# দেনা পরিশোধ নিয়ে মহাচিন্তায় কৃষক
# ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান
বাংলার ভোর প্রতিবেদক
যশোরের চৌগাছা উপজেলার সিংহঝুলি গ্রামের বর্গাচাষি চান্দু মোল্লা। নিজের কোন আবাদি জমি নেই। চলতি মৌসুমে এক বিঘা জমি বর্গা নিয়ে বোরো ধান আবাদ করেছিলেন। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ধানের ফলনও ভালো হয়েছিল। ধানের বাম্পার ফলনে দেখেছিলেন রঙিন স্বপ্নও। তার এই রঙিন স্বপ্নে ভেঙ্গে চুরমার হয়েছে প্রকৃতিক দুর্যোগে। সোমবার বিকালে আকস্মিক কালবৈশাখী ঝড় ও শিলাবৃষ্টিতে তছনছ হয়ে গেছে কৃষকের স্বপ্ন। জমিতে কেটে রাখা ধান প্রথমে শিলাবৃষ্টিতে ঝরেছে; এরপর ডুবে যাওয়া ধান হাটু পানিতে ভিজেছে।
মঙ্গলবার বেলা ১১ টার দিকে চান্দু মোল্লার জমিতে দেখা গেছে, ছোট ভাই, বউকে নিয়ে ভিজে যাওয়া ধান রোদে শুকাতে। আর শিলাবৃষ্টিতে জমির ক্ষেতে ধরে যাওয়া ধান কুড়িয়ে পাত্রে রাখছেন। চান্দু মোল্লা বলেন, ‘আধাঘন্টার শিলাবৃষ্টিতে আমার সব শেষ। এবার ধান চাষে ম্যালা খরচ হয়েছে। সারা বছর পানি কিনতে হয়েছে। সার ও সেচের দাম কিরাম করে দিবানে সেই চিন্তায় পড়িছি। এখন কীভাবে সংসার চালাব; কিভাবে সারা বছরের খোরাক মিটাবো সেই চিন্তায় পড়েছি। কপালে ঘামটা মুছে কিছুটা আক্ষেপের স্বরে বলে উঠলেন ‘আল্লাহ এবার ফলনও দিলো, নিয়েও নিলো’।
শুধু চান্দু মোল্লা নয়; যশোরের চার উপজেলায় প্রায় আধাঘণ্টা ধরে বৃষ্টির সাথে শিল পড়ায় বোরো চাষি মাঠে মারা গেছে। এতে গাছ থেকে ধান পড়ে ‘ন্যাড়া’ হয়ে গেছে। এখন অনেকটা খড়ের ক্ষেত মনে হচ্ছে। সাথে কালবৈশাখি ঝড়ে ধান গাছ মাটির সাথে লুটিয়ে পড়েছে। আর ক্ষেতে কাটা ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। সবমিলিয়ে চাষিদের সর্বনাশ হয়ে গেছে। দেনা পরিশোধ নিয়ে মহাচিন্তায় পড়েছেন কৃষক। বোরো মৌসুমের ৫ হাজার ১১ হেক্টর জমির ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেই সঙ্গে আম, লিচু ও সবজিরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ।
এদিকে, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের পাশে সরকারকে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে কৃষক খেতমজুর সংগ্রাম সমিতির যশোর জেলা শাখাসহ বাম সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। মঙ্গলবার যশোরের জেলা প্রাশাসক আজাহারুল ইসলামের সাথে দেখা করে এ আহ্বান জানান তারা।
ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকেরা বলছেন, যশোরের উপর দিয়ে প্রায় দুই সপ্তাহ প্রচণ্ড তাপদাহ বয়ে যাচ্ছিলো। এরমধ্যে গত সোমবার দুপুর দুইটার দিকে আকাশ কালো মেঘে ঢাকা পড়ে। এরপর শুরু হয় ঝড়ো হাওয়া। কিছুক্ষণের মধ্যেই কালবৈশাখির ঝড়ের সঙ্গে শুরু হয় শিলাবৃষ্টি। একপর্যায়ে বৃষ্টি কম হলো প্রচুর পরিমাণে শিলা পড়তে থাকে। দীর্ঘ সময় ধরে শিলা পড়ার কারণে যশোরে বোরো মৌসুমে উঠতি ধানের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। সবেচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে চৌগাছা উপজেলায়। শেষ সময়ে শিলাবৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় চিন্তিত হাজার হাজার চাষি।
