বাংলার ভোর প্রতিবেদক
ডিজিটাল প্লাটফর্মে চিকিৎসা প্রতারণা করে দন্ডিত প্রতারক খন্দকার কবীর হোসেন কোটিপতি বনে গেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। মানুষ ঠকানোর অর্থে তিনি যশোর সদর উপজেলার চুড়ামনকাটি ইউনিয়নের খিতিবদিয়ায় ছয়তলা ও চারতলা দুটি আলিশান বাড়ি করেছেন। ছাতিয়ানতলার মল্লিকপাড়ায় রয়েছে আরও একটি চারতলা বাড়ি। এছাড়া বিভিন্ন এলাকায় কিনেছেন বিঘা বিঘা জমি। স্থানীয়রা বলছেন, গোপালগঞ্জে বাড়ি হওয়ায় অনেকে কবীরের ভয়ে নিরব থাকতেন। মুখ বুঝে তার প্রতারণা সহ্য করতেন। ‘গোপালগঞ্জের’ দাপট দেখিয়ে প্রতারণায় খন্দকার কবীর এখন জিরো থেকে হিরো। বিগত দিনে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দেয়া হলেও রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, খন্দকার কবীর হোসেনের পৈত্রিক বাড়ি গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ার নারকেলবাড়িয়া এলাকায়। তার পিতা ওসমান আলী খন্দকার ও মাতার নাম রিজিয়া খাতুন। তিনি একটি বিশেষ বাহিনীর চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর থেকেই যশোর সদর উপজেলার চুড়ামনকাটি ইউনিয়নের ছাতিয়ানতলা গ্রামের অধ্যাপক মসিউল আযমের বাড়িতে ভাড়ায় বসবাস শুরু করেন। কবীর সেখানে ছাদ বাগান করেন। এর ১ বছর পর তিনি ছাতিয়ান তলা মল্লিক পাড়ায় মাসুদ পারভেজের ভাড়াবাড়িতে চলে আসেন। সেখানে তিনি ননী ফল নার্সারি করেন। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ননীফল নার্সারিকে পুঁজি করে শুরু হয় খন্দকার কবীরের মানুষ ঠকানো ব্যবসা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ননী ফল নার্সারির আড়ালে চিকিৎসার নামে প্রতারণার ফাঁদ পাতেন খন্দকার কবীর হোসেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে সাধারণ মানুষের দুর্বলতাকে পূঁজি করে যৌন ও ক্যান্সার চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসা দিচ্ছিলেন। ২০২২ সালের ১৭ মে জেলা প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগ প্রতারক কবীরের ডেরায় অভিযান চালায়। এ সময় আপাদমস্তক এই প্রতারকের মুখোশ উন্মোচন হয়। তৎকালীন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সৌম্য চৌধুরী ও সিভিল সার্জন ডা. বিপ্লব কান্তি বিশ্বাসের নেতৃত্বে পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালত ক্যান্সার ও যৌন চিকিৎসায় প্রতারণা ও অবৈধভাবে ওষুধ তৈরির দায়ে খন্দকার কবীর হোসেনকে ৩ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড ও এক লাখ টাকা জরিমানা আদায় করে। নামের পরে মিলিটারি শব্দ যোগ করায় কবীরকে সতর্ক করা হয়।
অভিযোগ রয়েছে, প্রতারক কবীর জেল থেকে জামিনে বেরিয়ে এসেই ডিজিটাল প্লাটফর্মে চিকিৎসা প্রতারণা ব্যবসা জোরদার করেন। একাধিক ফেসবুক পেজ খুলে দেশব্যাপি নেটওয়ার্ক তৈরি করে সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে (চিকিৎসা ও ওষুধ পাঠানোর নামে) মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়। ৯০ বছরের বৃদ্ধকে যুবক বানানোর ঘোষণা দিয়েও তিনি প্রতারণা চালান। এসব অভিযোগে ১৭ অক্টোবর কোতোয়ালি মডেল থানা পুলিশ খন্দকার কবীর হোসেনের ডেরায় অভিযান চালায়। এসময় কবীর হোসেন পালিয়ে রক্ষা গেলেও তার চার সহযোগীকে আটক করে পুলিশ। পরে এস আই মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বাদী হয়ে কবীর ও তার ৪ সহযোগীর নামে মামলা দায়ের করেন। কিছু দিন গাঁ ঢাকা দিয়ে থাকার পর তিনি ফের প্রতারণা ব্যবসা শুরু করেন।
