বাংলার ভোর প্রতিবেদক
রাজধানীর শাপলা চত্বরে ২০১৩ সালের ৫ মে নারকীয় গণহত্যা চালায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার। সেই রাতে আলেম-উলামা, মাদরাসাছাত্রসহ নিরস্ত্র যেসব মানুষকে হত্যা করা হয়, তাদের একজন ছিলেন যশোরের হাফেজ মোয়াজ্জেমুল হক ওরফে নান্নু হুজুর। ভাল নেই শহীদ নান্নুর পরিবার। দুর্দশায় জর্জরিত পরিবারটি। আর উপার্জনক্ষম কেউ না থাকায় শহিদ নান্নুর পরিবারটি মূলত শুভাকাক্সক্ষীদের সাহায্য-সহানুভূতির ওপর টিকে আছে। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে চায় পরিবারটি। তাদের দাবি, ছেলে মেয়েদের ছোটখাটো চাকরি মিললেও নিতে হত না অন্যের সহানুভূতি।
শাপলা চত্বরের ঘটনায় নিহত নান্নুর সন্তানদের অভিযোগ, আমার বাবাকে ওরা মেরে ফেলে আমাদের শান্তিতে থাকতে দেয়নি। ১২ বছরে তাদের নানাভাবে নির্যাতন করেছে। এলাকায় প্রচার করেছিল, পরিবারটি রাষ্ট্রদ্রোহী। সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে গুলি খেয়ে মারা গেছে নান্নু। তাদের সাথে তোমরা কেউ মিশবেনা। এমনকি তার সন্তানদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার সময় নানানভাবে হেনস্তা করা হয়েছে। বন্ধ হয়ে যায় বড় সন্তান হুজাইফার লেখাপড়া। তাদের এই দুর্দশার জন্য শেখ হাসিনার নিপীড়নমূলক শাসনই দায়ি। এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চান তারা।
ভুক্তভোগী নান্নু যশোরের সদর উপজেলার খড়কি মোল্লাবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা। তিনি মৃত্যুর সময় তিন মেয়ে ও দুই ছেলেকে রেখে যান। যা তার স্ত্রী শাহনাজ বেগমের জন্য বড় বোঝা হয়ে যায়। এরপরও জীবন সংগ্রামে থেমে থাকেননি সেই নারী। স্বামীর কাছ থেকে অর্জিত দর্জি কাজ শুরু করেন। বাড়ির একটি কক্ষে বসে সেলাই মেশিন চালিয়ে সংসার চালান তিনি। তবে এখন আর তার শরীর চলে না। ফলে থেমে গেছে মেশিনের চাকা। পরিবারটি মূলত শুভাকাক্সক্ষীদের সাহায্য-সহানুভূতির ওপর টিকে আছে।
স্ত্রী শাহনাজ বেগম বলেন, ১২ সালে নান্নু যখন আমাকে ছেড়ে পরপারে চলে যান তখন বড় ছেলে আবু হুযাইফার বয়স ছিল ৯ বছর আর ছোট ছেলে আবু হানঝালার বয়স ছিল ৪ বছর। স্বামীর মৃত্যুর পর বন্ধ হয়ে যায় বড় ছেলের লেখাপড়া। ছেলেকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করতে চেয়েছিল নান্নু। তা পূর্ণ হয়নি। ছেলে টা এখন একটি কাপড়ের দোকানে কাজ করছে। আর ছোট ছেলেটি আল-হেলাল ট্রাস্টে থেকে লেখাপড়া করছে । আগামী বছর দাখিল পরীক্ষা দিবে। তাদের ভবিষ্যত নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন।
