রেহানা ফেরদৌসী
এতিম বলতে মূলত ১৮ বছরের কম বয়সী এমন একটি শিশুকে বোঝানো হয় যে তার মা-বাবা একজন বা উভয়কেই হারিয়েছে। যে সমাজে পারস্পরিক সহানুভূতিশীল ও বন্ধুভাবাপন্ন সম্প্রীতি বজায় থাকে, সে সমাজে এতিমের সঙ্গে কঠোর ও রূঢ় আচরণ হয় না ।আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘(হে নবি) আপনি এতিমের প্রতি কঠোর হবেন না।’ (সুরা দুহা, আয়াত-৮)
এতিমের কষ্ট মূলত তার মাতা-পিতার স্নেহ ও সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত হওয়া, যা তাকে সমাজে একা ও অসহায় করে তোলে। এতিম শিশুরা প্রায়শই আর্থিক, মানসিক ও সামাজিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয় এবং তাদের বেড়ে ওঠার জন্য বিশেষ সহানুভূতি ও সমর্থনের প্রয়োজন। ইসলামে এতিমের প্রতি যত্ন নেওয়াকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয় এবং তাদের প্রতি কোনো অবিচার করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এতিমদের প্রতি যে সম্পদ ব্যয় করবে তা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই হওয়া উচিত।
ইরশাদ হয়েছে, ‘ তারা আহারের প্রতি আসক্তি সত্ত্বেও (আল্লাহর ভালোবাসায়) অভাবী, এতিম ও বন্দিকে আহার্য দান করে, (এবং তারা বলে) শুধু আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই তোমাদের আহার্য দান করি। বিনিময়ে তোমাদের থেকে কোনো প্রতিদান চাই না।’ (সুরা দাহর, আয়াত-৮, ৯)।
সাহল বিন সাদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলাল্লাহ (সাঃ) বলেন, ‘আমি ও এতিম প্রতিপালনকারী জান্নাতে এভাবে থাকব [তিনি তর্জনী ও মধ্য অঙুলি দিয়ে ইঙ্গিত করেন এবং এ দুটির মধ্যে তিনি সামান্য ফাঁক করেন]।’ (বুখারি, হাদিস নং-৫৩০৪)।
তিনি আরো বলেন, ‘বিধবা, এতিম ও গরিবের সাহায্যকারী ব্যক্তি আল্লাহর পথে মুজাহিদের সমতুল্য। অথবা তার মর্যাদা সেই (নামাজের জন্য) রাত জাগরণকারীর মতো, যে কখনো ক্লান্ত হয় না। অথবা তার মর্যাদা সেই রোজাদারের মতো, যে কখনো ইফতার (রোজা ভঙ্গ) করে না।’ (মুসলিম, হাদিস নং- ৫২৯৫)
হাদিস শরিফে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি কোনো এতিমকে আপন মাতা-পিতার সঙ্গে নিজেদের (পারিবারিক) খাবারের আয়োজনে বসায় এবং (তাকে এই পরিমাণ আহার্য দান করে যে) সে পরিতৃপ্ত হয়ে আহার করে, তাহলে তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যাবে।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং-১৮২৫২)
অন্যত্র নবী (সাঃ) বলেছেন, ‘মুসলিমদের ঐ বাড়িই সর্বোত্তম, যে বাড়িতে এতিম আছে এবং তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা হয়। আর সবচেয়ে নিকৃষ্ট ঐ বাড়ি, যে বাড়িতে এতিম আছে অথচ তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা হয়।’ আমাদের প্রিয় নবী শিশুকালে এতিম ছিলেন। জন্মের পূর্বেই পিতাকে হারান। তিনি সারাটি জীবন সমাজের এতিম অসহায়দের জন্য কাজ করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘তারা তোমাকে এতিম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। বলে দাও, তাদের ইসলাহ তথা সুব্যবস্থা (পুনর্বাসন) করা উত্তম।’ (সুরা বাকারা, আয়াত-২২০) অন্যত্র আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘পিতৃহীনদেরকে পরীক্ষা করতে থাকো, যে পর্যন্ত না তারা বিবাহযোগ্য হয়। অতঃপর তাদের মধ্যে ভালো-মন্দ বিচারের জ্ঞান দেখলে, তাদের সম্পদ তাদেরকে ফিরিয়ে দাও। তারা বড় হয়ে যাবে বলে অপচয় করে ও তাড়াতাড়ি করে তা ভক্ষণ করো না। যে অভাবমুক্ত, সে যেন যা অবৈধ তা থেকে নিবৃত্ত থাকে এবং যে বিত্তহীন, সে যেন সঙ্গত পরিমাণে ভোগ করে। আর তোমরা যখন তাদেরকে তাদের সম্পদ সমর্পণ করবে, তখন তাদের ওপর সাক্ষী রেখো। হিসাব গ্রহণে আল্লাহই যথেষ্ট।’ (সুরা নিসা, আয়াত-৬)।
