বাঘারপাড়া সংবাদদাতা
বাঘারপাড়া উপজেলার দোহাকুলা ইউনিয়নের খলশী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নতুন ভবনের নির্মাণ কাজে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। কাজের এস্টিমেট অনুযায়ি রড কম দেয়া, নিম্নমানের ইট, বালি ব্যবহার, সিমেন্ট কম দেয়া, ঢালাই কাজে রডের পরিবর্তে বাঁশের চটা দেয়ার মত গুরুতর অভিযোগে স্থানীয়রা কাজে বাধা দেয়।
জানা গেছে, নির্মাণ কাজে বাঁশের চটা দিয়ে কাজ চলাকালীন এলাকাবাসী হাতেনাতে ধরে উপজেলা প্রশাসনকে অবহিত করেন। অভিযোগের ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার সকালে উপজেলা নির্বাহী অফিসার শোভন সরকার ও উপজেলা প্রকৌশলী আবু সুফিয়ান ঘটনাস্থল খলশী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যলয়ে কাজের তদারকিতে যান এবং ঘটনার সত্যতা পান। সে সময় তারা তাৎক্ষণিকভাবে কাজটি বন্ধ করে দেন এবং উর্ধতন কতৃপক্ষকে বিষয়টি অবহিত করেন।
বাঘারপাড়া উপজেলা প্রকৌশলী অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের প্রথম দিকে “চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচী (পিইডিপি-৪)” এর আওতায় খলশী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অতিরিক্ত শ্রেণী কক্ষের জন্য তিন তলা নতুন ভবনের টেণ্ডার আহবান করা হয়। ওটিএম পদ্বতিতে টেণ্ডারে অংশগ্রহণ করেন বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। যশোর শহরের রেল রোডস্থ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এমএস বিশ্বজিত কন্সট্রাকশনের নামে টেন্ডার ড্রপ করেন বাঘারপাড়ার শামসুর রহমান নামের এক ঠিকাদার। তিনি প্রায় ২০ ভাগ কমে ৯৪ লাখ ৯১ হাজার টাকা দর দিয়ে বিজয়ী হন। এর পর কাজটি শামসুর রহমানের কাছ থেকে ছয় লাখ টাকায় কিনে নেন আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা সোলাইমান হোসেনের বড় ছেলে ইকবাল হোসেন নয়ন। নয়ন তার পার্টনার ইমরানকে নিয়ে যৌথভাবে বিদ্যালয়ের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। নির্মাণ কাজের শুরু থেকেই অনিয়ম ও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তিন তলা ভবনের কাঠামো নির্মাণ করেন। এরপর উইন্ডো সিলের ঢালাইয়ের সময় তাতে রডের পরিবর্তে বাঁশ ব্যবহারের বিষয়টি গ্রামবাসীর নজরে আসে। বাঁশ ব্যবহারের ছবি ও ভিডিও ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। উপজেলা প্রকৌশলী এ ঘটনা শুনে তাৎক্ষণিকভাবে পরিদর্শনে যান ও কাজ বন্ধের নির্দেশ দেন। এরপর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এমএস বিশ্বজিৎ কন্সট্রাকশনের নামে গত ১৭ এপ্রিল কারণ দর্শানোর নোটিশ করেন উপজেলা প্রকৌশলী। গত ২১ এপ্রিল নির্মাণ কাজের মিস্ত্রি জাহাঙ্গীরের উপর দোষ চাপিয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কারণ দর্শানোর জবাব দেয়।