নান্নুর পরিবার জানিয়েছে, তার মৃত্যুর পর কয়েক দফা হেফাজতে ইসলামের লোকজন সরাসরি গিয়ে বিভিন্ন জিনিসপত্র কিনে দিয়ে আসেন। ছেলে মেয়েদের জন্য কাপড়, সেমাই, চিনি কিনে দেন তারা। তবে এখন আর কোনো নেতা সাহায্যকারীকে খুঁজে পান না পরিবারটি। ফলে নিদারুণ অভাব-অনটন নিয়ে প্রতিদিন কাটে। তার পরিবারের এমনও দিন গেছে, অনাহারে-অর্ধাহারে ছিলেন তারা। কথিত আপনজনরাও তাদের খোঁজ নেয়নি।
নান্নুর স্ত্রী শাহনাজ বেগম কিডনি, লিভার, ডায়াবেটিসসহ আরো নানা রোগে আক্রান্ত । তার বড় মেয়ে উম্মে হাবিবা ক্যানসারের রোগী। দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ায় স্বামী তাকে ডিভোর্স দিয়েছেন। সন্তানসহ মায়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন এই অসহায় নারী। ছোট মেয়ে উম্মে সাদিয়ারও সম্প্রতি ডিভোর্স হয়ে গেছে। তিনিও এক সন্তানসহ মায়ের কাছে এসে উঠেছেন। ঢাকায় স্বামীর সংসারে মেজো মেয়ে উম্মে সুমাইয়া ও বড় ছেলে আবু হুজাইফা রাজধানীর একটি কাপড়ের দোকানের কর্মচারী। অভাবের কারণে লেখাপড়া শেষ করতে পারেননি হুজাইফা। বাবার মৃত্যুর পর ছোট ছেলে কিশোর আবু হানজালারও স্ট্রোক হয়েছে। বলতে গেলে পরিবারটির যশোরে থাকা প্রায় সবাই অসুস্থ। সংসারের খরচ জোগাতে না পারায় ঠিকমতো চিকিৎসাও হচ্ছে না।
নান্নুর পরিবারের দাবি, যে বাড়িতে পরিবারটি বসবাস করে, সেটি পুরো নিজের আয়ত্তে নিতে চান নান্নুর ভাইয়ের ছেলে মারুফ সিদ্দিকী। দুই পরিবারের সমঝোতার ভিত্তিতে তিনি শহরতলীর আরবপুর ইউনিয়নে এক খণ্ড জমিও কেনেন। কিন্তু সেই জমির অর্ধাংশ নিজের নামে রেজিস্ট্রি করে নেন মারুফ। এখানেই শেষ নয়। আরবপুর ইউপি চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা শাহারুল ইসলামের কারণে সেই জমির দখলও নিতে পারেনি পরিবারটি। মারুফ তার চাচা নান্নুর পরিবারের দুর্দশার কথা স্বীকার করেন।
শাহানাজ বেগম বলেন, এভাবে কতদিন চলা যায়। ছোট মেয়েটি ফাজিল পাস। ছেলে মেয়েদের একটি চাকরি হলে সবাই অভাব আর দয়া হতে রক্ষা পেতাম।
মোয়াজ্জেমুল হক নান্নু (৪৮) যশোর সদরের খড়কি ওয়াপদা মসজিদের সানি ইমাম হিসেবে চাকরি করতেন।
২০১৩ সালের ৪ মে সকালে যশোর থেকে রওনা হয়ে রাতে ঢাকায় ঢোকেন। এর পরদিন ৫ মে বিকেলে গাবতলী থেকে পায়ে হেটে রওনা হন মতিঝিল শাপলা চত্বরের সমাবেশস্থলে। সেখানে পৌঁছাতে বিকেল হয়ে যায়। সেই সময়ে বায়তুল মোকাররম মসজিদের আসরের নামাজের জন্য হেটে আসছিলেন তিনি । মসজিদে ঢোকার জন্য রাস্তায় অপেক্ষা করছিলেন। এরই ফাঁকে কালো পোশাকধারী এক ব্যক্তি এসে তাকে পেছন দিক থেকে আঘাত করে মাটিতে ফেলে দেন। এ সময় নান্নু প্রাণে বাঁচতে তার পা ধরে হাত করজোড় করেন। কিন্তু সই ব্যক্তি তার ডান পা লাঠি দিয়ে পিটিয়ে ভেঙ্গে দেন। পরে তার বুকে রাইফেল ঠেকিয়ে ছররা গুলি করেন। সেই গুলি বিধে ঢুকে যায় নান্নুর কলিজা ও হৃদপিণ্ড পর্যন্ত। যার সংখ্যা ছিল প্রায় হাজার খানেক। ফলে তাকে আর বাঁচানো যায়নি।