নবী (সা.) শিশুদের অনেক ভালোবাসতেন। ভালো ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের উন্নত নৈতিক শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করতেন। বিশেষত অনাথ-এতিম শিশুদের প্রতি তার এই স্নেহ-ভালোবাসা ছিল অন্য মাত্রার। কেননা, নবিজি (সা.) নিজেও একজন এতিম ছিলেন। পিতার পর মাত্র ছয় বছর বয়সে মা আমেনাও দুনিয়া ত্যাগ করেন। ফলে অতি অল্প বয়সেই তিনি পিতা-মাতার ছায়া থেকে বঞ্চিত হন। শৈশবকালেই তিনি আশ্রয় নেন দাদা আবদুল মুত্তালিবের কাছে, তবে এই আশ্রয়ও বেশিদিন স্থায়ী হয়নি, দুই বছর যেতে না-যেতেই অর্থাৎ মাত্র আট বছর বয়সেই দাদাকেও হারান। এরপর তিনি চাচা আবু তালিবের স্নেহ-ছায়াল লালিত-পালিত হন।
এজন্য কোরআনে আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় হাবিবকে (সা.) স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘আল্লাহ কি আপনাকে এতিম অবস্থায় পাননি, অতঃপর তিনি আপনাকে আশ্রয় দিয়েছেন?’(সুরা দুহা, আয়াত: ৬)। এই আয়াত নবিজির জীবনের শুরুটা স্পষ্টভাবে তুলে ধরে। এতিমই ছিল তার প্রথম পরিচয়, আর আল্লাহর দয়া ও মানুষের ভালোবাসা ছিল তার আশ্রয়।
ইসলাম এতিমদের মর্যাদা ও তাদের অধিকারের প্রতি অত্যধিক গুরুত্বারোপ করেছে। কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর লোকেরা আপনাকে এতিমদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে; বলুন, তাদের জন্য সুব্যবস্থা করা উত্তম। তোমরা যদি তাদের সাথে একত্রে থাকো, তবে তারা তো তোমাদেরই ভাই। আল্লাহ জানেন কে উপকারকারী এবং কে অনিষ্টকারী।’ (সুরা বাকারা: ২২০)
অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যে ব্যক্তি এতিমের অর্থ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করে, সে তার পেটকে আগুনে পূর্ণ করে, শীঘ্রই সে জাহান্নামে যাবে।’(সুরা নিসা: ৬)
এতিমের সঙ্গে কঠোর ও রূঢ় আচরণ ইসলামে নিষিদ্ধ। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তুমি এতিমের প্রতি কঠোর হয়ো না, ভিক্ষুককে ধমক দিও না, এবং তোমার রবের নেয়ামতের কথা বর্ণনা করো।’(সুরা দুহা: ৯-১১)
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, এক ব্যক্তি নবিজির (সা.) কাছে এসে বললো, হে আল্লাহর রাসুল, আমার হৃদয় কঠিন হয়ে গেছে। নবিজি (সা.) বললেন, তুমি যদি চাও তোমার হৃদয় কোমল হোক, তবে এতিমের মাথায় হাত বুলাও এবং মিসকিনকে খাবার দাও। (আল-মু’জামুল কাবির: ২৮৭১) মহানবি (সা.) এর শিক্ষা হচ্ছে, এতিম হলো আমাদের সন্তানদের মতো, তাদের ভালোবাসা, সুরক্ষা ও শিক্ষার দায়িত্ব সমাজের প্রতিটি মানুষের।
মহানবি (সা.) আরও বলেন, বিধবা, এতিম ও গরিবের সাহায্যকারী ব্যক্তি আল্লাহর পথে মুজাহিদের সমতুল্য। অথবা তার মর্যাদা সেই (নামাজের জন্য) রাত জাগরণকারীর মতো, যে কখনো ক্লান্ত হয় না। অথবা তার মর্যাদা সেই রোজাদারের মতো, যে কখনো ইফতার (রোজা ভঙ্গ) করে না। (সহিহ মুসলিম: ৫২৯৫)
এতিম শিশুরা খুশি হয় যখন কেউ তাদের দেখতে এবং তাদের সাথে খেলতে আসে। অনেক শিশুরই গুরুতর রোগ বা বিকাশগত সমস্যা থাকে কিন্তু ঠিক আমাদের সন্তানের মতোই তারাও ভালোবাসা অনুভব করতে চায়। বস্তুত এতিম হওয়া আল্লাহর বিশেষ পরীক্ষার একটি অংশ। আর এতিমদের প্রতি দয়া করা হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের অন্যতম পথ। তা ছাড়া এতিমরা হলো সমাজের সবচেয়ে অসহায় শ্রেণি। তাদের প্রতি ভালোবাসা ও যত্ন নেওয়া মানবিক কর্তব্য ও ইমানের দাবি। অতএব, এতিমদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া প্রত্যেক মানুষ তথা মুসলিমদের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
লেখক : সহ সম্পাদক, সমাজকল্যাণ বিভাগ,
পুলিশ নারী কল্যাণ সমিতি
(কেন্দ্রীয় পুনাক)