বাংলার ভোর প্রতিবেদক
ষষ্ঠ উপজেলার দ্বিতীয় ধাপে নির্বাচনে যশোরের শার্শা, ঝিকরগাছা ও চৌগাছাতে শান্তিপূর্ণভাবে ভোট গ্রহণ শেষ হয়েছে। মঙ্গলবার সকাল ৮ টা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত ইভিএম মেশিনের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো ভোট প্রদান করেন উপজেলা তিনটির ভোটাররা। তিনটি উপজেলাতেই ভোটকেন্দ্রগুলোয় ভোটারের উপস্থিতি আশানুরূপ হয়নি। কিছু ভোটকেন্দ্র একেবারেই ফাঁকা দেখা গেছে। দেখা যায়নি ভোটারদের দীর্ঘ লাইন। তবে গ্রামের ভোটকেন্দ্রগুলো ভোটারের ভালো উপস্থিতি ছিল।
এদিকে, প্রথমবারের মত উপজেলা তিনটিতে ইভিএমের মাধ্যমে ভোট গ্রহণ হওয়ায় আঙুলের ছাপ না মেলার ভোগান্তিতে পড়েন বেশিরভাগ ভোটার। বেশ কিছু কেন্দ্র আঙ্গুলের ছাপ না মেলায় ভোট না দিয়ে বাড়ি যাওয়ার খবরও পাওয়া গেছে। আর চৌগাছায় একটি কেন্দ্রে হাতুড়ি নিয়ে ভোটারদের মারতে উদ্যত হওয়ায় আব্দুল মাজিদ নামে এক ব্যক্তিকে দুই মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড ও ৫শ’ টাকা জরিমানা করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত।
নির্বাচন অফিস সূত্র জানিয়েছে, যশোরের শার্শা, ঝিকরগাছা ও চৌগাছা উপজেলায় চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানের ৮টি (একজন বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত) পদে ২৯ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে ইভিএম’এ ২৯৩টি কেন্দ্রের ২১৭৩টি কক্ষে এদিন ভোট দেন ভোটাররা।
বেলা সাড়ে ১১ টার দিকে শার্শার বুরুজবাগান পাইলট উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় কেন্দ্র গিয়ে দেখা গেছে, ভোট কেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি অনেকটা কম। কেন্দ্রের তিন নাম্বার কক্ষের ভোট গ্রহণের সামনে একটি চেয়ারে বসে থাকতে দেখা যায় ষাটোর্ধ সফিউর রহমান বকুলকে। সাদা পায়জামা পরাহিত এই বৃদ্ধের সারা শরীর ঘেমে জবুথবু অবস্থা। মুখে বিরক্তি আর ক্লান্তির ছাপ। ভোট দিয়েছেন জানতে চাইলে তিনি ক্ষোভের স্বরে বলেন, ‘দেড় ঘন্টা ধরে এই কক্ষে বসে আছি। চারবার ভোট দিতে এসেছি; একবারও ভোট দিতে পারিনি। আঙ্গুলের ছাপই মিলছে না। এই বৃদ্ধের ভাষ্য- বারবার হেক্সিসল, সাবান দিয়ে হাত ধুয়েছি, মেরিল দিয়ে ঘষেও তার আঙুলের ছাপ মেলেনি। পরে সহকারী প্রিজাইডিং কর্মকর্তা তাকে বসিয়ে রেখে প্রিজাইডিং কর্মকর্তাকে খবর দেন। চারবার চেষ্টা করে ভোট দিতে না পেরে যাওয়ার পথে বলতে শোনা যায় আমি এই দেশের নাগরিক না! কতবার ভোট দিয়েছি; এবার ভোটই দিতে পারলাম না। একই কক্ষের পোলিং অফিসার তানিয়া সুলতানা বলেন, ‘বয়স্কদের হাতের আঙ্গুলের ছাপ মিলতে দেরি হচ্ছে। সাড়ে তিন ঘন্টায় ৭৪ জনের ভোট গ্রহণ হয়েছে। হাতের আঙ্গুলে ছাপ না মেলানোয় আরো দেরি হচ্ছে। হাতের আঙ্গুলের ছাপ না মেলায় এই কক্ষের ২০ থেকে ২৫ জন ভোটার চলে গেছেন।’ কেন্দ্রটির প্রিজাইডিং অফিসার আব্দুর রাশেদ বলেন,‘ভোট গ্রহণে কোন অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেনি। রং মিস্ত্রী, বয়স্ক, কর্মকার শ্রমিক শ্রেণীদের হাতের ছাপ মিলছে না। অনেকেই চলে যাচ্ছে। অনেকের কোন সমস্যা হচ্ছে না।’
নাভারন রেল বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (নারী) কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার শহিদুল আজম জানান, ‘বেলা সাড়ে ১১ টার দিকে তিন ঘন্টায় তিন হাজার ১৬ ভোটের মধ্যে ৩০০ ভোট কাস্ট হয়েছে। ভোটারদের উপস্থিতি কম। ইভিএমে ভোট গ্রহণে মাঝে মধ্যে হাতের ছাপ না মেলাতে ধীরগতি হচ্ছে।’
বেনাপোল মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার গোলাম রসুল রানা বলেন, সাড়ে চার ঘন্টায় ২৬১৩ ভোটের মধ্যে ভোট গ্রহণ হয়েছে ২৯৪ ভোট। ভোটারদের উপস্থিতি কম; আবার কোন কোন ভোটারের আঙ্গুলের ছাপ না মেলাতে ভোট গ্রহণে একটু ধীরগতি। বিশেষ করে বয়স্ক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এমনটা হচ্ছে। আমরা তাদের পরামর্শ দিচ্ছি দুপুর নাগাদ আরেকবার আসতে।’
এদিকে, বেলা সাড়ে ১২ টার দিকে বেনাপোল মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র পরিদর্শন করেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবরাউল হাছান মজুমদার ও পুলিশ সুপার প্রলয় কুমার জোয়ার্দার। এ সময় তার সঙ্গে জেলা প্রশাসন, পুলিশ ও জেলা ও উপজেলা নির্বাচন অফিসাররা উপস্থিত ছিলেন।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবরাউল হাছান মজুমদার বলেন, সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে ভোট গ্রহণ চলছে। কোথাও অপ্রতিকর ঘটনা ঘটেনি। ভোটের মাঠে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করছে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বয়স্কদের আঙুলের রেখা মুছে যাওয়ার কারণে এই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। তবে একাধিকবার চেষ্টার পর অনেকের ভোট হয়েছে। তারপরও নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী বয়স্ক ভোটারদের ভোট নিশ্চিতের চেষ্টা করার ভোটগ্রহণে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেয়া রয়েছে।
দুই ঘণ্টায় ৬৬ ভোট
দুই ঘণ্টায় যশোরের শার্শা উপজেলার কোদলারহাট মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ৬৬টি, যার শতকরা হার ২ দশমিক ৫৬। মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টায় এই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার মো. আব্দুর রহমান এ তথ্য দিয়েছেন। অন্যান্য কেন্দ্রের মতো শার্শা উপজেলার রঘুনাথপুর এলাকার ভোটকেন্দ্রে সকাল ৮টা থেকে ভোটগ্রহণ শুরু হয়। সকাল ১০টা নাগাদ এই কেন্দ্রে ৬৬ জন তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পেরেছেন। কেন্দ্রে ভোট ভোটার ২৫৭৮, যার মধ্যে পুরুষ ভোটার ১৫৫০ এবং নারী ভোটারের সংখ্যা ১০২৮ জন। প্রিসাইডিং অফিসার আব্দুর রহমান বলেন, সকাল থেকে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোটগ্রহণ চলছে। দুই ঘণ্টায় এই কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ হয়েছে ৬৬ জনের, যার শতকরা হার ২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। শার্শা উপজেলায় মোট ২ লাখ ৯৯ হাজার ১১১ জন ভোটারের মধ্যে পুরুষ ১ লাখ ৫০ হাজার ১৯৯ এবং নারী ১ লাখ ৪৮ হাজার ৯১০ জন।
ঝিকরগাছার এক কেন্দ্রে ৪৫ মিনিটে পড়লো ৩২ ভোট
ঝিকরগাছা উপজেলার বদরুদ্দীন মুসলিম হাইস্কুল কেন্দ্রে ভোটগ্রহণের প্রথম ৪৫ মিনিটে ৩২ ভোট পড়েছে। কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার মো. সালাউদ্দিন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, কোনোরকম ঝামেলা ছাড়াই সকাল থেকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ভোটগ্রহণ করা হচ্ছে। মঙ্গলবার সকাল ৮টায় শুরু হওয়া এই কেন্দ্রে মোট ভোটার তিন হাজার ১৩৩ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার এক হাজার ৪৮৩ এবং এক হাজার ৬৫২ জন নারী ভোটার রয়েছেন।
চৌগাছায় অধিকাংশ কেন্দ্র ফাঁকা !
