কাজী নূর
‘আমাগে মতো মানষির খায়ি পরি বাঁচি থাকা দায়। আজ ইডা তো কাল উডার দাম বাড়তি থাকে। বাজারে আইসি দেকতিছি তেলের দাম বাড়ি গেছে। কন দিন তেলের দাম ইরাম বাড়লি আমাগের মতো গরিব মানুষ খাবো কি?’
শুক্রবার সকালে সরেজমিনে যশোর বড় বাজার হাটখোলা রোডে গেলে সাংবাদিক পরিচয় শুনে এমন প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন মধ্যবয়সী নারী সালেহা সুলতানা। সালেহা সুলতানা আরো বলেন, স্বামী ও ছোট দুই সন্তানকে নিয়ে কয়েক বছর পূর্বে সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর ছেড়ে যশোরে এসেছেন রুটি রুজির সন্ধানে। নির্মাণ শ্রমিক স্বামী ভুট্টা খানের কাজ অনিয়মিত। আর সালেহা কাকডাকা ভোর হতে সন্ধ্যা অব্ধি শহরের ঘোপ এলাকায় বাসা বাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। স্বামী-স্ত্রী দুজনের স্বল্প আয়ে চারজনের সংসারে চালাতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয় বলে জানান সালেহা।
সালেহাদের এমন গল্প আমাদের সমাজে যদিও নতুন কিছু নয়। তবে দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতির নির্মমতার যাতাকলে রোজ পিষ্ট হয় সালেহাদের মতো মানুষেরা।
শুক্রবার যশোর বড় বাজার হাজী মোহাম্মদ মহসিন রোড ঘুরে দেখা গেছে, সব রকম ভোজ্যতেলের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে খোলা সয়াবিন তেল ১৯৫ থেকে ২০০ টাকা কেজি, বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৯০ টাকা লিটার, পাম তেল ১৮০ টাকা কেজি, সরিষার তেল ২৩০ থেকে ২৫০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। হাটখোলা রোডের মুদি ব্যবসায়ী দেব এন্টারপ্রাইজের মালিক গোবিন্দ কুমার পাল জানান, কয়েকদিন আগে হঠাৎ করে ড্রাম প্রতি তেলের দাম বৃদ্ধি পায়। তবে স্টক থাকা পর্যন্ত আগের কেনা অনুযায়ী আমরা তেল বিক্রি করছি।
সব রকম তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি জানান, তেলের বাজার নিয়ন্ত্রিত হয় চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ থেকে। তবে পাইকাররা আংশকা প্রকাশ করে বলেছেন তেলের দাম আরো বৃদ্ধি পেতে পারে।
সবজির বাজার ঘুরে দেখা গেছে বর্তমানে অধিকাংশ সবজির দাম স্থিতিশীল রয়েছে। তবে গ্রীস্মকালীন কিছু সবজি ও আগাম শীতকালীন সবজির সরবরাহ হঠাৎ তলানিতে নেমেছে। জানতে চাইলে সবজির পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা আইয়ুব আলী জানান, আমার বাড়ি মণিরামপুর হওয়ার স্থানীয় মোকাম থেকে আমি তরকারি সংগ্রহ করে রোজ যশোর বড় বাজারে আনি। কিন্তু গ্রীস্মকালীন কিছু সবজি যেমন, উচ্ছে, করলা, ঢেড়স ইত্যাদি শেষের পথে। এ জাতীয় সবজির সরবরাহ কম থাকায় দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার আগাম শীতকালীন সবজির সরবরাহ গত সপ্তাহের তুলনায় এ সপ্তাহে তিন ভাগের দুই ভাগ নেই। স্বভাবতই আগাম শীতকালীন সবজির দাম বৃদ্ধি পাবে।
আইয়ুব আলী আরো বলেন, চাষিরা দাম বেশি পাওয়ার আশায় ক্ষেত থেকে মাল না তোলার কারণে এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। সপ্তাহের শেষ ভাগ থেকে আবার সরবরাহ বৃদ্ধি পেলে আগাম শীতকালীন সবজির দাম কমবে বলে জানান তিনি।