বেনজীন খান
যশোরের রাজনীতিতে যাঁরা কিংবদন্তি হয়ে উঠেছিলেন তার মধ্যে মশিয়ূর রহমান, আলমগীর সিদ্দিকী, আব্দুল হক, আফসার আহমদ সিদ্দিকী, মোশাররফ হোসেন, মোশাররফ হোসেন খান, আলী রেজা রাজু এবং তরিকুল ইসলাম অন্যতম।
এর মধ্যে দু’জন আমার আত্মীয়। মশিয়ূর রহমান সম্পর্কে চাচা এবং আলী রেজা রাজু সম্পর্কে ভাগ্নে।
মোশাররফ হোসেন এবং মোশাররফ হোসেন খান আমার শ্রদ্ধেয়।
আলমগীর সিদ্দিকী ও আফসার আহমদ সিদ্দিকী আমার রাজনৈতিক ধারার পূর্বসূরী নেতা।
আর কমরেড আব্দুল হক আমার আদর্শিক নেতা এবং জননেতা তরিকুল ইসলাম আমার রাজনৈতিক বড় ভাই।
এই মহান নেতাদের সাথে পারিবারিক ও রাজনৈতিক সূত্রে আমার রয়েছে কমবেশি জানাবোঝা ও স্মৃতি। অনুভব করছি সেগুলো লেখার।
আজ আমি খুবই অল্প কথায় লেখার চেষ্টা করব দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম জনপ্রিয় নেতা মরহুম তরিকুল ইসলামের কতিপয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে।
একজন জনমানুষের নেতার থাকে হাজারো বৈশিষ্ট্য। সেইসব বৈশিষ্ট্যসমূহের মধ্যে যে দিকগুলো তাঁর দিকে মানুষকে আকৃষ্ট করতে ভূমিকা রাখে এবং যেগুলি মূলত একজন নেতার আকর্ষণ বা চৌম্বক গুণ, আমি এখানে সেই দিকগুলোই আলোচনা করার চেষ্টা করব।
জনাব তরিকুল ইসলাম একটি বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংগঠনের নেতা ছিলেন কিন্তু তাঁর রাজনীতির হাতেখড়ি হয়েছিল এদেশের বাম প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতির মধ্য দিয়ে। সেখান থেকেই তিনি রাজনীতির মহান বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছিলেন। ফলে, ধ্রুপদী বুর্জোয়া রাজনীতির বাইরে গণমানুষের নেতার বৈশিষ্ট্য তাঁর মধ্যে প্রবলভাবে দৃশ্যমান ছিল। তিনি অকপট সত্য কথাটি বলে ফেলতেন এবং মানুষকে খুব সহজে তার সান্নিধ্যে আসার সুযোগ করে দিতেন।
মানুষ তরিকুল ইসলাম এবং নেতা তরিকুল ইসলাম এর মাঝখানে তিনি কোন প্রাচীর রাখতেন না।
খুব সহজেই মানুষ তাঁর কাছে ভিড়তে পারতো এবং নালিশ, অভিযোগ এমনকি কখনো কখনো বিতর্কও করতে পারত।
তিনি অধিকাংশ নেতাকর্মীদের নাম ধরে ডাকতে পারতেন। আর অসম্ভব রকমের হিউমার করার ক্ষমতা তাঁকে মানুষের কাছে অধিক জনপ্রিয় করে তুলেছিল। তিনি কোন কিছু গোপন করে রাখতেন না এবং কোন ভনিতা ছাড়াই মুখের পরে সত্য কথাটি বলে ফেলতেন। তাতে করে তাৎক্ষণিকভাবে অনেকেই হয়তো আহত হতো, ক্ষুব্ধ হতো, কখনো কখনো বিরোধও করতো কিন্তু তাঁর অসম্ভব রকমের বড়ভাই সুলভ ভালোবাসা মানুষের সেই ক্ষোভকে মুহূর্তের মধ্যে ভুলিয়েও দিতো।
আমাদের সমাজে অনেক ধরনের নেতা আছেন যেমন :
একধরনের নেতা আছেন, যিনি কেবল নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকেন কিন্তু মুখে মিষ্ট কথা!
আর এক ধরনের নেতা আছেন, যিনি গুণ্ডা-পাণ্ডা পরিবেষ্টিত থাকেন। পেশিশক্তির উপর ভরসা করেন। কাজ করেন অনুগত ভৃত্যদের জন্য। জনগণ যার কাছে তুচ্ছ!
