ে গেছে চক্রটি।
স্বর্ণ চোরাচালানের টাকায় সম্পদের পাহাড়
চলতি বছরের ৪ মার্চ অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অর্গানাইজড ক্রাইমের ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম পরিদর্শক মো. মনিরুজ্জামান আদালতে নাসির উদ্দিনসহ ৯জনের সম্পদ বিবরণী উপস্থাপন করে তা জব্দ ও রিসিভার নিয়োগ করার আবেদন করেন। তার আবেদনের প্রেক্ষিতে যশোরের পুলিশ সুপারকে রিসিভার নিয়োগ করা হয়েছে।
ক্রোক সম্পদের তালিকায় নাসির উদ্দিনের নামে রয়েছে-পুটখালি মৌজায় বিভিন্ন দাগে ৩৩ শতাংশ জমি। শার্শার ভবারবেড় এলাকায় ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ জমির ওপর মার্কেট। ওই মার্কেটের জমি কেনা ও নির্মাণে খরচ করা হয়েছে প্রায় চার কোটি টাকা। যদিও বাস্তবে ওই জমির দাম ও নির্মাণ খরচ তিন থেকে চার গুণ বেশি বলে জানা গেছে। শার্শার বাগআঁচড়া এলাকায় ১ একর ৬ শতাংশ জমি রয়েছে। ওই জমির দলিলমূল্য দেখানো হয়েছে এক কোটি ১৭ লাখ টাকা। বেনাপোলের ৪৮ নম্বর মৌজায় ২.৬৩ শতাংশ জমি রয়েছে। যার দলিল মূল্য ১২ লাখ ৪০ হাজার টাকা। পুটখালী মৌজার ১১০ নম্বর মৌজায় আরও ৩০ শতাংশ জমি আছে তার। এ জমির বাজারমূল্যও কয়েক লাখ টাকা। নাসির শুধু নিজের আখের গোছাননি। তার পরিবারের সদস্যদের নামেও গড়েছেন সম্পদ। নাসির উদ্দিন তার স্ত্রী বিলকিস খাতুনের নামে যশোরের ঝিকরগাছার কীর্তিপুরে ১৬ শতাংশ জমি কিনেছেন। যার দলিলমূল্য ৪৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা। বিলকিসের নামে পুটখালীর ১১০ নম্বর মৌজায় আরও ৯ শতাংশ জমি আছে। ওই জমির দাম ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা। শার্শার ছোটআঁচড়া মৌজায় নাসির উদ্দিন তার ভাই ওলিয়ার রহমানের নামে শূণ্য দশমিক ৪০ শতক জমি রয়েছে। এছাড়াও ওই তালিকায় তাদের নামে থাকা একাধিক গাড়ির তথ্য যুক্ত করা হয়েছে।
সম্পদ ক্রোকের তালিকায় স্বর্ণ চোরাচালান চক্রের অন্যতম সদস্য শার্শার পুটখালির রেজাউল করিম, রমজান আলী, সেলিম হোসেন, রুহুল আমিন, নাজমুল হোসেন ও আনিছুর রহমানের নাম রয়েছে। সিআইডির অনুসন্ধানে যে পরিমাণ সম্পদের বিবরণী তুলে ধরা হয়েছে, ওই চক্রটি বাস্তবে আরও বহুগুণ বেশি সম্পদের মালিক।
এ বিষয়ে নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক শার্শার একাধিক ব্যবসায়ী ও রাজনীতিকের ভাষ্য, গরুর খাটাল ও স্বর্ণ চোরাচালানের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা হাতিয়েছে নাসির ও তার সহযোগিরা। তারা আওয়ামী লীগেরা শীর্ষ নেতা ও প্রশাসনের কর্তাদের বিশেষ ব্যবস্থায় ম্যানেজ করে চালিয়েছে সিণ্ডিকেট। ফলে তাদের প্রকৃত সম্পদ কত সেটি অনুমান করা কঠিন। ক্রোকের তালিকায় থাকা সম্পদের পরিমাণ যতসামান্য বটে।’
অস্ত্র কারবারি নাসির:
২০২৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর দুটি বিদেশি পিস্তল, একটি ওয়ান শুটারগান, তিনটি রিভলভার ও ১৯ রাউন্ড গুলিসহ র্যাবের হাতে গ্রেফতার হন নাসির উদ্দিন। এর আগে ২০২২ সালের ২৭ অক্টোবর নাসিরের বাড়ি থেকে দুটি ওয়ান শুটারগান, এক রাউন্ড গুলি ও একটি মোবাইল ফোন উদ্ধার করে র্যাব। র্যাব দাবি করে, নাসির উদ্দিন মোস্ট ওয়ান্টেড স্বর্ণ ও অস্ত্র চোরাকারবারি। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় স্বর্ণ চোরাচালান, অস্ত্রসহ এক ডজন মামলা রয়েছে।