সিংহঝুলি গ্রামের কৃষক ফারুক দফাদার এবার পাঁচ বিঘা জমিতে বাসমতি ধান চাষ করেছিলেন। শিলাবৃষ্টিতে তার ৫ বিঘাতে শিলার আঘাত এনেছে। তিনি বলেন, ‘পাঁ বিঘাতে বাসমতি ধান লাগিয়েছিলাম। এই মাঠে যারা বাসমতি ধান করেছে, তাদের ধানের ফলন হয়েছে ভালো। প্রতি বিঘাতে ২৫ মণের নিচে হবে না। প্রতিটি জমিতে কিছুটা কাঁচা থাকাতে ধান কাটতে দু-একদিন দেরি করেছিলাম। তার আগে শিলাবৃষ্টিতে বেঁটে দিয়ে গেছে। ধান গাছ আছে, শিষ আছে কিন্তু ধান নেই। জমির মাটি সোনালী রঙে ছেয়ে গেছে ধানে। প্রতি বিঘাতে ৫০ হাজার টাকার বেশি ক্ষতি হয়ে গেছে। ধানের অবস্থা দেখে গেল রাতে আমার ঘুম হয়নি। এখন সার পানির দাম কি করে দিবানি এই নিয়ে চিন্তায় রয়েছি।’
চৌগাছা উপজেলার ফুলসারা গ্রামের কৃষক মিজানুর রহমান বলেন, দেড় বিঘা জমি চাষ করেছি। একটি ধানও বাড়িতে আনতে পারিনি। অথচ সার-কীটনাশকের দোকানে বাকি রয়েছে। সামনে হালখাতা। এছাড়া অন্য জেলা থেকে দিনমজুর এসেছে তাদের টাকা পরিশোধ, কাপড়ের দোকান, ছেলে-মেয়েদের শিক্ষার খরচ, পুরনো দেনা রয়েছে। সব কিছু মিলিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছি।’
সদরের হৈবতপুর গ্রামের শাহাবুদ্দিন হোসেন জানান, শিলাবৃষ্টিতে তার ঘরের টিনগুলো ফুটো হয়ে গেছে। এছাড়া চুড়ামনকাটির আদর্শপাড়ায় দুটি ঘরের টিনের পুরোটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দোগাছিয়া গ্রামের কৃষক হাবিব জানান, বিঘা প্রতি ৩০ মণ পাওয়ার আশা ছিলো। হঠাৎ শিলাবৃষ্টিতে তার পাকা ধান অর্ধেকের বেশি ঝরে গেছে।’
যশোর বিমান বন্দর আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, সোমবার দুপুর ২টার দিকে আকাশ অন্ধকার হয়ে আসে। শিলাবৃষ্টি শুরু হয় দুপুর ২টা ২৫ মিনিটে। থেমে থেমে বৃষ্টি হয় বিকেল ৪টা ২০ মিনিট। বৃষ্টিপাত হয় ৬ মিলিমিটার। সেই সাথে ৩৫ কিলোমিটার বেগে ঝড় হয়।
যশোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘এই সময়ে কালবৈশাখী ও শিলাবৃষ্টি স্বাভাবিক। তবে এবার যশোরের চৌগাছা উপজেলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। কৃষকদের বলা হয়েছে, কেটে রাখা ধান দ্রুত ক্ষেত থেকে সরিয়ে নিতে এবং জমি থেকে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে।’
তিনি জানান, এ বছর যশোর জেলায় মোট ১ লাখ ৫৭ হাজার ৫০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষ হয়েছে। এর মধ্যে সোমবার পর্যন্ত প্রায় ৫১ শতাংশ জমির ধান কাটা হয়েছে।
তার দেয়া তথ্যমতে, আধা ঘন্টার শিলাবৃষ্টিতে বোরো ধানের ৫ হাজার ১১ হেক্টর জমির ধান, তিল ১৩ হেক্টর, কলা ৩ হেক্টর, মরিচ ৮ হেক্টর, আম ১৭ হেক্টর, পাট ১ হাজার ৪৩৪ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে।