# চরমোনাই ও জামায়াত আমিরের শোক
বাংলার ভোর প্রতিবেদক
রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলনের মহাসমাবেশে অংশ নিতে যাওয়ার পথে মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরে পাঁচজন নিহত হয়েছেন। যশোর থেকে যাওয়া নেতাকর্মীদের বহন করা একটি বাস শুক্রবার রাতে মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলায় ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে একটি ট্রাককে ধাক্কা দেয়। এতে ৫জন নিহত ও বাসের অন্তত ৩০ জন যাত্রী আহত হয়েছেন। নিহত পাঁচজনের বাড়িই যশোর সদর উপজেলার নওয়াপাড়া ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে। এতে নিহতদের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। তাদের এমন মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে সমগ্র ইউনিয়নে।
স্বজনেরা জানান, সংস্কার, জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার ও পিআর (আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের দাবিতে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসমাবেশ ছিলো শনিবার। সমাবেশ যোগ দিতে শুক্রবার রাতে দুটি রিজার্ভ বাসে ওঠেন যশোরের নওয়াপাড়া ইউনিয়ন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নেতাকর্মীরা। হামদান এক্সপ্রেস নামে একটি পরিবহনে অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী নিয়ে পরিবহনটি ছাড়ে শুক্রবার রাত ১০টার দিকে। ইউনিয়নের ঝুমঝুমপুর পাগলাদাহ বিহারি মোড় থেকে ছেড়ে যাওয়া বাসটি ঢাকা যাওয়ার পথে শনিবার ভোরে এক্সপ্রেসওয়ের সিংপাড়া-নওয়াপাড়া ও হাসাড়া ব্রিজ-২-এর মধ্যবর্তী স্থানে পৌঁছালে চলন্ত এক ট্রাকের পেছনে ধাক্কা দেয়। এতে উভয় যানবাহন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এক্সপ্রেসওয়ের মাঝখানের সড়ক দ্বীপে রেলিংয়ের সঙ্গে আলাদাভাবে ধাক্কা খায়। এ দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই মারা যান ৫ জন।
পুলিশ ও শ্রীনগর ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আহত ব্যক্তিদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়।
নিহতরা হলেন যশোর সদরে নওয়াপাড়া ইউনিয়স ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সভাপতি ও পাগলাদাহ গ্রামের পল্লীচিকিৎসক জালাল উদ্দিন (৬৫), একই ইউনিয়নের মধুগ্রামের জিল্লুর রহমান (৬৫), শেখহাটি ঘুরুলিয়া এলাকার বাসিন্দা ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জেলা কমিটির মহিলা ও পরিবার কল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক গোলাম মোস্তফা (৫৫), নওয়াপাড়া ইউনিয়ন ইসলামী আন্দোলনের সদস্য ঘুরুলিয়া গ্রামের রওশন আলী ও বাসচালকের সহকারী পাগলাদাহ গ্রামের মো. বাপ্পির ছেলে হাসিব উদ্দিন (৩২)।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের খুলনা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মো. সোয়াইব হোসেন বলেন, সংস্কার, জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার ও পিআর (আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের দাবিতে আজ (শনিবার) ঢাকায় ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসমাবেশ ছিল। সমাবেশ যোগ দিতে শুক্রবার রাতে রিজার্ভ বাসে রওনা হন যশোরের নওয়াপাড়া ইউনিয়ন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নেতাকর্মীরা। হামদান এক্সপ্রেস নামে একটি পরিবহনে অর্ধশতাধিক নেতাকমী ছিল। পথিমধ্যে রাত ৩টার পর দুর্ঘটনার শিকার হয় একটি বাস। ওই বাসের যাত্রী ও হেলপারসহ ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন আরও অন্তত ৩০জন। নিহত চারজনের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর হয়েছে। নিহতদের মধ্যে চারজন আমাদের সংগঠনের নেতাকর্মী। আরেকজন বাসের সহকারী।
দুর্ঘটনায় নিহত জালাল উদ্দিনের বাড়ি যশোরের নওয়পাড়া ইউনিয়নের পাগলাদাহ গ্রামের পূর্বপাড়ায়। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যশোর সদর উপজেলার নওয়াপাড়া ইউনিয়নের সভাপতি তিনি। পাশাপাশি স্বনামধন্য হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক।
ফলে এলাকায় সর্বজন সম্মানিত ব্যক্তি তিনি। দুর্ঘটনায় কবলিত বাসটির নেতৃত্বও দিচ্ছিলেন তিনি। শনিবার দুপুরে পাগলাদাহ গ্রামের পূর্বপাড়াতে প্রবেশ করতে দেখা যায় সড়কের উপরেই সামিয়ানা টাঙাচ্ছেন কয়েকজন যুবক। কেউ কবর খুঁড়ছেন।
