মিলন রহমান
সংবাদপত্র বা সংবাদমাধ্যম সমাজের দর্পণ। এই দর্পণে সমাজ, দেশ ও জাতিসহ গোটা বিশ্বের চিত্র প্রতিবিম্বিত হয়। নিত্যদিনের সংবাদ, ঘটনাপ্রবাহ, অপরাধচিত্র, অনুসন্ধানী সংবাদ ছাড়াও সমকালীন বিশ্বের চলমান ঘটনা, জীবনযাত্রা, চিন্তাচেতনাসহ অনেক কিছুরই সম্মিলন থাকে সংবাদপত্রে। রাষ্ট্র কাঠামোয় সংবাদপত্রের গুরুত্ব ও অপরিহার্যতাকে নিরূপণ করতে রাজনীতিক তত্ত্ববিদ ও দার্শনিক এডমন্ড বার্ক যথার্থই বলেছেন, সাংবাদিকরা রাষ্ট্রের ‘ফোর্থ স্টেট’। তাই বলা হয়, স্বাধীনতা-স্বার্বভৌমত্ব সুরক্ষায়, জাতীয় স্বার্থ, মানবাধিকার উন্নয়নে, নাগরিক অধিকার সংরক্ষণে এবং গণতন্ত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সাংবাদিক এবং সংবাদপত্র বা সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা সবচেয়ে বেশী। আর সংবাদমাধ্যমকে দায়িত্বশীলতা, নিরপেক্ষতা ও বস্তুনিষ্ঠতার অনন্য অবস্থানে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন সাংবাদিকেরাই।
সাধারণভাবে ঢাকা থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্রকে ‘জাতীয়’ পত্রিকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। আর জেলা বা বিভাগীয় শহর থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্রকে আঞ্চলিক পত্রিকা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ঢাকা বা রাজধানীর বাইরে, জেলা বা উপজেলা পর্যায় থেকেও এখন নিয়মিত অনেক সংবাদপত্র প্রকাশিত হচ্ছে।
আমরা জানি স্থানীয় পর্যায়ের সাংবাদিকতা-সংবাদপত্র বিস্তর সমস্যায় আকীর্ণ। কাজেই স্থানীয় প্রেক্ষাপটে গণমাধ্যম বা সংবাদপত্রের বিকাশে চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করতে হলে আগে এর সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে হবে। স্থানীয় সংবাদপত্র বা সাংবাদিকরা কতটা লিখছেন বা লিখতে পারছেন তা তলিয়ে দেখতে হবে। না লিখতে পারলে এর অন্তর্নিহিত কারণগুলো খুঁজে দেখতে হবে। মূল কারণগুলো খুঁজে বের করতে না পারলে একই সমস্যার ঘূর্ণাবর্তে থাকবে স্থানীয় সংবাদপত্র-সাংবাদিকতা, এগোবে না। এ ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে ভাবনার দাবি রাখে।
জেলা শহরের পত্রিকা বা আঞ্চলিক পত্রিকাগুলোকে টিকে থাকার জন্য লড়াই সংগ্রাম করতে হচ্ছে। রয়েছে নানা সঙ্কট আর সীমাবদ্ধতা। মফঃস্বল শহর থেকে একটি পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশ করে তা পাঠকের হাতে তুলে দিতে কঠোর পরিশ্রমের পাশাপাশি বিপুল বিনিয়োগ করতে হয়। সেই সাথে মাসের পর মাস লোকসানের বোঝা টানতে হয়। কারণ সংবাদপত্রের আয়ের উৎসেই রয়েছে ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’। চার-পাঁচ টাকা মূল্যের একটি পত্রিকার অর্ধেক পরিমাণ (দুই থেকে আড়াই টাকা) পত্রিকার হিসাব বিভাগে এসে জমা হয়। অথচ চারপাতার একটি পত্রিকা প্রকাশেই তার দ্বিগুণ অর্থ ব্যয় হয়। ফলে এ ঘাটতির সাথে রয়েছে সাংবাদিক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের বেতন-ভাতা এবং বিপুল অংকের অফিস ব্যয়। এই অর্থ পুষিয়ে নেয়ার জন্য পত্রিকাগুলোকে নির্ভর করতে হয় বিজ্ঞাপনের ওপর। কিন্তু সেখানেও রয়েছে ‘অসুস্থ’ প্রতিযোগিতা। এখানে পাঠকপ্রিয় পত্রিকাগুলোতে ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ পত্রিকার সাথে লড়াই করতে হয়। নানা অস্বচ্ছ প্রক্রিয়া পার করে পত্রিকাগুলো যে সরকারি বিজ্ঞাপন বা ক্রোড়পত্র পায়, তা দিয়ে টিকে থাকাই দুস্কর হয়ে পড়ে। বরং সরকারের বিজ্ঞাপণ বা ক্রোড়পত্রের সুফল ঘরে তোলে নামমাত্র প্রকাশনায় থাকা পত্রিকাগুলো। তাই পত্রিকার ডিক্লিয়ারেশন, ডিএফপি তালিকাভূক্তি এবং সার্কুলেশনের নিরিখে বিজ্ঞাপনের মূল্যহার নির্ধারণে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা জরুরি।
এছাড়াও একটি পত্রিকাকে টিকিয়ে রাখতে বিভিন্ন কোম্পানি, প্রতিষ্ঠান ও প্রাইভেট বিজ্ঞাপনের বিকল্প নেই। সংবাদপত্র বেঁচে থাকার জন্য এই বিজ্ঞাপনগুলোও জরুরি। কিন্তু এই বিজ্ঞাপনের স্বার্থে অনেক প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম দুর্নীতির সংবাদ আর আলোর মুখ দেখে না। আর নেতিবাচক সংবাদ লিখে বিজ্ঞাপনবঞ্চিত হলে পত্রিকা কর্তৃপক্ষেরও মুখ কালো হয়ে যায়। স্থানীয় পত্রিকাগুলোকেও অনেক সংবাদ বিজ্ঞাপনের দিকে তাকিয়ে লিখতে হয়। বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠানের কোনো অনিয়ম-দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশক-সম্পাদকরা প্রকাশ করতে চান না। বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকও এ থেকে বাদ যায় না।
এছাড়াও বলা হয়ে থাকে, ‘সংবাদপত্রের স্বাধীনতা থাকলেও সাংবাদিকদের স্বাধীনতা নেই।’ অর্থাৎ সাংবাদিক সংবাদ সংগ্রহ করলেও তা প্রকাশের নিশ্চয়তা নেই। পত্রিকা কর্তৃপক্ষ অ্যাসাইনমেন্ট দিলে সাংবাদিক সেই সংবাদ সংগ্রহ করে লিখে জমা দেওয়ার পরও তা প্রকাশ না হওয়ার অনেক নজির থেকে যায়। কিন্তু সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক জানতে পারেন না, কেনো তার সংবাদ সম্পাদক-প্রকাশক আটকে দিলেন।
