স্বাধীন মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ
যশোরের ভৈরব নদীর কোল ঘেঁষে শান্ত সবুজ কনেজপুর গ্রাম। এই জনপদের ঐতিহ্য আর মানুষের হৃদয়ের গভীরে গেঁথে আছে শ্রী শ্রী বৈদ্যনাথ মন্দির। প্রতি বছর বৈশাখ মাসের শেষ সোমবার এখানে এক ভিন্ন ছবি ফুটে ওঠে। শুধু পূজা-অর্চনা নয়, এই দিনটি সাক্ষী থাকে এক ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ মেলারও। যেখানে ধর্ম আর লোকায়ত জীবন একাকার হয়ে মিশে যায়।
সোমবার বৈদ্যনাথতলা যেন পরিণত হয়েছিল এক আনন্দভূমিতে। সকাল থেকেই দূর-দূরান্ত থেকে ভক্ত ও দর্শনার্থীরা এসে ভিড় করতে শুরু করেন মন্দির প্রাঙ্গণে। দিনের আলো বাড়ার সাথে সাথে মেলা প্রাঙ্গণ লোকারণ্য হয়ে ওঠে। নানা বয়সের মানুষের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে মন্দির চত্বর ও তার চারপাশ।
বটবৃক্ষের বিশাল ছায়ায় বসেছিল গ্রামীণ পণ্যের পসরা। কেউ মাটিতে কাপড় বিছিয়ে সাজিয়ে রেখেছেন নিপুণ হাতে তৈরি মাটির খেলনা-ছোট হাতি, ঘোড়া, রঙিন পুতুল, বাহারি হাঁড়ি-কলস। যেন শৈশবের রূপকথারা জীবন্ত হয়ে উঠেছে সেইসব দোকানে। আবার কোনো দোকানে শোভা পাচ্ছে বাঁশ আর বেতের তৈরি নানা ব্যবহারিক জিনিস- ঝুড়ি, ডালা, শীতলপাটি।
সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছুই হয়তো হারিয়ে যেতে বসেছে, কিন্তু এই মেলায় যেন সেই পুরনো দিনের গ্রামীণ জীবন ফিরে আসে এক ঝলকের জন্য। ছোট-বড় আকারের ঢোলের শব্দ জানান দিচ্ছিল উৎসবের আগমনী বার্তা।
মেলায় ছিল রসনাতৃপ্তির এলাহি আয়োজন। মিষ্টি, মুখরোচক খাবার থেকে শুরু করে স্থানীয় বিশেষ খাদ্যদ্রব্য সবই পাওয়া যাচ্ছিল সেখানে। ক্লান্ত পথিক আর উৎসুক জনতা ভিড় করছিলেন খাবারের দোকানে। আর ছোটদের আনন্দ তো ছিল বাঁধনহারা। নাগরদোলা আর দোলনার হাতছানিতে তারা যেন হারিয়ে গিয়েছিল অন্য এক রঙিন জগতে।
সনাতনী সম্প্রদায়ের মানুষের প্রয়োজনীয় সামগ্রি যেমন শাখা, সিঁদুর, পূজার ঠান্ডা বাটি, চন্দনসহ বিভিন্ন জিনিসপত্রের দোকানও ছিল চোখে পড়ার মতো। এই মেলা যেন এক টুকরো গ্রামীণ হাট, যেখানে দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় সবকিছুই এক জায়গায় পাওয়া যায়।
তবে এই বার্ষিক অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ ছিল বাবা বৈদ্যনাথের পূজা ও হোম। ভক্তরা ভক্তি ভরে দেবতাকে প্রণাম জানান, অর্ঘ্য নিবেদন করেন। এরপর মন্দির প্রাঙ্গণে পরিবেশিত হয় মনোমুগ্ধকর পদাবলী কীর্তন। ভক্তরা সুরের মূর্ছনায় যেন অন্য এক জগতে হারিয়ে যান।
অনুষ্ঠানে এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ মন্দিরের প্রাচীন ঐতিহ্য ও এর গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেন। সবশেষে আগত সকলের মাঝে প্রসাদ বিতরণ করা হয়।