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে বর্তমানে, ফুলকপি ১৮০ টাকা, শিম ১৮০ টাকা, বাঁধাকপি ১১০ টাকা, মূলা ২০ থেকে ৪০ টাকা, পুঁইশাকের মিচুড়ি ১২০ টাকা, কচুরলতি ৭০ টাকা, গাজর ১৩০ টাকা, বিটরুট ১৪০ টাকা, কাকরোল ৮০ টাকা, উচ্ছে ১০০ টাকা, মেটে আলু ১০০ টাকা, ঝিঙে ৪০ টাকা, জলপাই ৪০ টাকা, কুশি ৪০ টাকা, কলা ৪০ টাকা, পেঁপে ২০ টাকা, ধুন্দল ৪০ টাকা, ওল ৬০ টাকা, কুমড়ো ৪০ টাকা, কাঁচা মরিচ ১৪০ থেকে ১৬০ টাকা, মানকচু ৬০ টাকা, বরবটি ৬০ টাকা, ঢেরস ৭০ টাকা, পটল ৬০ টাকা, পুঁইশাক ২০ টাকা, বেগুন ৮০ টাকা, কচুর মুখি ২০ টাকা, টমেটো ৮০ টাকা, শষা ৪০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া শাপলা ফুল ১০ টাকা, সবুজ শাক ১৫ টাকা, পালং শাক ৪০ টাকা, শাকের ডাটা ৩০ টাকা আঁটি ও লাউ ৩০ থেকে ৪০, চাল কুমড়ো ৩০ টাকা পিস দরে বিক্রি হচ্ছে।
শহরের চৌরাস্তা থেকে আসা ইলেকট্রনিকস দোকানের কর্মচারী শরিফুজ্জামান জানান, বাজার আগের চেয়ে অনেক শান্ত। তবে মাছ ও তেলের দাম কমা উচিত।
মাছের বাজার ঘুরে দেখা গেছে বর্তমানে, ৩ কেজি সাইজের কাতলা ৩৫০ টাকা, ৩ কেজি ২০০ গ্রাম সাইজের কাতলা ৩৮০ টাকা, রুই আকারভেদে ২৮০-৩৬০ টাকা কেজি, দেড় কেজি সাইজের রুই ২৮০ টাকা, পাবদা ৪০০ টাকা, নাইলোটিকা ১৫০ টাকা, বেলে ১২০০ টাকা, দেশি কৈ ৭৫০ টাকা, চাষের কৈ ২২০ টাকা, পাঙাশ ২২০ টাকা, গলদা চিংড়ি ১১০০ থেকে ১২০০ টাকা, হরিণা চিংড়ি ৮০০ টাকা, পুঁটি ২৫০ টাকা, সরপুঁটি ১৮০ টাকা, বাইন ৮৮০ টাকা, টেংরা ৫৫০ টাকা, পারশে ৫৫০ থেকে ৬২০ টাকা, মায়া ২৮০ টাকা, সিলভার কার্প ২০০ টাকা, শিং ৪০০ টাকা ও টাকি ৪৮০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে।
মাছ ব্যবসায়ী মাহফুজুর রহমান বলেন, বাজার মাছের সরবরাহ বৃদ্ধি পেয়েছে। দাম কিছুটা বেশি তবে সব মাছ নয়। বাজার ঘুরে দেখেন তুলনামূলক আজ মাছের দাম কম।
মাছ কিনতে আসা শাহিন আজাদ বলেন, ভাই মাছের দাম আর কমল না। ইলিশ গেল তবুও কিনতে পারলাম না। আপনি ঘুরে দেখেন, মাছের গায়ে আগুন লেগেছে।
মুরগির বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বর্তমানে, ব্রয়লার মুরগি ১৮০ টাকা, সোনালী ২৬০ টাকা, লেয়ার ৩৩০ টাকা, দেশি ৫৫০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। সাদ্দাম ব্রয়লার হাউজের মালিক সাদ্দাম মোল্লা বলেন, দাম কম থাকায় মুরগি বিক্রি বেশ ভালো। আবার মাছের দাম বেশি হবার কারণে মুরগীর উপর চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে।
চালের পাইকারি ও খুচরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে বর্তমানে স্বর্ণা ৫২ টাকা, আটাশ ৫৬ থেকে ৫৮ টাকা, পায়জাম ৫৫ থেকে ৫৬ টাকা, মিনিকেট ৬০ থেকে ৬৬ টাকা, বাসমতী ৮০ থেকে ৮৪ টাকা, নাজিরশাইল ৮০ টাকা, কাজল লতা ৭০ টাকা ও সুবললতা ৬০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে।
চাল ব্যবসায়ী মা কালী ভান্ডারের মালিক অভিজিৎ সাহা বলেন, চালের দাম বৃদ্ধির কোন সম্ভাবনা নেই। তবে চালের দাম কম থাকলেও ক্রেতা সংকট রয়েছে। দেখছেন তো চুপচাপ বসে আছি।
অপরদিকে সব রকম ডাল এবং মুদি পণ্যের দাম অপরিবর্তিত থাকলেও গরম মসলার দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। বাজার ঘুরে দেখা গেছে বর্তমানে দেশি মসুর ১৪০ টাকা, মোটা মসুর ১০০ টাকা, সোনা মুগ ১৬০ টাকা, মোটা মুগ ১২০ টাকা, ছোলার ডাল ১১০ টাকা, সাদা চিনি ১০৫ টাকা, লাল চিনি ১৩০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া লাল ডিম আকার ভেদে ৩৬ থেকে ৪২ টাকা, সোনালী মুরগির ডিম ৪৮ টাকা, বড় বাদামি ডিম (প্যারেন্টস) ৪৮ টাকা, হাঁস ৬৮ টাকা, দেশি ৭২ টাকা ও কোয়েল ১০ টাকা হালি বিক্রি হচ্ছে। ডিমের পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা আনিস এন্টারপ্রাইজের পরিচালক সজিব হোসেন জানান, ডিমের দাম বৃদ্ধি নয় বরং কিছুটা কমতে পারে।