স্বাধীন মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ, চৌগাছা থেকে ফিরে
যশোরের চৌগাছা উপজেলার ঐতিহ্যবাহী পীর বলুহ দেওয়ানের মেলা ঘিরে উৎসবের জনপদে পরিণত হয়েছে কপোতাক্ষ নদের তীরের গ্রাম হাজরাখানা। ১০দিন ব্যাপি গ্রামীণ মেলায় প্রতিদিন সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত ভক্ত-দর্শনার্থীর ঢল নামছে। প্রতিবছর ভাদ্র মাসের শেষ মঙ্গলবার পীর বলুহ দেওয়ান (র.) মাজারে ওরস ও গ্রামীণ মেলার আয়োজন হয়। এ বছরও ৯ সেপ্টেম্বর ১০ দিনব্যাপি মেলা শুরু হয়েছে। শত বছরের ঐতিহ্যবাহী মেলায় ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষ উৎসব আনন্দে মেতে ওঠে।
ভক্তদের বিশ্বাস, পীর বলুহ দেওয়ান অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। তার জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ছিল রহস্যজালে ঘেরা। তিনি ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার ধোপাদী গ্রামের ছুটি বিশ্বাসের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। তবে জন্মকাল সম্পর্কে আজও কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। তিনি তিনশ’ থেকে চারশ’ বছর আগে জন্মগ্রহণ করেন বলে ধারণা করা হয়। তার সম্পর্কে স্থানীয়দের মাঝে প্রচলতি রয়েছে নানা অলৌকিক জনশ্রুতি।
বিখ্যাত সেই বলুহ দেওয়ান স্মরণে যশোরের চৌগাছার নারায়ণপুর ইউনিয়নের হাজারখানা গ্রামে কপোতাক্ষ নদের পাড়ে শুরু হয়েছে ঐতিহ্যবাহী বলুহ দেওয়ানের ওরশ এবং গ্রামীণ মেলা। পীর বলুহ দেওয়ান (র.)-এর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ভাদ্র মাসের শেষ মঙ্গলবার থেকে শুরু হওয়া এই মেলা প্রায় দুইশ বছরের পুরোনো। এই মেলাকে ঘিরে হাজরাখানা গ্রাম এখন উৎসবের আমেজে মুখরিত।
সরেজমিনে দেখা যায়, চৌগাছা-মহেশপুর সড়কের হাজরাখানা গ্রামে ঢুকতে পূর্বদিকে অভিমুখী সড়ক ধরে প্রায় দুই কিলোমিটার বসেছে মেলা। গ্রামীণ ঐতিহ্যের এই মেলায় রাস্তার দুই পাশে হরেক রকমের পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছে দোকানীরা। এখানে বাহারী খাবারের দোকান বসেছে। এর মধ্যে আছে বালিশ মিষ্টি, রসগোল্লা, বাতাসা, গজা, জিলাপী, বাদাম, পেঁয়াজু, পাপড় নানা রকম খাবার। সেই সাথে পাওয়া যাচ্ছে নানা ধরনের খেলনা, কসমেটিক্স সামগ্রি, গৃহস্থালি কাজে ব্যবহৃত নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এবং বিভিন্ন ধরনের আসবাবপত্র। বাঁশ ও বেতের তৈরি কুলা, ডালা, চালুনি থেকে শুরু করে কাঠের তৈরি পিঁড়ি, জলচৌকি এবং মাটির হাঁড়ি, পাতিল, খেলনাও মেলায় পাওয়া যাচ্ছে।
বিনোদনপ্রেমীদের জন্যও রয়েছে চমৎকার ব্যবস্থা। নাগরদোলা, ড্রাগন ট্রেন, স্লিপার, জাম্পার, ভূতের বাড়ি এবং নৌকা দোলার মতো মাধ্যমগুলো সকল বয়সী মানুষের মন জয় করছে।
দূর দূরন্ত থেকে পণ্য বিক্রি করতে আসা দোকানিরা বলছেন, মেলার মাঠের পরিবেশ ভালো। প্রত্যেক বছর তারা দোকান নিয়ে বসেন এখানে। তারা আশা করছেন, এবছর মেলায় কেনাবেচা ভালো হবে।
স্থানীয়রা বাসিন্দা মিঠু আহমেদ বলেন, বলুহ দেওয়ানের মেলা উপলক্ষে হাজারখানা গ্রামে আনন্দের জোয়ার নেমে আসে। গ্রামের মেয়েরা শ্বশুরবাড়ি থেকে বাবার বাড়িতে ফিরে আসেন। প্রতিটি বাড়িতেই আত্মীয়-স্বজনের ভিড় জমে। বহু বছরের পুরোনো এই মেলা নিয়ে এলাকায় উচ্ছ্বাসের শেষ নেই।’
মেলার মাঠে আসা নূর মোহাম্মদ বলেন, সরকারি ছুটির দিনে মেলার মাঠে এসেছি। স্বপরিবারে মেলার মাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছি। মেলার পরিবেশ অনেক ভালো। বাচ্চার জন্য খেলনা কিনেছি। আমরা ঘোরাঘুরি করছি, খাওয়া দাওয়া করেছি। অনেক ভালো লাগছে।
শান্তা ইয়াসমিন নামে অন্য এক দর্শনার্থী বলেন, মেলা মানেই তো আনন্দ। অনেক মানুষের সমাগম হয়। বলুহর মেলায় আমরা প্রতিবছর আসি। এখানে অনেক দোকান বসেছে। এখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসসহ অনেক খাবারের আইটেম পাওয়া যাচ্ছে। নাগরদোলা চড়েছি। নদীতে স্প্রিড বোড চড়লাম। অনেক মজা করেছি পরিবারের সবাই মিলে।
ঢাকা থেকে খেলনা বিক্রি করতে আসা ইয়াছিন আরাফাত বলেন, এ বছর প্রথম যশোরের এই মেলায় এসেছি। অনেকের মুখে এই মেলার নাম শুনেছি। শুরুর দিকে ভালোই লোক সমাগম হচ্ছে। আশা করছি এ বছর ভালো কেনা বেচা হবে।
মোহন ঘোষ নামে এক মিষ্টির দোকানি বলেন, ১৬ বছর ধরে এই মেলায় মিষ্টি বিক্রি করতে আসি। মেলা শেষে আবার নিজ জেলা নড়াইলে চলে যায়। প্রতিবছর কেনাবেচা ভালো হয়। এ বছর মানুষের ভিড় বেশি। কিন্তু তেমন কেনাবেচা হচ্ছে না। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কেমন কেনাবেচা হয়।
মেলার মাঠে শান্তি শৃংখলা বজায় রাখতে স্থানীয় ভাবে মেলা পরিচালনা কমিটি তৈরি করা হয়েছে। পুলিশ ও আনসার বাহিনির সাথে কাজ করছে স্বেচ্ছাসেবক টিম।
মেলা পরিচালনা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক বাবুল আক্তার বলেন, এবছর বলুহ দেওয়ান মেলায় ৫ শতাধিক দোকান বসেছে। এখনও পর্যন্ত কোনো বিশৃংখলা বা অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটেনি। আমরা আশা করছি, কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই সুষ্ঠ ও শান্তিপূর্ণ ভাবে ১০ দিনব্যাপি এই মেলা শেষ হবে।