এবারের অনুষ্ঠানে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি ছিলেন। তারা হলেন-সদর উপজেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহিম, কাশিমপুর ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আইয়ুব হোসেন, সম্পাদক আবুল খায়ের, নওয়াপাড়া ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি বাবলু বিশ্বাস, নওয়াপাড়ার ৩ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি ফারুক হোসেন, বিএনপি নেতা কামরুজ্জামান, আজমুল হুদা, সদর উপজেলা পূজা পরিষদের সভাপতি রবিন কুমার পাল, সম্পাদক প্রশান্ত সরকার, সাংগাঠনিক সম্পাদক বাবলু দাস, কাশিমপুর পূজা পরিষদের সভাপতি ও মেলা উৎযাপন কমিটির আহবায়ক কার্তিক পোদ্দার, সম্পাদক মিলন কুমার কুন্ডু, শ্রী শ্রী বৈদ্যনাথ মন্দিরের সভাপতি গোপাল তরফদার, সম্পাদক নিখিল সিকদার, মেলা উদযাপন কমিটির যুগ্ম আহবায়ক রবীন্দ্রনাথ হালদার প্রমুখ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে, স্থানীয় প্রবীণদের বিশ্বাস এই মন্দিরে যুগ যুগ ধরে এই ব্যতিক্রমী পূজা ও মেলার আয়োজন হয়ে আসছে। তাদের পূর্বপুরুষের আমল থেকেই বৈশাখ মাসের শেষ সোমবার এই বিশেষ পূজা ও গ্রামীণ মেলার আয়োজন করার সংস্কৃতি চলে আসছে।
ভৈরব পাড়ের এই ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান প্রতি বছর ধর্মপ্রাণ মানুষ ও স্থানীয়দের এক মিলনমেলায় পরিণত হয়। গ্রামীণ সংস্কৃতির নানা উপাদান আর ধর্মীয় আবহের এক সুন্দর মিশ্রণ দেখা যায় বৈদ্যনাথতলার এই বার্ষিক অনুষ্ঠানে।
এই মেলা শুধু একটি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নয়, এটি একটি সামাজিক মেলবন্ধন। যেখানে মানুষ একত্রিত হয়, নিজেদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে উদযাপন করে। বৈদ্যনাথতলার এই মিলনমেলা আজও বহন করে চলেছে সেই পুরনো দিনের গ্রামীণ সরলতা আর উৎসবের আনন্দ। যা হয়তো কালের স্রোতে কিছুটা ফিকে হয়েছে, কিন্তু একেবারে হারিয়ে যায়নি।
কনেজপুরের স্থানীয় বাসিন্দা কার্তিক বিশ্বাস বলেন, আমাদের ঠাকুর দাদাদের কাছে শুনেছি এখানে বৈশাখের শেষ সোমবার পুজো হয়, মেলা হয়। কত বছর আগে থেকে শুরু হয়েছে সঠিক জানা নেই কারোর। এলাকা ও আশেপাশের মানুষ এখানে ভগবানের খুশিতে পূজা দিতে আসেন। এই পূজার দিন কনেজপুরের ঘরে ঘরে উৎসব বিরাজ করে।
মেলার মাঠে ঘুরতে আসা আরাফাত হোসেন নামে এক দর্শনার্থী বলেন, এটা সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী মানুষদের একটা বিশেষ দিন। আমরা সামাজিক সম্প্রীতিতে এখানে গ্রামীণ মেলা দেখতে এসেছি। শহরতলীতে অনেক সুন্দর পরিবেশে মেলা হচ্ছে। এখানে এসে গ্রামীণ অনেক জিনিসপত্র যেমন বাঁশ, বেত, মাটির কাজের জিনিস দেখছি। কয়েকটি জিনিস কিনেছি নিজের ও পরিবারের জন্য। সব মিলিয়ে বেশ সুন্দর পরিবেশ।
মেলার মাঠে ঢোল বিক্রি করতে আসা কেশবপুরের মনোরঞ্জন দাস বলেন, প্রতিবছর মেলায় আসি। ঢোল বিক্রি করি। নিজে পুজোও দিয়ে যায়। সারাদিন মেলা চলে। বিকেলের দিকে কেনাবেচা জমে উঠে।
সদর উপজেলা পূজা পরিষদের সভাপতি রবিন কুমার পাল বলেন, ভারতের মন্দিরের আদলে এখানকার মন্দিরটি। প্রতিবছর এই মন্দিরে পূজা করা হয়। গ্রামীণ মেলা বসে। এটা এই জনপদের মানুষের প্রাচীন সাংস্কৃতির অংশ।