শেখ জালাল
জুলাই বিপ্লবে শহিদ ইমতিয়াজ আহমেদ জাবির। ঢাকায় পুলিশের গুলিত নিহত হন তিনি। শহিদ বীর সন্তানের স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে আছেন মা শিরিন আক্তার। মা আজও চোখের পানি ফেলছেন। একজন মা কীভাবে তার প্রাণপ্রিয় ছেলের গুলিবিদ্ধ লাশের গন্ধ ভুলে যাবেন? কীভাবে ভুলবেন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছেলের সেই আর্তনাদ ? জাবিরের মায়ের আর্তনাদ আজও বহমান। জাবির ছিল প্রাণপ্রিয় সন্তান, যাকে তিনি জন্ম দিয়েছেন, কোলেপিঠে করে মানুষ করেছেন। সেই জাবিরে সঙ্গে ঘটে যাওয়া নৃশংসতা তাকে ধুকে ধুকে মারছে দুঃস্বপ্নের মতো।
যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার হাজিরবাগ ইউনিয়নের দেউলি গ্রামের নওশের আলী ও শিরিনা আক্তারের একমাত্র ছেলে জাবির। এসএসসি ও এইচএসসিতে মেধার সাক্ষর রাখা জাবির সাউথ-ইস্ট ইউনিভার্সিটির বিবিএ প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। থাকতেন রাজধানীর বনশ্রী এলাকার একটি মেসে। জুলাই বিপ্লবে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতন আন্দোলনে রাজপথে সোচ্চার ছিলেন জাবির।
মা দিবসে সন্তানের স্মৃতিচারণ করেছেন শিরিন আক্তার। তিনি বলেন, আমরা মত আর কোনো মায়ের বুকফাটা আর্তনাদ শুনতে চাই না। পরিবার থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ প্রতিটি পর্যায়ে আমরা যেন চেষ্টা করি আর এমন একটি পুলিশবাহিনী তৈরি না হয়। আর একজন জাবিরকে যেন অকালে হারিয়ে যেতে না হয়।
তিনি বলেন, আন্দোলন সফল হয়েছে, কিন্তু আমার বুকের মানিক হারিয়ে গেছে। এক মুহূর্তের জন্য তিনি ভুলে যেতে পারেননি সে দিনগুলোর স্মৃতি। কারণ তিনি মা, তার অভিব্যক্তি অনেক গভীর, স্নেহের জালে ঘেরা তার সন্তানেরা। তার মমতা অতুলনীয়। জাবিরের মা, যিনি ছেলে হারিয়েছেন বটে, তিনি একজন বীরসন্তানের মা।
‘কোটা আন্দোলন সফল হয়েছে। সরকারেরও পতন হয়েছে। কিন্তু আমার বুকের মানিক হারিয়ে গেছে’, পুলিশের গুলিতে একমাত্র ছেলে ইমতিয়াজ আহমেদ জাবিরকে হারিয়ে দিন-রাত এভাবেই বিলাপ করছেন জাবিরের মা শিরিনা আক্তার। কখনো ছেলের পড়ার টেবিলে, কখনো-বা খাবার টেবিলে বসে অঝোরে কেঁদেই চলেছেন।
মা শিরিনা আক্তার আরও বলেন, জাবিরকে শুধু আমি ভালবাসতাম না। জাবিরও আমাকে ভালবাসতো। জাবিরের ভালবাসা ছিল অন্য রকম। খুব মনে পড়ে।
তিনি জানান, জাবির বাইরে থেকে ঘরে ফিললেই জড়িয়ে ধরে চুমু দিত আমাকে। মাথায়, কপালে হাত বুলিয়ে দিত। এখনও মনে হয় না জাবির আমাকে ছেড়ে গেছে। সে এত দ্রুত আমাতে ছেড়ে যাবে কখনও ভাবিনি। জাবিরের কাছে প্রতিটি দিনই ছিল দিবস।
গত কোরবানির ঈদে বাড়ি এসেছিল জাবির। ঈদের পর ঢাকায় চলে যায়। এরপর আর বাড়ি আসেনি। মৃত্যুর পর তার লাশটাও বাড়ির উঠানে নিতে দেয়নি। প্রশাসনের চাপ ছিল। ২০২৪ সালের ২৬ জুলাই রাত ১১টায় কবরস্থানের পাশেই কোনো রকমে জানাজা পড়া হয়। এরপর সঙ্গে সঙ্গে কবর দিয়ে দেয়া হয়।
জাবিরের মামা ইমতিয়াজ আহমেদ জানান, ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনে মহাখালীতে অংশ নেয় জাবির। এ দিন তার শরীরে বেশ কয়েকটি রাবার বুলেট লাগে। কিন্তু এ কথা কাউকে সে বলেনি। ওই অবস্থাতেই পরদিন রামপুরায় আন্দোলনে অংশ নেয়। সেখানে বেলা আড়াইটার দিকে পুলিশ গুলি চালায়। জাবিরের চোখের সামনে পুলিশের গুলিতে আন্দোলনরত দুইজনের মৃত্যু হয়। ওই দুইজনকে উদ্ধার করতে গিয়েই পুলিশের ছোড়া বুলেটে গুরুতর আহত হয় জাবির। ১৯ জুলাই শুক্রবার বিকেলে কেউ একজন তার কাছে ফোন করে জানায়, জাবির মুগদা হাসপাতালে ভর্তি, তার জন্য দ্রুত রক্ত লাগবে। পরিচিত এক ব্যক্তির মাধ্যমে এক ব্যাগ রক্তের ব্যবস্থা করা হয়।
আমরাও ঢাকায় পৌঁছে রাতেই জাবিরকে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ভর্তি করি। জাবিরের অবস্থা একটু ভালো হয়। পরিবারের সবার সঙ্গে কথাও বলে। কিন্তু হঠাৎই তার কিডনিতে সমস্যা দেখা দেয়। ডাক্তাররা বলেন, গুলিতে কিডনির একটি শিরা বন্ধ হয়ে গেছে। ডাক্তাররা পা কেটে ফেলার পরামর্শ দেন। ২০২৪ সালের ২২ জুলাই জাবিরকে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করা হয়। কিন্তু এদিন ডাক্তাররা বলেন, পা কাটার প্রয়োজন নেই। পরে জাবিরকে ডায়ালাইসিস করার জন্য নেয়া হয়। কিন্তু আধা ঘণ্টা পর ডায়ালাইসিস বন্ধ হয়ে যায়। নেয়া হয় আইসিইউতে। বিফলে যায় সব চেষ্টা। ২০২৪ সালের ২৬ জুলাই শুক্রবার বিকেল ৪টায় শেষবারের মতো নিঃশ্বাস নেয় জাবির।