আর আরেক ধরনের নেতা আছেন, যিনি মানুষকে প্রয়োজনে বকুনি দেন এবং আদর করে কাছে টেনে নিয়ে তাদের কাজটিও করে দেন।
তরিকুল ইসলাম ছিলেন, এই শেষোক্ত জনদের একজন।
যশোর অঞ্চলের দলমত নির্বিশেষে অনেক মানুষই নানাভাবে তাঁর সহযোগিতা, ভালোবাসা এবং সাহায্য পেয়েছে। কিন্তু যেহেতু তিনি প্রকাশ্যে বকুনি দিতেন সেকারণে মানুষ কখনো কখনো তাঁর উপকার ভুলে গিয়ে এই বকুনির কথাই স্মরণে রেখে বিরোধ করেছে আজীবন। যদিও তাদের সংখ্যা সীমিত। তরিকুল ইসলাম স্পষ্টভাষী হওয়ার কারণে যশোরের রাজনীতিতে তিনি সব সময় একটা বড় প্রতিপক্ষের সামনে নিজেকে হাজির রাখতেন। প্রতিপক্ষরা সব সময় জোট বেঁধে তরিকুল ইসলামের বিরোধিতা করেছে। কিন্তু একথাও সত্য, যশোর অঞ্চলের মানুষের কাছে তিনি যত বড় নেতা ওই মাপে পৌঁছাতে পারেনি তাঁর প্রতিপক্ষরা কেউ-ই।
তরিকুল ইসলামের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ যে গুণটি আমাকে মুগ্ধ করতো সেটি হলো, তাঁর পরিমিতিবোধ। তিনি কতগুলো নোমস মেনে চলতেন। অর্থাৎ সমাজের সম্মানিত, জ্ঞানী, গুণী, লেখক, সাহিত্যিক, শিল্পী, সাংবাদিক তাদেরকে গুরুত্ব দিতেন। ভালোবাসতেন। মূল্যায়ন করতেন। এমনভাবে মূল্যায়ন করতেন বা গুরুত্ব দিতেন যে, কখনো কখনো মনে হতো, তিনি যেন এদের ভয় পান! এবং অদ্ভুত ব্যাপার হলো- আমাদের এই বিকৃত সমাজের মানুষেরা তাঁর এই গুণকে দুর্বলতা মনে করত। তাঁর বিরুদ্ধে যত কথা বলা যেতো, সাংবাদিকরা যত কথা লিখতে পারতো, যশোরে তাঁর সময়ে আর কোন নেতার বিরুদ্ধে এত কথা বলা বা লেখা যায়নি কখনো। ফলে তাঁর বিরুদ্ধে লিখে বা বলে রাতারাতি যশোর অঞ্চলে অনেকেই বিশাল বিশাল সাংবাদিক বা বড় নেতা হয়ে গেছে। বলা চলে, তরিকুল ইসলামের বিরুদ্ধাচারণে মজা ছিলো।
আমার জানা মতে, যশোরের সংবাদ জগত ও রাজনীতিক পাড়ায় প্রোথিতযশা অনেক সাংবাদিক ও নেতার পেটে গলা পর্যন্ত তরিকুল ইসলামের সহযোগিতার অন্ন রয়েছে। অথচ তাদেরকেই আমি দেখেছি, তরিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে নির্লজ্জ বিরোধ ও কুৎসা রটাতে। আর তরিকুল ইসলামকে দেখেছি, তাদেরকেই গুরুত্ব দিয়ে পাশে বসিয়ে খোশগল্প করতে। এসব দৃশ্য মাঝে মধ্যে আমার ভেতরে যারপরনাই বিরক্ত উৎপাদন করতো।
আমার তাঁর প্রতি যে জায়গাটিতে দুর্বলতা ছিলো সেটি হলো, তিনি আমাকে ভালোবাসতেন। আমি কতটুকু জানি বা বুঝি সেটা আমি জানি কিন্তু তরিকুল ভাই বিশ্বাস করতেন আমি অনেক জানি! অসংখ্য দিন তিনি দেশের যেখানেই থাকতেন দেশ ও দলের সংকটে, প্রয়োজনে আমর মতামত জানতে চাইতেন। আমি খাওয়া ঘুম হারাম করে তথ্য-উপাত্ত যোগাড় করতাম। বড় মানুষদের এ এক মহৎ গুণ। সমাজে তাঁদের অসংখ্য পকেট থাকে; যেখান থেকে তাঁরা আপন মত যাচাই ও সংগ্রহ করেন। সে অনেক কথা! হয়তো সময় সুযোগে আরো লিখবো।
তিনি কবি-সাহিত্যিক দেখলেই ভাবতেন, এরা অনেক পণ্ডিত; অনেক জানে! আসলে তাঁর মধ্যে ছিলো শিশুর মতো সারল্য। তিনি আমার জানাবুঝাকে সমীহ করতেন! উৎসাহ দিতেন।
তরিকুল ইসলাম সম্পর্কে দেশের দক্ষিণপশ্চিম অঞ্চলের মানুষের মধ্যে রসালো গল্প আছে। ভাই, যশোর অঞ্চলের ভাষায় বিশেষ একটি শব্দ প্রয়োগে মুখখিস্তি করতেন কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, তাঁর মুখে এই খিস্তি খেউর যেনো আর্ট-এ পরিণত হয়েছিল!
যাদেরকে তিনি নীচু এবং অসৎ জানতেন, মূর্খ জানতেন, তাদেরকে কখনোই পাত্তা দিতেন না। সম্মানের ক্ষেত্রে কাকে কোথায় রাখতে হবে তিনি জানতেন। মানুষ সম্পর্কে তাঁর আপাদমস্তক নিজস্ব পর্যালোচনা, মূল্যায়ন, বিচার বিবেচনা ছিল। আমি অলক্ষ্যে থেকে অনেক সময় বোঝার চেষ্টা করেছি, তার এই বিচার কতটুকু সঠিক অথবা বেঠিক! অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমি দেখেছি, তার মূল্যায়ন সঠিক ছিলো!
তরিকুল ইসলামের যেটুকু দুর্বলতা ছিলো বা যেখানে তার সমালোচনা সেটি হলো, তিনি কখনো কখনো কান কথায় বিশ্বাস করতেন এবং সমাজের কিছু চিহ্নিত চাটুকারদের তিনি আমৃত্যু বুঝতে ব্যর্থ হয়ে ছিলেন।
তরিকুল ইসলামের মৃত্যুর পর তাঁর নামাজে জানাজায় মানুষের উপস্থিতি স্বাক্ষ্য দিয়েছিলো তাঁর সময়ে তিনিই এ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। এবং তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যশোরের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ভারসাম্য হারিয়েছে।
মানুষ অভিভাবকহীন হয়েছে।