এলাকাবাসীর অভিযোগে বৃহস্পতিবার সকালে বাঘারপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার শোভন সরকার ও উপজেলা প্রকৌশলী আবু সুফিয়ান খলশী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উপস্থিত হন। এ দুই কর্মকর্তার উপস্থিতিতে উইন্ডো সিলের ঢালাই ভাঙ্গা হয়। সেখানে দেখা যায় যে পরিমাণে রড দেয়ার কথা তার তিন ভাগের এক ভাগও দেয়া হয়নি। ঢালাইয়ে সিমেন্টের ব্যবহার হয়েছে আনুপাতিকহারের চেয়েও অনেক কম। এ সময় নির্মাণ কাজের মান নিয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার অসন্তোষ প্রকাশ করেন। এবং উপস্থিত গ্রামবাসীর অভিযোগ শোনেন। তাৎক্ষণিকভাবে নির্বাহী অফিসার ও নির্বাহী প্রকৌশলী জেলা প্রকৌশলীসহ উর্ধতন কতৃপক্ষকে বিষয়টি অবহিত করেন। একই সাথে গ্রামবাসিকে আশস্ত করেন, নির্মাণ কাজের যেখানে ক্রটি আছে তা সঠিকভাবে না করা পর্যন্ত ঠিকাদারকে বিল দেয়া হবে না ও আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
উপস্থিত জনতা সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন, নির্মান কাজে ব্যবহৃত ইট, বালির মান খুই খারাপ। কলাম ও ছাদে যে মাপের রড দেয়ার কথা তা দেয়া হয়নি। কলামে ১৬মিলি রডের বদলে ১২ মিলি, ছাদে ১২মিলির বদলে দেয়া হয়েছে ১০মিলি রড। নির্মাণ কাজের কোন ক্ষেত্রেই সিমেন্টের অনুপাত ঠিক রাখা হয়নি। ইটের গাঁথুনি ও ঢালাইয়ে দেয়া হয়নি পানি। এর ফলে সামান্য আঘাতেই তা ভেঙ্গে যাচ্ছে।
এম এস বিশ্বজিত কন্সট্রাকশনের সত্বাধিকারি বিশ্বজিৎ বিশ্বাস জানিয়েছেন, কাজটি তার লাইসেন্সে শামসুর রহমান নিয়েছিলেন। আমি এতকাল জানতাম খলশী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাজ শামসুই করছে। সপ্তাহখানেক আগে জানতে পারি কাজটি করছে নয়ন নামের একজন ঠিকাদার। কাজের অনিয়মের বিষয়টি আমাকে জেলা ও উপজেলা অফিস জানিয়েছে। নিয়ম অনুযায়ি আমার দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। সে কারণে আমি নিজেও কাজটি দেখভাল করছি। আর যাতে অনিয়ম না হয়।
উপজেলা প্রকেশৈলী আবু সুফিয়ান জানিয়েছেন, মোট টাকার মধ্যে ঠিকাদারকে ৪০ লাখ টাকা বিল দেয়া হয়েছে। কাজের যে যে জায়গায় ত্রুটি ধরা পড়েছে তা মার্কিং করে দেয়া হয়েছে। আরো উন্নত পরীক্ষার জন্য ল্যাব কতৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। পরবর্তি নির্দেশ মোতাবেক সেগুলো ভেঙ্গে সঠিকভাবে কাজ না করলে আর কোন বিল দেয়া হবে না। প্রয়োজনে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বাঘারপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার শোভন সরকার জানিয়েছেন, সব কিছুই স্বচোখে দেখেছি। নির্মাণ কাজে কিছু অনিয়ম আছে। বিষয়টি নির্বাহী প্রকৌশলীকে জানানো হয়েছে। তিনি সব কিছুই ল্যাব টেস্টের জন্য সরেজমিনে আসতে চেয়েছেন। আশা করি আগামী সপ্তাহে তিনি আসবেন। একই সাথে তিনি খুঁজে বের করবেন নির্মাণ কাজের কোথায় কোন ত্রুটি হয়েছে। সেই সাথে আপাতত কাজটি বন্ধের নির্দেশও দিয়েছি।
শামসুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, যেহেতু কাজটি আমার নিজ গ্রামের তাই কাজের মান যাতে ভালো হয় সেজন্য আমি কাজটি নিযয়েছিলাম। পরে স্থানীয় রাজনৈতিক চাপে আমি কাজটি নয়ন ও ইমরানকে দিতে বাধ্য হই এবং বিশ্বজিৎ দাদা এই কাজ হস্তান্তর বাবদ ৫০ হাজার টাকা নগদ গ্রহণ করেন।
রাজমিস্ত্রি জাহাঙ্গীরের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, কাজের জন্য রড চাইলে ঠিকাদার আমাকে এক দেড় ফুটের টুকরো টুকরো রড দেন যা পরিমাণে সামান্য এবং ওই রড দিয়েই কাজ শেষ করে আসতে চাপ দেন। প্রয়োজনে বাঁশের চটা ব্যবহার করতে বলেন। আমি অপারগতা প্রকাশ করলে আমাকে পাওনা টাকা না দেয়ার ভয় দেখান।