জুবায়ের তানবীর সিদ্দীকী (জয়)
 যশোর সহ দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের হৃদয়ে যে লোকটি নিজ যোগ্যতা, দক্ষতা ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে স্থান করে নিয়েছেন তিনি হচ্ছেন আমাদের অত্যন্ত কাছের মানুষ, বিএনপি’র জাতীয় স্থায়ী কমিটির সাবেক সদস্য, সাবেক মন্ত্রী তরিকুল ইসলাম। যিনি তার অসাধারণ কাজ, চিন্তা ও চারিত্রিক গুণাবলীর জন্য মানুষের মনে স্থায়ীভাবে স্থান করে নিয়েছেন। এজন্য তিনি ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন অনন্তকাল। একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে মানবসেবীদের মতো সারা জীবন করে গেছেন সাধারণ মানুষের সেবা। তার অবদান আজীবন কাল অন্যদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।
আমার ছাত্র রাজনীতি থেকে শুরু করে ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে জাতীয় এই নেতার সাথে আমার খুব কাছাকাছি থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। তার রাজনৈতিক কর্মকান্ডে আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে আমি স্বচক্ষে যতটুকু দেখেছি তার বর্ণনা এখানে শেষ করা সম্ভব না। আসলে তিনি ছিলেন জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক চিন্তা ধারার সুদূর প্রসারী একজন মহাপরিকল্পনাবিদ।
রাজনীতিতে তিনি ছিলেন এক আশার অনন্য নির্দেশনা। যশোরের রাজনীতিকে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন তৃণমূলে। একজন দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে যিনি সময় পেলেই গ্রাম গঞ্জের সাধারণ মানুষের সাথে মিশে যেতেন সহজভাবে। তরিকুল ইসলাম তার হৃদয়ে লুকায়িত মানবীয় গুণাবলী দিয়েই আপামর জনসাধারনের মন জয় করে নিতে পেরেছিলেন।
আমরা দেখি যারা দল করেন বা সংগঠন করেন তাদেরকে নিয়ে কোন না কোন কারণে অনেকের মধ্যে নানারকম মতপার্থক্য তৈরি হয়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় স্বার্থ এবং ক্ষমতার জন্যই মূল দ্বন্দ্ব ফুটে ওঠে। রাজনীতিতে এ দুটি বিষয়ের সমতা সৃষ্টি করতে পারলেই কিন্তু দেশ, সমাজ এবং রাষ্ট্র অনেক উপকৃত হয়। বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ তরিকুল ইসলাম সেই চিন্তাধারা থেকেই স্বল্প সময়ের জন্য হলেও রাজনীতিতে সেটা আনতে সক্ষম হয়েছিলেন।
রাজনৈতিক চিন্তা চেতনায় স্বাধীনতার ক্ষেত্রে রেখে গেছেন এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। যশোরের রাজনীতিতে তিনিই একমাত্র সেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। সব রাজনৈতিক দলের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ একই শহরে একই দেশে একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে চলাফেরা করবে, নির্বিঘ্নে কাজকর্ম করবে এটি তিনি দেখতেন অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে। রাজনৈতিক সহিংসতার এতটুকু মনোভাব কখনো তার মধ্যে পরিলক্ষিত হয়নি। তিনি আপাদমস্তক ছিলেন এক মূল্যবোধের প্রতীক। মনে প্রানে বিশ্বাস করতেন মানুষের জন্য এই রাজনীতি। যে রাজনীতিতে মানুষের কল্যাণ, নিরাপত্তা ও অধিকার রক্ষা হয় তাই তিনি পোষণ করতেন। জনগণের সামগ্রিক কল্যাণ নিশ্চিত করাই রাজনীতির মূল লক্ষ্য – এটা তিনি দৃঢ়ভাবে পোষণ করতেন।
শত নিপীড়ন, নির্যাতনের মাঝেও অন্যায়ের বিরুদ্ধে অপোষহীন থেকেছেন সবসময়। যশোর উন্নয়নে তার মত কাজ আর কোন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা করেছেন বলে শোনা যায় না। যশোর সহ দক্ষিণাঞ্চলের রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, প্রশাসনিক বিভিন্ন দপ্তরের ভবন, যশোর মেডিকেল কলেজ, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রায় প্রতিটি উন্নয়নমূলক কাজের সাথে তরিকুল ইসলামের অবদান অনস্বীকার্য।
জাতীয় এই নেতা মন্ত্রীর দায়িত্ব পালনে
 সদা ব্যস্ত থাকলেও তিনি প্রতি বৃহস্পতিবার নাড়ির টানে চলে আসতেন যশোরে। জনগণের সমস্যা সমাধান এবং আশা পূরণের লক্ষ্যে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। যশোরাঞ্চলে তার অবদান, জনপ্রিয়তা, প্রভাব এবং নেতৃত্বের ধরন সবই ছিল এক ব্যতিক্রম ক্রমধারা। নেতাকর্মীদের বকুনি ঝকুনির মধ্যে তার যে মানবতাবোধ জাগ্রত ছিল তা এ অঞ্চলের অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিদের কাছ থেকে তাকে করেছে আলাদা।
