বাংলার ভোর প্রতিবেদক
যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির বিরুদ্ধে শহিদ পরিবারের বসতঘর ভেঙে কোটি টাকার সম্পদ লুটপাটের অভিযোগে প্রধানমন্ত্রীর কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তিভোগীরা। গত ২ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে গিয়ে লিখিত অভিযোগটি করেন ভুক্তভোগী সদর উপজেলার হামিদপুর পশ্চিমপাড়ার বাসিন্দা আসাদুজ্জামান। অভিযোগের অনুলিপি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সরকারের ৯টি দপ্তরেও পাঠানো হয়েছে। এতদিন লিখিত অভিযোগটি প্রকাশ না পেলেও রোববার দুপুরে বিরোধপূর্ণ ওই জমি নিয়ে অভিযুক্তদের পক্ষে মুক্তিযোদ্ধারা সংবাদ সম্মেলন করলে অভিযোগটি প্রকাশ্যে আসে।
গত ২৭ জুন দুপুরে জমি দখলের উদ্দেশ্যে যশোরে শহীদ পরিবারের বাড়ি এস্কেভেটর দিয়ে গুড়িয়ে দেয়ার অভিযোগ ওঠে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলনের বিরুদ্ধে। দুই শতাধিক সন্ত্রাসী নিয়ে সদর উপজেলার হামিদপুর পশ্চিমপাড়ায়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ দেয়া শহীদ উদ্দিন আহমেদের ছেলে আসাদুজ্জামানের বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেয় তারা। এ সময় সন্ত্রাসীরা সেখানে লুটপাট চালায় বলেও দাবি করেন ভুক্তভোগী পরিবার। এ ঘটনায় একদিন পর ২৮ জুন ভুক্তভোগীরা থানায় লিখিত অভিযোগ করেছেন। ঘটনার ১০ দিন পার হলেও অভিযোগটি পুলিশ মামলা হিসেবে নেয়নি বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
প্রধানমন্ত্রীর কাছে দেয়া লিখিত অভিযোগে আসাদুজ্জামান উল্লেখ করেছেন, গত ২৭ জুন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলন, তার বেয়াই জেলা বিএনপির মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক সম্পাদক নুরুল ইসলাম ও সভাপতির ছেলে সামির ইসলাম পিয়াসের নেতৃত্বে শতাধিক সন্ত্রাসী ভুক্তভোগী আসাদুজ্জামানের বাড়িতে হামলা করে। তারা শর্টগান, চাইনিজ কুড়াল, ছুরিসহ অস্ত্র দেখিয়ে জিম্মি করে এস্কেভেটর দিয়ে বাাড়ি ভেঙে গুড়িয়ে দেয়। পরে ৭টি ট্রাকে করে বসতবাড়ির জিনিসপত্র, গরু ছাগল, নগদ টাকা, গহনা, লুট করে নিয়ে যান। এই ঘটনায় পুলিশের কাছে গিয়েও তারা সহযোগিতা পায়নি। এমনকি এই ঘটনায় মামলাও গ্রহন করেনি পুলিশ। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মিলন বলে বেড়াচ্ছেন তার জামাই পটুয়াখালী শেখ হাসিনা সেনানিবাসের বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মুজাহিদ স্টেশন কমান্ডার। ফলে ঘটনাটি নিয়ে ভুক্তভোগীরা বেশি বাড়াবাড়ি করলে মামলা দিয়ে হাজতে পাঠাবে। লিখিত অভিযোগে উল্লেখ করেছেন, বাড়িঘর ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়ার কারণে ভুক্তভোগীরা খোলা আকাশের নিচে মানবতার জীবনযাপন করছেন।
রোববার সন্ধ্যায় জানতে চাইলে ভুক্তভোগী আসাদুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের বসভিটার জায়গার সাবেক মালিক ছিলো সভাপতির বেয়াই মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম। নুরুল ইসলামের এই জায়গা শিল্প ব্যাংকে মর্টগেজ ছিল। ১৯৯২ সালে ব্যাংকের নিলামের মাধ্যমে আমরা এই জমিটি ক্রয় করি। সেই থেকে এই জমি ঘরবাড়ি ভোগ দখল করে আসছি। গতবছর শহিদুল ইসলাম মিলন এই জমি দখলের জন্য তার সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে আসে। তাদের মারপিটে আমার সন্তান আহত হয়। এবার গ্রামবাসীর হাওয়ায় সন্ত্রাসীসহ তিনি পালিয়ে যান। এবার তার বিয়াই, সভাপতির ছেলে পিয়াসের নেতৃত্বে শতাধিক সন্ত্রাসীরা বাড়ি গুড়িয়ে নিয়ে গেছে। লুট করেছে জিনিসপত্র। তিনি বলেন, ‘বাড়িঘর ভেঙ্গে ফেলাতে মানববেতার জীবনযাপন করছি। বৃষ্টি বাদলের দিনে তাবু টাঙিয়ে পরিবার নিয়ে বসবাস করছি। মামলা করতে গেছি, পুলিশ মামলা নেয়নি। তাইতো প্রধানমন্ত্রীর কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। যে এস্কেভেটর দিয়ে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছিলো, সেটি এখনো আমার বাড়িতে রয়েছে।’ থানা মামলা না দিলে আদালতে যাননি কেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, তাদের দল ক্ষমতায়, দলের বড় নেতা। ভয়ে যেতে পারছি না। তবে দ্রুতই আদালতে মামলা করবেন বলে জানান তিনি।’
ঘটনাটি একেবারেই সাজানো ও রাজনীতিক উদ্দেশ্যমূলক বলে দাবি করেছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলন। তিনি বলেন, আসাদুজ্জামান গং নিজেরাই এস্কেভেটর এনে বাড়ি ভাঙচুর করে নানা কল্পকাহিনী সাজিয়ে তাকে ও তার পরিবারের নাম জড়িয়ে মিথ্যাচার করছে। কার্যত আমি ওই জমির কোনো পার্ট নই। তার আত্মীয় নূরুল ইসলাম ও নুর মোহাম্মদ ওই জমির প্রকৃত মালিক এবং তারা খাজনা ট্যাক্স দিয়ে চলেছেন। আর আসাদুজ্জামান ভূমিদস্য।’
এদিকে, বিরোধপূর্ণ জমি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামের পক্ষে সংবাদ সম্মেলন করেছেন যশোরের মুক্তিযোদ্ধারা। রোববার বেলা ১২টায় প্রেসক্লাব যশোরে এ সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বীরমুক্তিযোদ্ধা ও জেলা জাসদ সভাপতি রবিউল আলম।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম ১৯৮০ সালে ১৯ লাখ ৯৯ হাজার টাকা শিল্প ব্যাংক থেকে লোন নেন। এর প্রেক্ষিতে তিনি দুই একর ৯৭ শতক জমি ওই ব্যাংকের অনুকুলে বন্ধক রাখেন। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও ডাকাতি হওয়ার কারণে তিনি লোন পরিশোধে ব্যর্থ হন। এ ঘটনায় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ মামলা করেন। এর মাঝে ওই এলাকার আসাদুজ্জামান ১৯৯২ সালের ১০ মে নিলামে দুই লাখ ৭৫ হাজার টাকায় দুই একর ৯৭ শতক জমি কেনেন। কিন্তু অতিরিক্ত ৩৫ বিঘা জমি অবৈধভাবে দখল করে রাখেন। পরবর্তিতে এ ঘটনায় মামলা হয়। যা হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। আদালত থেকে সরেজমিনে তদন্ত করে সিদ্ধান্ত হয়, আসাদুজ্জামান যে অবৈধ ৩৫ শতক জমি দখলে রেখেছে তার কোনো সুযোগ নেই। সর্বশেষ ২০২০ সালের ২১ জুলাই মাস্টার নুরুল ইসলাম ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করে দিলে দায়মুক্ত হন। একই সাথে এ মামলাটিরও নিস্পত্তি হয়। পরবর্তিতে আসাদুজ্জামান যশোরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আদালতে আসাদুজ্জামান আপীল করেন। কিন্তু আপিল না মঞ্জুর হয়। পরবর্তিতে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব) আদালতে আপীল করলে এ আদালত সার্টিফিকেট আদালতের রায় বহাল রেখে আসাদুজ্জামানের আপিলটি না মঞ্জুর করেন।
সংবাদ সম্মেলনে রবিউল আলম বলেন, ‘নুরুল ইসলাম এখন অসুস্থ। বয়োবৃদ্ধ। মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন। তার ৩৫ শতক জমির দখল ফিরিয়ে দিতে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনসহ সকলের সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।
যশোর কোতয়ালী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘অভিযোগ দিলেই তো মামলা হবে না। মামলা নথিভুক্ত করার নানা প্রক্রিয়া রয়েছে। ভুক্তভোগীকে বলেছি থানায় আসতে, কিন্তু তাকেই থানাতে আনতে পারলাম না। থানাতে না আসলে মামলা হবে কেমন করে। তাছাড়া বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে বলে জানান তিনি’।