সভাপতির বারবার বির্তকিত কর্মকান্ডে আমরা বিব্রত হচ্ছি। দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছেন তিনি’
-মোহিত কুমার নাথ, সদর উপজেলা আ’লীগের সভাপতি
হাসান আদিত্য
বিতর্ক যেন পিছু ছাড়ছে না যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলনের। একের পর এক অভিযোগে বিব্রত দলের নেতাকর্মীরাও। বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে নিজেকে জড়িয়ে তিনি বারবার সমালোচনার পাত্রে পরিণত হচ্ছেন। দেড় দশকের বেশি সময় ধরে সভাপতির দায়িত্বপালনকালে তার বিরুদ্ধে জমি দখলের উদ্দেশ্যে বাড়ি এক্সকাভেটর দিয়ে গুড়িয়ে দেওয়া, পুলিশ ফাঁড়ির মধ্যে পিপিকে পেটানো, যুবককে মারধর করে উল্টো জেলে পাঠানো, শটগান দিয়ে পিটিয়ে আহত করা, বিএডিসির বীজ প্রসেসিং গোডাউনের প্রাচীর ভেঙে পুকুর ভরাট, টেণ্ডারবাজি করতে গিয়ে নিজ দলের নেতাকর্মীদের হাতে লাঞ্ছিত হওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার শহিদ পরিবারের সন্তানের বসতঘর ভেঙে কোটি টাকার সম্পদ লুটপাটের অভিযোগ উঠাতে আবারও জেলাতে আলোচনা এসেছেন শহিদুল ইসলাম মিলন। দলের নেতারাই তার এই কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করছেন। তারা বলছেন, এতে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছেন শীর্ষ এই আওয়ামী লীগনেতা। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা সভাপতির এমন আচরণকে দেখছেন ‘ক্ষমতার দাপট’ হিসেবে। যদিও সভাপতি অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, বারবার নীতিবাচক সংবাদের শিরোনাম হলেও অভিযোগগুলো ছিলো রাজনীতিক ও উদ্দেশ্যমূলক।
জানা গেছে, ২০১৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনে বিগত কমিটির সহসভাপতি থেকে প্রথমবারের মতো সভাপতি নির্বাচিত হন শহিদুল ইসলাম মিলন। এর পরে ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত সম্মেলনে দ্বিতীয়বারের পুনরায় সভাপতি মনোনীত করা হয়। যা বর্তমানে সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। দলীয় নেতাকর্মী ও ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, দলীয় সভাপতির পদ পাওয়ার পর থেকে শহিদুল ইসলাম মিলন বারবার বিতর্কের সৃষ্টি করেছেন। মিলনের ছত্রছায়াতে অনেক সন্ত্রাসী বির্তকিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে নির্যাতিত হয়েছেন সাধারণ মানুষ। যা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহিত কুমার নাথ বলেন, ‘জেলার সভাপতির বারবার বির্তকিত কর্মকান্ডে আমরা বিব্রত হচ্ছি। দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছেন তিনি। সাধারণ মানুষ ও তৃণমূল নেতাকর্মীদের কাছে আমরা প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছি। দলের সিনিয়র নেতা হয়ে এমন কর্মকান্ডে বিব্রত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও।’
জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মুক্তিযোদ্ধা একেএম খয়রাত হোসেন বলেন, ‘দলের সভাপতির এমন কর্মকান্ডে নতুন প্রজন্মের রাজনীতি কর্মীরা কি শিখবে। সভাপতির এমন কর্মকান্ডে আমরা বিব্রতবোধ করছি। কষ্ট পাচ্ছি। লজ্জা পাচ্ছি।’
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) যশোরের সভাপতি অধ্যক্ষ শাহীন ইকবাল বলেন, ‘শহিদুল ইসলাম মিলনের বিরুদ্ধে বাড়ি ভাংচুরসহ সম্প্রতি কিছু ঘটনা ঘটেছে। এটা দুঃখজনক। ক্ষমতাসীন দলের জেলার সভাপতির কাছে আমাদের এটা কাম্য নয়। ক্ষমতার দাপটে এমনটি করেছেন তিনি। তিনি যদি কোন ঘটনার ভুক্তভোগী হন তাহলে আইন হাতে তুলে না নিয়ে প্রশাসনের দারস্থ হতে পারতেন। তার অনেক দায়িত্ববান হওয়া উচিত।’
বারবার আলোচনায় শহিদুল ইসলাম মিলন
বৃহস্পতিবার (২৭ জুন) দুপুরে জমি দখলের উদ্দেশ্যে যশোরে শহিদ পরিবারের বাড়ি এক্সেভেটর দিয়ে গুড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলনের বিরুদ্ধে। দুই শতাধিক সন্ত্রাসী নিয়ে সদর উপজেলার হামিদপুর পশ্চিমপাড়ায়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ দেয়া শহীদ উদ্দিন আহমেদের ছেলে আসাদুজ্জামানের বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেয় তারা। এ সময় সন্ত্রাসীরা সেখানে লুটপাট চালায় বলেও দাবি করেন ভুক্তভোগী পরিবার। এ ঘটনায় তারা থানায় লিখিত অভিযোগ করেছেন। ঘটনার একদিন পার হলেও অভিযোগটি পুলিশ মামলা হিসাবে নেয় বলে জানিয়েছে ভুক্তভোগীরা। তবে কোতয়ালী মডেল থানার ওসি আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, ‘খবর শুনে ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠিয়েছিলাম। তারা কাউকেই পায়নি। এই ঘটনায় ভুক্তভোগীরা লিখিত অভিযোগ দিয়েছে। তদন্ত চলছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তদন্ত চলছে, তদন্ত করেই মামলা হিসাবে রুজু করা হবে।’
বাড়ির মালিক আসাদুজ্জামান বলেন, ‘শহিদুল ইসলাম মিলন আমার বাল্যবন্ধু। সম্প্রতি এই জায়গার সাবেক মালিক নুরুল ইসলাম তার বেয়াই হয়েছেন। নুরুল ইসলামের এই জায়গা শিল্প ব্যাংকে মর্টগেজ ছিল। ১৯৯২ সালে ব্যাংকের নিলামের মাধ্যমে আমরা এই জমিটি ক্রয় করি। সেই থেকে এই জমি ঘরবাড়ি ভোগদখল করে আসছি। গতবছর শহিদুল ইসলাম মিলন এই জমি দখলের জন্য তার সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে আসে। তাদের মারপিটে আমার সন্তান আহত হয়। এবার গ্রামবাসীর ধাওয়ায় সন্ত্রাসীসহ তিনি পালিয়ে যান।’
গত ১০ জন ফুটপাতে হকার বসানো নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট মোস্তাফিজুর রহমান মুকুলকে মারধরের অভিযোগ উঠে মিলনের বিরুদ্ধে। শহরের কসবা পুলিশ ফাঁড়ির মধ্যে ঘটনাটি ঘটে। পুলিশ ফাঁড়ির মধ্যে জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতার প্রকাশ্যে পাবলিক প্রসিকিউটরকে মারধরের ঘটনায় সমালোচনার ঝড় উঠে। আওয়ামী লীগের একটি পক্ষ ছাড়াও বিভিন্ন অঙ্গনের মানুষেরা বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করে সমালোচনা করেন। মারধরের প্রতিবাদে ঘটনার পরের দিন বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেন জেলা আইনজীবী সমিতি। ঘটনার একদিন পর সভাপতি মিলনসহ দুইজনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন ভুক্তভোগী আইনজীবী। সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক গোলাম কিবরিয়া মামলাটি এজাহার হিসেবে গ্রহণের জন্য কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) নির্দেশ দেন। মামলাটি তদন্তধীন রয়েছেন বলে জানিয়েছেন কোতয়ালী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুর রাজ্জাক। ভুক্তভুগী আইনজীবী মোস্তাফিজুর রহমান (মুকুল) শুক্রবার বিকালে বলেন, ‘মামলাটি তদন্ত চলছে। কোন অগ্রগতি নেই। আমি এখন অসুস্থ। তাই বিষয়টি নিয়ে ভাবতে পারছি না।’
২০২৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি শহিদুল ইসলাম মিলনের নেতৃত্বে তার শটগান দিয়ে শহরতলী বাহাদুরপুর পিতা পুত্রকে পিটিয়ে আহত করে। জমি নিয়ে বিরোধের জেরে এই ঘটনা ঘটে। হামলায় আহতরা হলেন- সদর উপজেলার হামিদপুর গ্রামের বাসিন্দা এবিএম জাফরী (৩৮) ও তার পিতা আসাদুজ্জামান (৬৫)। পরদিন ২৮ ফেব্রুয়ারি দুপুরে এ ঘটনা নিয়ে প্রেসক্লাব যশোর মিলনায়তনে পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
২০২২ সালের ২১ এপ্রিল মিলনের নেতৃত্বে শহরের ষষ্টিতলা এলাকায় একটি বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও এক যুবককে বেধড়ক মারপিটের অভিযোগ। এর পর যুবককে মারধর করে উল্টো জেলে পাঠান তিনি। শোভন যশোর শহরের ষষ্টিতলা এলাকার রবিউল ইসলামের ছেলে। ২০১৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর যশোর গণপূর্ত বিভাগ ও বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সভাপতি মিলনসহ কয়েক ঠিকাদারের যৌথ লাইসেন্সে কাজের টেন্ডার দাখিল করতে যেয়ে টেন্ডারবাজদের হাতে লাঞ্ছিত হন তিনি। দুর্বৃত্তরা তার গায়ের পাঞ্জাবি ছিঁড়ে ফেলে।
এছাড়া শেখহাটিতে বিএডিসির বীজ প্রসেসিং গোডাউনের প্রাচীর ভেঙে একটি পুকুর ভরাটের কাজ করার অভিযোগ উঠে সভাপতি মিলনের বিরুদ্ধে। শেখ হাসিনা সফটওয়্যার আইটি পার্ক থেকে মাটি উত্তোলন করে। এ বিষয়ে বিএডিসি যশোর বীজ প্রসেসিংয়ের উপ-পরিচালক তিমা পাল সাংবাদিকদের বলেন- ‘ আমি সভাপতিকে বলেছিলাম গোডাউনের প্রাচীর ভেঙে ট্রাক ঢুকালে কথা উঠবে। তিনি বলেছেন-ওসব আমি দেখবো। এনিয়ে বিএডিসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে যেমন ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি পুকুর ভরাট করে প্লট বিক্রির যে পরিকল্পনা মিলন বাস্তবায়ন করছেন তা নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয়রা।’
এই বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলন বলেন, ‘বিভিন্ন সময়ে আমার নামে যেসব অভিযোগ উঠেছে সে সব রাজনীতির উদ্দেশ্যমূলক। ওসব অভিযোগের ভিত্তি নেই। দীর্ঘদিন রাজনীতি করি। প্রতিপক্ষরা গায়ে রাজনীতির নোংরা রঙ লাঙানোর টেষ্টা করছে। আপনারা বিষয়গুলো তদন্ত করলে সঠিক ঘটনা জানতে পারবেন।’