তিনি ছিলেন রাজনৈতিক চেতনার উজ্জ্বল বাতিঘর । গণতান্ত্রিক আন্দোলনের তিনি ছিলেন পথ প্রদর্শক ও রাজপথের সৈনিক। বাংলাদেশের স্বাধীনতার দীর্ঘ পথ ছিল অত্যন্ত দুর্গম ও কন্টকাকীর্ণ।এই দুর্গম পথের অন্যতম একজন কান্ডারী ছিলেন তরিকুল ইসলাম। আমরা যদি বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতির হিসাব করি তাহলে দেখব জাতীয় রাজনীতিতে তরিকুল ইসলাম ছিলেন প্রথম সারির নেতা। ১৯৭০ সালে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণে ভারতের একতরফা সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে মাওলানা ভাসানীর আহবানে ফারাক্কা অভিমুখে যে লংমার্চ হয়েছিল সে লংমার্চে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন।
রাজনীতিতে তৃণমূল থেকেই উঠে এসেছেন তরিকুল ইসলাম। ১৯৭৩ সালে তিনি সর্বপ্রথম জনপ্রতিনিধি হিসেবে যশোর পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৭৮ সালে হন চেয়ারম্যান। ১৯৭৯ সালে বিএনপি’র যশোর জেলা কমিটির আহ্বায়ক এবং একই বছরে তিনি যশোর- ৩ ( সদর) আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮২ সালে মার্চ মাসের প্রথমদিকে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তাকে প্রথম সড়কও রেলপথ প্রতিমন্ত্রী বানান।
স্বৈরাচার এরশাদ আমলে তাকে সবচেয়ে বেশি নিপীড়ন নির্যাতনের শিকার হতে হয়। তিন মাস তার কোন সন্ধানই পাওয়া যাচ্ছিল না। এই সময় তার উপর চালানো হয় অকথ্য নির্যাতন। তাকে বানানো হয়েছিল এরশাদ হত্যা চেষ্টা মামলার প্রধান আসামি । দীর্ঘদিন জেল খাটার পর মুক্ত হয়ে আবারো তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৮৬ সালে তাকে বানানো হয়েছিল দলের যুগ্ম মহাসচিব। ৯১ সালে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী এবং ১৯৯২ সালে ওই মন্ত্রণালয়ের পূর্ণ মন্ত্রীত্বের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। ২০০১ সালের মন্ত্রিসভায় তিনি একাধারে খাদ্যমন্ত্রী, তথ্যমন্ত্রী এবং সর্বশেষ পরিবেশ ও বনমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
আমরা জানি যারা রাজনীতি করেন এবং রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করেন তাদের সন্তান-সন্ততি , সংসার দেখাশোনা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। অথচ সম্পূর্ণই ব্যতিক্রম ছিল তরিকুল ইসলামের পরিবার। তিনি বেঁচে থাকাকালীন তার দুটি সন্তানকে যশোরবাসী তেমন চিনতেন না। এখন তার রেখে যাওয়া দুটি সন্তানই যশোরে হয়ে উঠেছেন মানুষের হৃদয়ের এবং অন্তরের কাছের মানুষ। বিপদে আপদে মানুষের পাশে থেকে তারা করে চলেছেন মানবসেবা। দুটি সন্তানই গড়ে উঠেছেন মানবিক মানুষ হিসেবে। তাদের সুনাম, সুখ্যাতি এবং আচরণে সন্তুষ্ট যশোরের মানুষ। বড় ছেলে শান্তনু ইসলাম সুমিত একজন ব্যবসায়ী আবার দায়িত্ব পালন করছেন লোকসমাজ পত্রিকার প্রকাশক হিসেবে। ছোট ছেলে অনিন্দ্য ইসলাম অমিত পিতার আদর্শ অনুসরণ করে একই ধারায় হয়ে উঠেছেন বিএনপির জাতীয় রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তিতে। যে কারণে যশোরের প্রতিটিঅঞ্চলের মানুষের আস্থা এবং ভালোবাসার জায়গা এখন তাদের উপরে নির্ভার। মা নার্গিস বেগমের জীবনও- এক বর্ণাঢ্য জীবন । তিনি ছিলেন সরকারি কলেজের অধ্যাপক, উপাধ্যক্ষ। অবসরের পর দায়িত্ব পালন করেছেন যশোর জেলা বিএনপির আহবায়ক হিসেবে। সবশেষে তিনি হয়ে উঠেছেন বিএনপির জাতীয় রাজনীতির একজন দায়িত্বশীল নেতা।
 জনমানুষের প্রিয় নেতা তরিকুল ইসলাম দীর্ঘদিন ধরে ভুগছিলেন কিডনি ডায়াবেটিসসহ নানা রোগে। সবশেষে ঢাকা এ্যাপোলো হাসপাতালে এক মাস চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর ৭২ বছর বয়সে বিশিষ্ট এই রাজনৈতিক নেতৃত্ব ইন্তেকাল করেন।
জাতীয় এ রাজনৈতিক বীরের ৭ম মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। যশোরের কারবালার মাটিতে শুয়ে আছেন প্রিয় এই নেতা। আল্লাহপাক প্রিয় এই নেতাকে জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকাম দান করুন।
 
 