এদিকে, ২০২৩ সালের ১৪ জানুয়ারি রাতে খন্দকার কবীর ফের আটক হন। কুষ্টিয়া সদর থানা পুলিশ একটি প্রতারণা মামলায় নিজ বাড়ি থেকে তাকে আটক করে। কুষ্টিয়ার সরকারি একটি দফতরে অফিস সহকারী পদে কর্মরত তানজিল নামে এক ব্যক্তি খন্দকার কবীর হোসেনের ফাঁদে পড়ে চিকিৎসা প্রতারিত হন। ফলে ১ জানুয়ারি তিনি (তানজিল) খন্দকার কবীর হোসেনের নামে কুষ্টিয়া সদর থানায় প্রতারণার মামলা করেন। যার নম্বর ২৩।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, এতকিছুর পরও থেমে নেই খন্দকার কবীর। ডিজিটাল প্লাটফর্মের মাধ্যমে তিনি চিকিৎসা প্রতারণা সারাদেশে ছড়িয়ে দিয়েছেন। ব্যবসা জমজমাট করতে খোলা হয়েছে একাধিক ফেসবুক পেজ। যোগাযোগের জন্য পেজে দেয়া হয়েছে একাধিক মোবাইল নম্বর। প্রতারণায় কৌশল অবলম্বন করে প্রতারক কবীর কুরিয়ারে ওষুধ দেয়ার নামে মানুষের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েও ওষুধ পাঠানো হচ্ছেনা।
সূত্র জানায়, বিগত দিনে এমন প্রতারণার শিকার হয়েছেন লক্ষীপুরের কমলনগর থানার চর কাদিয়া গ্রামের মোহাম্মদ শাহজাহানের ছেলে সোহেল (৩৫)। কুরিয়ার সার্ভিসে ওষুধ পাঠানোর নামে কবীর তার কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন সাড়ে ৯ হাজার টাকা। এই ঘটনায় প্রতারিত সোহেল লক্ষীপুর থানায় একটি জিডি করেছিলেন।
সূত্রটি আরও জানায়, খন্দকার কবীর সোস্যাল মিডিয়া ও বিভিন্ন ইউটিউবারদের ম্যানেজ করে চিকিৎসা প্রচারণা চালিয়ে থাকেন। এসব প্রচারণা বিশ্বাস করে অর্থ হারাচ্ছেন অনেক মানুষ। তার মূল টার্গেট হচ্ছে যৌন দুর্বল মানুষ। সোস্যাল মিডিয়ায় তার প্রচারণা ভাষা এমনি যে “একটা দুর্বল পুরুষের জন্য এই দুইটা ফাইল যথেষ্ট। জীবনে আর ওষুধ খেতে হবেনা। সে যত বড় সমস্যা হোক না কেনো। এছাড়া চুলকানী, কষা, খিচা ডায়াবেটিস, গ্যাস্ট্রিক, পেটের গন্ডগোল, হজমের সমস্যা, লিভার নষ্ট, হৃদরোগ,ডায়াবেটিস ও ক্যান্সারসহ নানা রোগের কাজ করে এই ওষুধ।” তার খপ্পরে অনেকে সর্বশান্ত হলেও আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছেন কবীর।
এলাকাবাসীর তথ্য মতে, প্রতারণা করে মহাটাউট কবীর এখন কোটি কোটি টাকার মালিক। যশোরে তিনটি আলিশান বাড়ি নির্মাণ করেছেন। এরমধ্যে ছাতিয়ানতলা মল্লিকপাড়ায় চার তলা বাড়ি, খিতিবদিয়া গ্রামে দুটির একটি ছয় তলা ও অপরটি চার তলা। যার একটি খিতিবদিয়া পুকুর মোড় ও অপরটি কলাবাগান রোডে অবস্থিত। জমি কিনে তিনি এসব আলিশান বাড়ি নির্মাণ করেছেন। এছাড়াও ছাতিয়ানতলা মল্লিক পাড়া, খিতিবদিয়া,শানতলাসহ বিভিন্নস্থানে নামে-বেনামে আরো কয়েক বিঘা জমি কিনেছেন। বরিশাল ও গোপালগঞ্জে কবীরের আরো দুটি আলিশান বাড়ি আছে জানান ছাতিয়ানতলা গ্রামের জাকির হোসেন।
