সাজেদ রহমান
‘মহেশপুর বর্ডার দিয়ে সীমান্ত পার হয়ে আমি এবং তবিবর রহমান ভাই ভারতে পৌঁছায়। সীমান্তে বিএসএফ-এর সাথে দেখা হয়। আমরা ‘জয়বাংলা’র লোক পরিচয় দিলে তারা ক্যাম্পে নিয়ে যায়। আমাদের দুপুরে খাবার খেতে দেয়। এরপর আমাদের বনগাঁ যাবার ব্যবস্থা করে বিএসএফ। তবি ভাইয়ের সাথে আমি বনগাঁ যায়। আমার কাছে কোন টাকা পয়সা ছিল না। বনগাঁ পৌঁছানোর পর তবি ভাই আমার হাতে ৬শ’ টাকা দেয়। সেই টাকা নিয়ে আমি বনগাঁতে থাকলাম। পরে তবি ভাই বললেন, তোদের যুদ্ধের প্রশিক্ষণে পাঠাবো। যাবি তো? আমি বললাম, যুদ্ধে যাবার জন্য তো বাড়ি ছেড়েছি। এরপর তবি ভাই একদিন আমাদের ট্রেনে করে কলকাতা পাঠালেন। আমরা শিয়ালদহ থেকে দমদম গেলাম। সেখানে দুই দিন থাকার পর তোফায়েল আহমেদ এলেন, আমাদের বিমানে করে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হলো ভারতের উত্তর প্রদেশের দেরাদুনের পাশে এক স্থানে।
কথাগুলো বলছিলেন শার্শার মুক্তিযোদ্ধা নইমুদ্দিন খান টিয়া। মুক্তিযোদ্ধা টিয়া বলেন, তবিবর রহমান সরদার বনগাঁয় অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের রিক্রুট করার কাজ করতেন। মুক্তিযোদ্ধা, শরণার্থী যারা বনগাঁ এবং তার আশেপাশের ক্যাম্পে উঠতেন, তাদেরও দেখা শোনা করতেন তিনি। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন তবিবর রহমান সরদার। আজ ৩ এপ্রিল তবিবর রহমান সরদারের ১৪তম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১০ সালের আজকের দিনে তিনি মারা যান। রাজনৈতিক একাগ্রতা আর নিষ্ঠার কারণে ইউপি সদস্য থেকে শুরু করে একাধিকবার সংসদ সদস্য হয়েছিলেন তবিবর রহমান সরদার। সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনে, শিক্ষা বিস্তারে তিনি শার্শায় গড়েছেন বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
শার্শার আর এক মুক্তিযোদ্ধা মহিবুর রহমান ঝন্টু মুক্তিযুদ্ধের সময়কার কথা স্মৃতিচারণ করে বলেন, বনগাঁয় দেখা তবিবর রহমানের সাথে। বনগাঁর কাঠেরপুলের আগে একটি দোকান ছিল। নাম ‘রহমানিয়া বীজাগার’। সেখানে তিনি বসে আছেন। উদ্বিগ্ন। প্যান্ট এবং শার্ট পরা লম্ব ছিপছিপে মানুষটির চোখে চশমা। তাঁর সাথে দেখা হবার সাথে সাথেই বললেন, ওদিকের কি খবর? আমি তাঁর কাছে অবস্থার বর্ণনা করলাম। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন-‘তোমরা খেয়েছো? আমি মাথা নাড়লাম। বললাম না। তিনি খাবারের ব্যবস্থা করেন। যে কয়দিন ছিলাম বনগাঁ তিনি আমাদের নিয়মিত খোঁজ খবর নিতেন। তার রিক্রুটে আমিসহ আমাদের এলাকার বজলুর রহমান, মোফাজ্জেল হোসেন বাবলু, খবির আহমেদ খান, মোজাম্মেল হক, মোহাম্মদ আলী, সৈয়দ হোসেন, মনিরুজ্জামান মনি, ইব্রাহিমসহ ১২/১৩ জনকে তিনি কলকাতা পাঠান। তিনি আরও বলেন, আমাদের পাঠানো হয় শিয়ালদহে। সেখানে ছিলাম দুইদিন। একদিন দেখা করতে আসলেন তোফায়েল আহমেদ। তিনি আমাদের বললেন, তোমরা যাবে উত্তর প্রদেশে। আমরা গুছিয়ে গেলাম দমদম এয়ারপোর্টে। সেখান থেকে বিমানে দেরাদুনে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে আমরা দেশে ফিরে বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি।
তবিবর রহমানই বনগাঁয় থেকে যশোর অঞ্চলের সবাইকে অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতাদের মত মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। আসলে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি অসাধারণ ভূমিকা পালন করেন। তার প্রমাণও পাওয়া যায় তৎকালীন কলকাতার পত্র-পত্রিকায়। ১৯৭১ সালের ১ ডিসেম্বর কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় একটি রিপোর্টে তবিবর রহমান সরদারের নাম পাওয়া যায়। ওই রিপোর্টের শিরোনাম ছিল ‘বরিশাল, ফরিদপুরে পাক সৈন্য বেশি নেই, চৌগাছা মুক্ত’। রিপোর্টে বলা হয়..‘গত ২৫ নভেম্বর যশোহর জেলার সামরিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ বাজার চৌগাছা মুক্তি বাহিনী দখল করেছে। ওই অঞ্চলে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসছে বলে মুজিবনগর থেকে আজ জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতা ওবায়দুর রহমান।
