বিশেষ প্রতিনিধি
আমাদের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম শিশুদের জন্যে রম্য একটি ছড়া লিখেছিলেন, নাম-‘লিচু চোর’। জীবনঘনিষ্ঠ, চিত্রময় এই ছড়ায় শিশুদের দুরন্তপনা ও কৌতুহল একটি নির্দিষ্ট ঘটনায় মিলিত হয়। তিনি শুরু করেছিলেন, ‘বাবুদের তাল-পুকুরে/ হাবুদের ডাল-কুকুরে/সে কী বাস করলে তাড়া,/বলি থাম একটু দাঁড়া’। এখানে কবি একটি তালপুকুরের কথা বলেছেন।
তালপুকুর বিষয়ে বলতে গিয়ে ড. মোহাম্মদ আমীন বলেছেন, সংস্কৃত তাল এবং বাংলা পুকুর শব্দের সমন্বয়ে তালপুকুর (তাল+পুকুর) শব্দটি গঠিত। অভিধানমতে, বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত তালপুকুর অর্থ চারদিকে তালগাছ ঘেরা পুকুর; এমন কোনো জলাশয় যা তালপুকুর নামে পরিচিত।
আবার বাংলায় একটা প্রবচন রয়েছে, ‘ঘটি ডোবে না নামে তালপুকুর’। এই প্রবচনের অর্থ হচ্ছে- যোগ্যতাহীনের অহংকার।
কিন্তু যশোরের পল্লীতে এমন একটি তালপুকুর আছে, যেখানে শুষ্ক সময়েও ‘দুই মানুষ সমান’ পানি থাকে। এই পুকুরে গোসল করে গ্রামের শত শত মানুষ। গভীরতার কারণে শিশুরা পুকুরের ধারেই সাঁতার কাটে। মাঝামাঝি যেতে সাহস পায় না।
তালপুকুরটির অবস্থান যশোর সদর উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের চাঁদপাড়া গ্রামে। প্রায় ৬ বিঘা আয়তনের এই পুকুরটি নিয়ে রয়েছে নানা গল্প।
স্থানীয়রা জানান, পুকুরটির চারধারে একসময় প্রচুর তালগাছ ছিল। তালগাছ বেষ্টিত ছিল বলেই এই পুকুরের নামকরণ করা হয় তালপুকুর।
এই অঞ্চলের মানুষের পানীয়জল, গোসল, কাপড় কাঁচার জন্যে ব্যবহার করা হতো পুকুরটি। পুকুরের চারধারে যেমন ছিল তালগাছ, তেমনই আশপাশে ছিল ঝোপঝাড়। কথিত আছে, সেই ঝোপে দেখা মিলতো বুনো শুয়োর এমনকি বাঘেরও। আর রাতে এই পুকুরের পানিতে দেখা মিলতো সোনার থালা! যদিও এসবের ঐতিহাসিক কোনো ভিত্তি মেলেনি।
যশোর-নড়াইল সড়কের পাশ দিয়ে গ্রামের দিকে চলে গেছে একটি পাকা রাস্তা। এই রাস্তা ধরে সামান্য এগুলেই বাম হাতে ফতেপুর ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়। তার আগে ইউনিয়ন স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র। আর ইউনিয়ন পরিষদের গা ঘেঁষে ইউনিয়ন ভূমি অফিস।
ইউনিয়ন স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র ও ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের ঠিক পেছনেই তালপুকুরটির অবস্থান। সম্প্রতি তালপুকুরটি খনন করা হয়েছে। পুকুরের তিন ধারে (পশ্চিম, পূর্ব ও উত্তর দিকে) তৈরি করা হয়েছে সুবিশাল সিঁড়ি। বিকেলে অনেকেই পুকুরের ধারে সময় কাটান। তাছাড়া গোসলের কাজ তো করেনই গ্রামের লোকজন।
এই ইউনিয়নের গ্রামপুলিশ পঞ্চাশোর্ধ্ব মহানন্দ বিশ্বাসের বাড়ি পাশের নালিয়া গ্রামে। তিনি বলেন, বাবা-দাদারা তো স্নান করতেনই, আমিও করেছি ছোটবেলায়। সেই সময় এতো গভীর ছিল ছিল না। কিন্তু জল থাকতো। সেই জলে কচুরিপানা থাকতো। স্নান করতে এসে মাছ ধরেছি কতো। ছিপ (বড়শি), জাল দুটো দিয়েই মাছ ধরতাম। এখানে তখন কই, জিয়ল (শিংমাছ), ট্যাংরা, পুঁটি, চিংড়ি, রুই, কাতল মাছ পাওয়া যেতো।