ছাতিয়ানতলা গ্রামের মিঠু চাকলাদার জানান, ২০২২ সালে তার শাশুড়ির ক্যান্সার নিরাময়ে ১০০ ভাগ গ্যারান্টি দিয়ে ওষুধ দেন খন্দকার কবীর। চিকিৎসা বাবদ নেয়া হয় ৭০ হাজার টাকা। বলা হয় এই ওষুধ খেলে কেমোথেরাপি ছাড়াই ক্যান্সার ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু ওষুধ খাওয়ানোর কিছু দিন পর তার শাশুড়ি মারা যান। মিঠু চাকলাদার আরও জানান, তার মতো অনেক মানুষের সাথে প্রতারণা করে হাতিয়ে নেয়া টাকায় খন্দকার কবীর কোটিপতি বনে গেছেন। কবীরের প্রতারণা থেকে রেহাই পাননি প্রতিবেশী আব্দুর রাজ্জাক। তার মায়ের ক্যান্সার চিকিৎসার নামে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে মোটা অংকের টাকা।
ছাতিয়ানতলা গ্রামের মুরাদ হোসেন, তৌহিদ আহমেদ, চুড়ামনকাটি গ্রামের আবুল কালাম, হাফিজুর রহমান, মাহবুব হাসান, মামুন হোসেনসহ অনেকেই জানান, খন্দকার কবীরের বাড়ি গোপালগঞ্জ হওয়ার কারণে তিনি দাপট দেখিয়ে চলাফেরা করতেন। এলাকার একটি প্রভাবশালী চক্রকেও তিনি ম্যানেজ করেছিলেন। ফলে প্রতারিত অনেক মানুষ তার ডেরায় গিয়ে প্রতিবাদ করার সাহস পেতেন না। প্রতিবাদ করলেই নানাভাবে হয়রানি করা হতো। গোপালগঞ্জের প্রভাবে বিভিন্ন মহলকে ম্যানেজ করে খন্দকার কবীর অনেকটা ফ্রি-স্টাইলে প্রতারণা করেছেন। বছরের পর বছর সাধারণ মানুষকে ঠকিয়ে হয়েছেন অধিক ধন সম্পদের মালিক। তার অবৈধ সম্পদের খোঁজ নেয়ার জন্য দুদকের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
লিখিত অভিযোগকারী তার নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করেছেন। অভিযোগের কপি সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদককে মেইলে পাঠিয়েছেন তিনি। লিখিত অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, খন্দকার কবীর হোসেন চাকরি দেয়ার নাম করে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। চুক্তির শুরুতে সাদা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করে অনেকে আবার ব্লাকমেইলিংয়ের শিকার হন। তিনি চাকরি থেকে অবসর জীবনে থাকলেও প্রভাব বিস্তারে গোয়েন্দা সংস্থায় চাকরি করেন বলে এলাকায় প্রচার করতেন।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে খন্দকার কবীর সাংবাদিকদের জানান, চুরি ডাকাতি করে ধন সম্পদের মালিক হয়েছি। সাংবাদিকদের মতো চাঁদাবাজি করিনা।
যশোরের সিভিল সার্জন ডা.মাহমুদুল হাসান জানান, চিকিৎসা প্রতারণার অভিযোগে খন্দকার কবীরের ডিজিটাল প্লাটফর্মে চিকিৎসা প্রতারণার বিষয়টি জানতাম না। এ ধরনের প্রতারণা অবশ্যই দুঃখজনক। তার প্রতারণা বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। চিকিৎসার নামে মানুষকে ঠকিয়ে প্রতারণা করার সুযোগ দেয়া হবে না।
যশোরের জেলা প্রশাসক আজাহারুল ইসলাম জানান, যৌন ও ক্যান্সার চিকিৎসার নামে খন্দকার কবীরের প্রতারণার ফাঁদের বিষয়টি তিনি জানতেন না। অবশ্যই খোঁজ নিয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। প্রতারণা করে কোটিপতি বনে যাওয়ার বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হবে।