রিপোর্টে আরও বলা হয়.. ‘চৌগাছা মুক্তি বাহিনীর দখলে আসার পর ধীরে ধীরে মানুষ আবার ওই অঞ্চলে ফিরে আসছে। ওই অঞ্চলে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য চৌগাছার এমপিএ জনাব তবিবর রহমান সরদারের উপর ভার দেওয়া হয়েছে।’
অনেক বড় রিপোর্টের এইটুকু অংশ বললাম এই কারণে যে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তবিবর রহমান সরদার ছিলেন একজন অন্যতম সংগঠক। ইতিহাসে তা প্রমাণিত। ওই রিপোর্টে তার প্রমাণ জ্বলজ্বল করছে। আপদ মস্তক একজন অসাম্প্রদায়িক তবিবর রহমান সরদার ছিলেন যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি, সাবেক সংসদ সদস্য।
বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী তবিবর রহমান সরদার ১৯৩২ সালের ১ মে শার্শার বারিপোতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ছাত্রজীবন থেকে জড়িয়ে পড়েন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে। ৫২ এর ভাষা আন্দোলনে রাখেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের শার্শা থানার আহ্বায়ক এবং মহকুমা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ওই বছর থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি। পরে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন ২০০২ সাল পর্যন্ত।
তিনি ১৯৫৮ সালে ইউপি সদস্য নির্বাচিত হন। পরে ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন বিপুল ভোটের ব্যবধানে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পূর্ব পর্যন্ত ইউপি চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭০ সালে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে গণপরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর আগে ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলন ও ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে তিনি সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের রিক্রুটং, তাদের দেখভাল, শরণার্থী শিবিরে খাবার ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করতেন। মুক্তিযুদ্ধের বিশিষ্ট এই সংগঠক ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি তাজউদ্দীন আহমেদের সাথে যশোর টাউন হল ময়দানে ঐতিহাসিক সমাবেশে বক্তব্য রাখেন।
স্বাধীন বাংলাদেশে তবিবর রহমান সরদার ১৯৭৩, ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি তার জীবনকালে শার্শা এলাকায় বিভিন্ন স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন। বীরশ্রেষ্ঠ নুর মোহাম্মদ কলেজ, শেখ ফজিলাতুননেছা মহিলা কলেজ, নাভারণ ডিগ্রি কলেজ, বুরুজ বাগান গালর্স হাইস্কুল ও ধলদা তবিবর রহমান সরদার (টিআরএস) মাধ্যমিক বিদ্যালয়সহ আরো কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন তিনি।
নাভারনে শেখ ফজিলাতুননেছা মহিলা কলেজ তিনি প্রতিষ্ঠা করার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধনের তারিখ দিলেন ১৯৯৭ সালের ১৭ নভেম্বর। তবিবর রহমান সরদার ছিলেন পরিচ্ছন্ন হৃদয়ের মানুষ। তাঁর প্রতিটি কাজ ছিল গোছালো। তিনি মনে করলেন, কলেজে ফজিলাতুননেছার একটি ছবি রাখতে হবে। সেই সময় তাঁর ছবি খুঁজে পাওয়া কঠিন। যোগাযোগ করলেন আমার ভাই শামছুর রহমানের সাথে। শামছুর রহমান যোগাযোগ করলেন ঢাকায় বাংলার বাণী পত্রিকার চিত্রগ্রাহকের (নাম মনে করতে পারছি না) সাথে। তাঁর কাছে উদ্দেশ্য জানাতে তিনি বাংলার বাণীর ল্যাব থেকে রিল বের করে ফজিলাতুননেছার একটি ২৫ ইঞ্চি বাই সাড়ে ১৯ ইঞ্চি ছবি প্রিন্ট করে দিলেন পল্টনের ফুজি কালার ল্যাব থেকে। সেই ছবিটি সুন্দর বাঁধাই করে তিনি নিয়ে এলেন নাভারনে। কলেজের রুমে ছবিটির স্থান হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কলেজ উদ্বোধন কালে ওই ছবির সামনে অনেক সময় দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনিও হয়তো ভাবছিলেন, এত সুন্দর ছবি কোথা থেকে পেল কলেজ কর্তৃপক্ষ।
তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে পরিবারের উদ্যোগে শার্শার বারিপোতা নিজ গ্রামের মসজিদে ইফতারের আয়োজন করা হয়েছে। অন্যদিকে সরকারি ফজিলাতুন্নেছা মহিলা কলেজের প্রভাষক দেলোয়ার হোসেন ও প্রভাষক মমিনুর রহমানের উদ্যোগে কলেজ প্রাঙ্গনে ইফতার এর আয়োজন করা হয়েছে।
লেখক : সাংবাদিক