স্মৃতি হাতড়ে তিনি বলেন, এই পুকুরের পাড়ে বড় বড় তালগাছ ছিল। সম্ভবত সেই কারণে এই পুকুরের নাম তালপুকুর বলতো সবাই। এখন তালপুকুর মানেই এই পুকুরটি। খননের পর এখনো ৮-১০ ফুট গভীর পানি আছে পুকুরে।
চাঁদপুর গ্রামের বাসিন্দা বয়োজ্যেষ্ঠ মোফাজ্জেল হোসেন বলেন, তালপুকুরটি অনেক পুরনো। বাবা-দাদাদের কাছে শুনেছি, ১৯৬০ সালের আগে এই পুকুরটি ছোট ছিল। চারধারে ছিল বিশাল তালগাছ। তাছাড়া আশপাশে ছিল ঝোপঝাড় আর গাছপালা। পাখ-পাখালি আর বুনোপশুর অভয়ারণ্য।
তিনি বলেন, আমার বাবা মকবুল হোসেন পাকিস্তান আমলে এই কাউন্সিলের মেম্বার ছিলেন। সেই সময় কাউন্সিল অফিস অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার কথা হচ্ছিল। তখন (১৯৬০ সালের দিকে) আমার দাদা ও তার জ্ঞাতিরা এখানে কাউন্সিলের জন্যে জমিদান করেন। সেই জমিতেই কাউন্সিল (ইউনিয়ন পরিষদ) অফিস। তহশিল অফিসের জন্যে আমার দাদি কিছু জমি দেন।
তিনি বলেন, পাকিস্তান আমলে এই পুকুরটি সংস্কার করে বড় করা হয়। সেই সময় তালগাছগুলো কেটে ফেলা হয়। এখন জনবসতির কারণে সেই ঝোপঝাড় আর নেই।
এই পুকুরে আমরা সাঁতার কেটেছি, মাছ ধরেছি। মা-চাচিরা এই পুকুর থেকে পানি নিতেন রান্নার কাজে। আশপাশের বহু গ্রামের মানুষ আসতেন গোসল করতে।
তার কথার সাথে সম্মতি জানান ছোটভাই শামীম আহমেদ। তিনি বলেন, এখনো পাশের হামিদপুর, ঝুমঝুমপুর, সুলতানপুর, বাউলিয়া গ্রাম থেকে লোকজন মোটরসাইকেল নিয়ে আসেন গোসল করতে, পুকুরের ধারে বসে বিশ্রাম নিতে।
আব্দুর রহিম জানান, ছেলেবেলায় এই তালপুকুরেই গোসল করেছি। এখনো মাঝেমধ্যে করি। অনেকের বাড়ি টিউবওয়েল থাকায় বৌ-ঝিরা এখন কমই আসে। তবে, পুকুরের ধারে যাদের বাড়ি তারা নিয়মিতই গা গোসলের জন্যে আসে।
তিনি জানান, পুকুরের ধারে অনেক তালগাছ ছিল। পাশে গভীর বন। পাখপাখালির সাথে সাথে এখানে বাঘ লুকিয়ে থাকতো বলে মুরব্বিদের কাছে শুনেছেন।
ইউনিয়ন পরিষদ লাগোয়া একটি চা-মুদির দোকান। ইমন হোসেন নামে এক যুবক এই দোকানের মালিক। তিনি বলেন, এলাকার মুরব্বিরা ভালো বলতে পারবেন। তবে, আমিও শুনেছি-তালপুকুরের পাশে ঘন বন ছিল। সেখানে বাঘও দেখেছেন মুরব্বিদের কেউ কেউ।
এই বিষয়ে ফতেপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিসের সহকারী কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, পুকুরটির একটি অংশ ভূমি অফিসের আর বেশিরভাগ অংশ ইউনিয়ন পরিষদের মালিকানায়। এখানে যাতে গ্রামের লোকজন গা গোসল করতে পারেন, সে কারণে তিন পাশে সিঁড়ি করে দেয়া হয়েছে। তালপুকুরের নামকরণের বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না বলে জানান।
ফতেপুর ইউনিয়ন পরিষদের সবশেষ চেয়ারম্যান শেখ সোহরাব হোসেন বলেন, এই তালপুকুরটি বেশ পুরনো। কতো আগের, তা বলতে পারবো না। স্থানীয় মুরব্বিরা বিষয়টি বলতে পারবেন। তবে, এই পুকুরে সবসময়ই পানি থাকে।