কেউবা কয়েকটি বড় হাড়িতে পানি গরম করছেন। সড়কের উপরে সারিবন্ধভাবে রাখা চেয়ারে বসে আছেন গোটা বিশেক মানুষ। বাড়ি ভিতরে নারীদের কান্নার আহজারি। নিহত জালালের বাড়িতে বসে আহাজারি করতে দেখা যায়, বাসটিতে থাকা আইতুল্লাহ নামে সংগঠনটির এক কর্মী। তার বাড়িও পাগলাদাহ গ্রামেই। বাসে আহত হওয়ার পর প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তিনি বাড়িতে চলে আসেন।
আহতুল্লাহ জানান, ‘সমাবেশ যোগ দেয়ার জন্য ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা থেকে হামদান এক্সপ্রেস নামে একটি পরিবহন রিজার্ভ করে রওনা দেন ইসলামী আন্দোলনের ইউনিয়নের নেতাকর্মীরা। বাসে থাকা বেশিরভাগ নেতা বয়স্ক। বাসে উঠে ঘুমিয়ে পড়ি। মাঝে মহাসড়কের পাশে একটি দোকানে সবাই নেমে চা বিস্কুট খাই। পরে আবার গাড়িতে উঠে সিংপাড়া-নওয়াপাড়া ও হাসাড়া ব্রিজ-২-এর মধ্যবর্তী স্থানে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
এই প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য, হামদান এক্সপ্রেস চলন্ত এক ট্রাকের পেছনে ধাক্কা দেয়। এতে বাসটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এক্সপ্রেসওয়ের মাঝখানের সড়ক দ্বীপে রেলিংয়ের সঙ্গে আলাদাভাবে ধাক্কা খায়। এ দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই মারা যান দুইজন। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও দুইজন মারা যান।
কান্নাজড়িত কন্ঠে তিনি জানান, এই দুর্ঘটনার দৃশ্য দেখা যায় না। কারোও মাথার মগজ বের হয়ে গেছে। কারোও পা নেই। রক্তাক্ত। আমার আর বলার ভাষা নেই।’
নিহতের জালালের বড়ভাই মাকসুদুর রহমান জানান, ‘এলাকায় আলেম ও চিকিৎসক হিসাবে সম্মানিত মানুষ জালাল। ভোররাতে সমাবেশে যাওয়ার পথে সে ও তার কর্মীরা দুর্ঘটনায় নিহতের খবরে আমরা ভেঙ্গে পড়েছি। এলাকায় শোকের মাতম চলছে।
# পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছিলেন হেলপার হাসিব
দুর্ঘটনায় প্রথমে গুরুতর আহত হন হামদান এক্সপ্রেসের হেলপার হাসিব। পরে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে। একটি দুর্ঘটনায় ছোটবেলাতে পিতা বাপ্পিকে হারান হাসিব। গার্মেন্টস কাজ করে হাসিবকে বড় করেন মা শায়লা বেগম। এখন তিনিও বয়সের ভারে নানা রোগে অসুস্থ। এখন অসুস্থ মা, স্ত্রী ও বছর আড়াইয়ের একটা কন্যা শিশু রয়েছে। পরিবারের হাল ধরতে কিছুদিন আগে হেলপারের চাকুরি নেয় হাসিব। দুর্ঘটনায় কলিজার একমাত্র ধন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলেকে হারিয়ে পাগল প্রায় মা ও স্ত্রী ও হাসিবের স্বজনেরা। হাসিবের শাশুড়ি মর্জিনা বেগম বলেন, ‘হাসিবই ছিলো সব। এভাবে তার প্রাণ দিতে হবে জানতাম তাহলে বাসে চাকুরি নিতে দিতাম না। আমাগের এখন কি হবে। তার মেয়েটার কি হবে। তারে হারিয়ে তো আমরা অর্থই সাগরে পড়ে গেলাম। এখন আমাদের কি হবে।’ পাশেই আড়াই বছরের শিশুটিকে নিয়ে বারবার মুর্ছা যাচ্ছিলেন হাসিবের স্ত্রী।
এসময় তিনি বলেন, ‘শুক্রবার রাতে একবার কথা হয়েছিলো। বলেছিলো, যেহেতু হুজুরদের প্রগ্রাম, শেষ না হলে আর ফিরা হবে না। তবে সে যে আর ফিরবে না, সেটা তো বলেনি। এখন আমার মেয়েটার কি হবে, আমার কি হবে.. বলে মুর্ছা যান তিনি।’
যশোর কোতয়ালী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল হাসনাত জানান, ‘গণমাধ্যমে শুনেছি যশোরের চারজন নিহত হয়েছে। পুলিশের সদস্যরা নিহতের বাড়িতে গিয়েছিলেন। এক ইউনিয়নে চারজন নিহতে শোকের মাতম বইছে।’
দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনায় শোক জানিয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। ফেসবুক পোস্টে দেওয়া শোকবার্তায় তিনি লেখেন, ‘আজ ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসমাবেশে যোগ দিতে আসা যশোরের একটি বাস মাওয়া এলাকায় দুর্ঘটনার শিকার হয়। এই দুর্ঘটনায় মহান আল্লাহর ৪ জন বান্দা ইন্তিকাল করেছেন। মহান রাব্বুল আলামিন তাদের শহীদ হিসেবে কবুল করুন। আরও কতিপয় ব্যক্তি আহত হয়েছেন। মহান আল্লাহ তাদেরও সুস্থতার নিয়ামত দান করুন। আমিন।’
এদিকে রাতে শোকবার্তায় ইসলামী আন্দোলনের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম বলেছেন, মহাসমাবেশে অংশ নিতে আসার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় শাহাদাতবরণ করেছেন। যা অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও হৃদয়বিদারক। তাদের রুহের মাগফিরাত কামনা করছি এবং শোকাহত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।