সকালে ভোট কেন্দ্রগুলো ঘুরে দেখা গেছে ভোটার উপস্থিতি খুব কম। ভোট কেন্দ্রের বাইরে কিছু লোক সমাগম থাকলেও কেন্দ্রের ভিতরে কোনো লাইন চোখে পড়েনি। চৌগাছা উপজেলার সিংহঝুলি ইউনিয়নের সিংহঝুলি শহীদ মসিয়ূর রহমান ভোট কেন্দ্রে দেখা গেছে ভোট কেন্দ্রের মাঠে বাচ্চারা ফুটবল খেলছে। ভোটার উপস্থিতি চোখে পড়ার মত না। পুলিশ, আনসার বাহিনীর সদস্যরা অলস সময় পার করছেন। এই ভোট কেন্দ্রে মোট ভোটার ৩৩শ’ ৫১ জন। বেলা ১১ টা পর্যন্ত ভোট পড়ে ১শ’ ৪২টি। এই কেন্দ্রে ভোট দিতে আসা আমেনা বেগম বলেন, জীবনে প্রথম মেশিনে ভোট দিছি। আগের ভোটগুলোর চেয়ে এবার সহজে ভোট দিতে পেরেছি। ভোট দিতে কোনো সমস্যা হয়নি।
প্রিজাইডিং অফিসার কবিতা খানম বলেন, ভোট কেন্দ্রে ভোটার আসা না আসা তাদের ব্যাপার। আমার কেন্দ্রে সুষ্ঠ,সুন্দর পরিবেশে ভোট অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সরুপদাহ ইউনিয়নের মাশিলা মাধ্যমিক বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রে ১৯ শ’ ৪৫ ভোটের মধ্যে বেলা ১২ টা পর্যন্ত ৩৪২ ভোট পড়েছে। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন ওই কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার মারুফ হোসেন। এই কেন্দ্রের ভিতরে ও বাইরে ভোটারদের কোনো রকম জটলা দেখা যায়নি। প্রিজাইডিং অফিসার মারুফ হোসেন বলেন, আমার কেন্দ্রে ভোট কাটাকাটির কোনো সুযোগ নেই। ভোট কাটাকাটি তো দূরের কথা আমার কেন্দ্রের আশে পাশেও ওই ধরণের কোনো লোক আসতে পারবে না।
পাতিবিলা ইউনিয়নের রুস্তমপুর দাখিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে দুপুর ২ টার সময় গিয়ে দেখা গেছে ১৯৬ জন ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। এই কেন্দ্রে মোট ভোটারের সংখ্যা ছিলো ২ হাজার ৬৫ জন। চৌগাছা হাজী সরদার মর্ত্তজ আলী মাধ্যমিক বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রে ভোট দিতে এসে অঙ্গুলের ছাপ না মেলাতে ভোট না দিয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন অনেকেই।
চৌগাছা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রে ভোট দিতে আসা আরিফুল ইসলাম বলেন, ভোট হচ্ছে সে কথা সাধারণ মানুষের মনে নেই। ভোটে কারা প্রার্থী হয়েছেন তাদের সবাইকে তিনি চিনেন না। প্রার্থীরা তার কাছে বা বাড়িতে গিয়ে কোনো দিন ভোট চাইনি। আগের মত আর ভোট উৎসব নেই। পছন্দের চেয়ারম্যান প্রার্থীকে ভোট দিয়ে তিনি বাড়ি ফিরছি।
এদিকে চৌগাছা উপজেলার চেয়ারম্যান প্রার্থী এসএম হাবিবুর রহমানের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট সাইফুর রহমান বাবুল বলেন, ইভিএম এ ভোট দিতে মানুষ অভ্যস্থ না। প্রতিপক্ষ প্রার্থীর কর্মী সমর্থকরা গুজব রটাচ্ছে ভোট যেখানে দেয়া হোক না কেন তারাই পাশ করবে।
এদিকে, চৌগাছা উপজেলা স্বরূপদাহ ইউনিয়নের বড়কাকুড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট চলছিল। দুপুর আড়াইটার দিকে আব্দুল মজিদ নামে এক যুবক বাড়ি থেকে একটি হাতুড়ি নিয়ে এসে ভোটারদের মারতে উদ্যত হন। এসময় পুলিশ সদস্যরা তাকে আটক করেন। পরে ভ্রাম্যমাণ আদালত তাকে সাজা দেন। ভোটকেন্দ্রে হাতুড়ি প্রদর্শন করে জেল হাজতে যাওয়া যুবক আব্দুল মজিদ (৩৫) উপজেলার স্বরূপদাহ ইউনিয়নের বড়কাকুড়িয়া গ্রামের আব্দুল কাদেরের ছেলে। ভ্রাম্যমাণ আদালত ওই যুবককে দুই মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড ও ৫শ’ টাকা জরিমানা করেছেন। চৌগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুস্মিতা সাহা বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
এ বিষয়ে, চৌগাছা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইকবাল বাহার চৌধুরী বলেন, আব্দুল মজিদ সাধারণ ভোটারের মধ্য ভীতি প্রদর্শনের জন্য হাতুড়ি বের করেছিলেন। যে কারণে অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করা হয়। পরে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাহমুদুল হাসান ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে তাকে দুই মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড ও ৫০০ টাকা জরিমানার আদেশ দেন। তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
চৌগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুস্মিতা সাহা বলেন, সাধারণ ভোটারদের ভয়ভীতি দেখানোর কারণে আব্দুল মজিদকে সাজা দেয়া হয়েছে।