বর্তমান সময়ে সংবাদপত্রের জন্য একটি বড় সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে ‘যোগ্য সাংবাদিক’ পাওয়া। জেলাশহরের পেশাজীবী সাংবাদিকদের নানা ধরণের ঝুঁকি-চ্যালেঞ্জকে সঙ্গী করে ২৪ ঘণ্টাই সবধরণের সংবাদ নিয়ে কাজ করতে হয়। সবচেয়ে বড় যে প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করতে হয়, তা হলো ‘আর্থিক অস্বচ্ছলতা’। আঞ্চলিক পত্রিকাগুলো যে সম্মানী বা বেতন-ভাতা প্রদান করে তা খুবই অপ্রতুল। ফলে জীবিকার তাগিদে পেশাজীবী সাংবাদিকদের আঞ্চলিক পত্রিকা, জাতীয় পত্রিকা, টেলিভিশন বা অনলাইনের একাধিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে হয়। ফলে এমন প্রেক্ষাপটে শিক্ষিত এবং মেধাবীরা জেলা শহরে সাংবাদিকতায় আগ্রহী হচ্ছেন না; বা সাংবাদিকতায় যুক্ত হলেও বাস্তবতা অনুধাবন করে সরে যাচ্ছে। সার্বক্ষণিক পেশা হিসেবে সাংবাদিকতাকে গ্রহণ করার সুযোগ না থাকায় অন্যান্য পেশা বা কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরাই সাংবাদিকতা করতে আসেন। ফলে তাদের পক্ষে পেশাদারিত্বের মনোভাব নিয়ে কাজ করা আসলে সম্ভব নয়। এ কারণে সাংবাদিকতা চলে যাচ্ছে ‘অপেশাদার ও অযোগ্য’দের হাতে। আবার কোনো কোনো সম্পাদক-প্রকাশক টিকে থাকার অযুহাতে নামমাত্র সম্মানীতে এদের হাতেই তুলে দেন সাংবাদিকতার গুরুদায়িত্ব।
সবসময় সব সমাজব্যবস্থায়ই সাংবাদিকতা চ্যালেঞ্জের। ভিন্ন ভিন্ন সমাজকাঠামোয় সাংবাদিকতা চর্চার ধারার অবস্থা এমন, স্বাধীনতাকে ছাপিয়ে কখনো কখনো শৃঙ্খল’ই বড় হয়ে উঠছে। শৃঙ্খলে আবদ্ধ করার জন্য রয়েছে নানান আইনের বেড়াজাল। আইনবহির্ভূত নানা বিধিনিষেধ, হুমকি চাপ-সংবাদপত্রগুলোকে বশীভূত বা দমন করার হরেক রকম কলাকৌশল। রয়েছে, আমলা-রাজনৈতিক-প্রভাবশালীদের চাপ, নানান আইনের অদৃশ্য জাল এবং নিজেদের মধ্যে বিভাজনজনিত কোন্দল।
শৃঙ্খলিত সাংবাদিকতা নিশ্চিতকরণে প্রচলিত আইনের কাঠামোর কখনো আরোপিত প্রয়োগ আবার বেশির ভাগ অপপ্রয়োগের কথা বাদ দিলেও বলতে হয় অসুস্থ ও দখলদারির রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সংবাদপত্রের স্বাধীনতা যেমন মার খাচ্ছে, তেমনি সংবাদপত্রগুলোয় অসৎ ব্যবসায় পুঁজি বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে সুকৌশলে নিজেদের অপকর্ম ঢাকার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছে। সর্বোপরি সাংবাদিক সমাজের মধ্যকার অনৈক্য ও বিভাজন স্বাধীন সাংবাদিকতা চর্চার পথকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে।
আঞ্চলিক সংবাদপত্রের আরেকটি সঙ্কট সৃষ্টি করেছে ভুঁইফোড় অনলাইন নিউজপোর্টাল। একটি অফিস-একটি কক্ষ, একটি কম্পিউটার; একটি অনলাইন নিউজপোর্টাল। অনুমোদন নেই, বৈধতা নেই; একটি ডোমেইন-হোস্টিং নিয়ে ওয়েবসাইট খুলে সাংবাদিক বনে যাচ্ছেন সুযোগসন্ধানীরা। বিভিন্ন নিউজ পোর্টাল থেকে খবর কপি-পেস্ট করে ভরে ফেলছেন নিজের পোর্টাল। এইসব নামকাওয়াস্তের নিউজপোর্টাল সম্পাদকরা আবার জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যায়েও সাংবাদিক নিয়োগ দিচ্ছেন। ফলে সাংবাদিকতার পরিচ্ছন্ন বাগান ভরে যাচ্ছে আবর্জনায়। আর অযোগ্য-অপেশাদাররা সাংবাদিকতায় ঢুকে পড়ছে। নামমাত্র সম্মানী বা কার্ডসর্বস্ব সাংবাদিকতায় নিয়োজিতরা গোটা সমাজকে কলুষিত করে ফেলছে। মাধ্যমিকের গণ্ডি পার হতে ব্যর্থ হওয়া; সাংবাদিকতার প্রাথমিক পাঠও না জানা ‘সাংঘাতিক’দের একটি কার্ড ধরিয়ে দিয়ে মাঠে নামিয়ে দিচ্ছেন কোনো কোনো সম্পাদক-প্রকাশক। ফলে এই ‘সাংঘাতিক’রা সাংবাদিকতা করার পরিবর্তে সাংবাদিকতা ফলাতে গিয়ে নিজেও বিপদে পড়ছেন; অন্যকেও বিপদে ফেলছেন। আর সবমিলিয়ে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত করছেন সাংবাদিকতার মতো মহান পেশাকে। এক লাইন লিখতে না পারা ব্যক্তিরাও যখন সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে চলেন, তখন তাদের আচরণে সম্মান ক্ষুণ্ন হয় পেশাজীবী সাংবাদিকদের।
এদিকে, দিনে দিনে কমছে প্রিন্টেড অর্থাৎ ছাপা সংবাদপত্রের চাহিদা। সঙ্গত কারণেই পত্রিকা, নিউজপোর্টালগুলো মাল্টিমিডিয়া সাংবাদিকতায় ঝুঁকছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, আগামী দিনে টিকে থাকতে হলে মাল্টিমিডিয়া সাংবাদিকতার কোনো বিকল্প নেই। আঞ্চলিক সংবাদপত্রগুলোকেও আজ অথবা কাল মাল্টিমিডিয়া সাংবাদিকতার দিকেই ধাবিত হতে হবে। অনেকে সেই উদ্যোগ গ্রহণও করছে। তবে অনেক পত্রিকা কর্তৃপক্ষ মাল্টিমিডিয়ার কনটেন্ট চান; কিন্তু কনটেন্ট তৈরির জন্য জনবল দিতে চান না; খরচ করতে চান না।
আঞ্চলিক সংবাদপত্র সাংবাদিকতার সমস্যা সঙ্কট ‘দরিদ্র্যের দুষ্টুচক্রের’ মতো একে অপরের সাথে যুক্ত। মালিক-সম্পাদকরা বলছেন, তারা ‘যোগ্য সাংবাদিক’ পাচ্ছেন না। আবার যোগ্য সাংবাদিকরা জীবিকা নির্বাহের মতো বেতন পাচ্ছেন না। ফলে যোগ্যরা পেশায় টিকতে পারছেন না। অন্যদিকে, নিয়ন্ত্রণহীনভাবে পত্রিকার বিজ্ঞাপন-সার্কুলেশন বাজারকে সংকুচিত করে ফেলছে। ফলে ভাল মানের গণমাধ্যমকে টিকে থাকতে লড়াই করতে হচ্ছে।
এজন্য প্রথমে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। আন্ডারগ্রাউন্ড ও ভূইফোঁড় পত্রিকা এবং মানহীন অনলাইন পোর্টাল-সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সাংবাদিকতার নূন্যতম যোগ্যতা-শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করতে হবে। মানসম্মত সংবাদমাধ্যমগুলোকে যোগ্য সাংবাদিক নিয়োগ এবং যথাযথ বেতন কাঠামোতে বেতন ভাতা প্রদান করতে হবে। সাংবাদিক সংগঠনগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে পেশাজীবী সাংবাদিকতায় গুরুত্ব দিতে হবে এবং সহায়ক পরিবেশ তৈরিতে ভূমিকা রাখতে হবে। এভাবে ‘আগাছা’ নির্মূল সম্ভব হলেই সংবাদপত্র সংবাদমাধ্যমের বাগান সুশোভিত হয়ে উঠবে। #
লেখক :শিশু সাহিত্যিক ও সাংবাদিক