হাসান আদিত্য
যশোরে সদরের বাহাদুরপুর এলাকার তেঁতুলতলা মোড়ে মধ্যরাতে যুবলীগ কর্মী আলী হোসনকে হত্যায় অংশ নেয় দুই দুর্বৃত্ত। ৪০ সেকেন্ডের কিলিং মিশনে ৬ রাউন্ড গুলি করা হয়। প্রথম গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় দৌঁড়ে পালানোর চেষ্টা করে। এ সময় তার পায়ে গুলি করা হয়। পড়ে গেলে মাথায় এক রাউন্ড ও পিঠে তিন রাউন্ড গুলি করা হয়। ঘটনাস্থলে উপস্থিত প্রত্যক্ষদর্শী যুবলীগ কর্মীর সহযোগী ও তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এই তথ্য পাওয়া গেছে।
সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিজয়ী চেয়ারম্যান তৌহিদ চাকলাদারের কর্মী ছিলেন আলী হোসেন। তাঁর বিজয় উপলক্ষে বৃহস্পতিবার রাতে উপশহর ই-ব্লক এলাকায় প্রীতিভোজের আয়োজন করা হয়। সেখানে খাওয়া শেষে মধ্যরাতে এক সহযোগীকে নিয়ে মোটরসাইকেলে বাড়ি ফিরছিলেন আলী হোসেন (৩০)। পথিমধ্যে বাহাদুরপুর তেঁতুলতলা মোড় এলাকায় পৌঁছালে আরেক মোটরসাইকেলে দুই আরোহী তাদের পিছু নেয়। একপর্যায়ে আলী হোসেনকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে আলী হোসেন ও তার সহযোগী দৌঁড়ে পালানোর চেষ্টা করে। এ সময় আলীর পায়ে গুলি করা হয়। পড়ে গেলে কাছে গিয়ে মাথা ও পিঠে আরও চার রাউন্ড গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করে পালিয়ে যায় ঘাতকরা।
আলী হোসেন সদর উপজেলার বাহাদুরপুর পশ্চিম পাড়া এলাকার আব্দুর রহমানের ছেলে। আলী হোসেন যুবলীগের কোন পদে না থাকলেও যুবলীগ নেতা ও যশোর পৌরসভার কাউন্সিলর আলমগীর কবির সুমনের সঙ্গে রাজনীতি করতেন। এই ঘটনার দুই দিন অতিবাহিত হলেও (শনিবার) বিকেল পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। কাউকে আটকও করতে পারেনি পুলিশ। নিহত আলী হোসেনের বিরুদ্ধে চাঁচড়ার আলোচিত সন্ত্রাসী ইমরোজ হত্যাসহ মাদক, মারামারি ও দ্রুত বিচার আইনে চারটি মামলা রয়েছে।
শনিবার দুপুরে বাহাদুরপুর এলাকায় আলী হোসেনের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, এখনো স্বজনের ভিড়। দূরদূরান্ত থেকে স্বজন এলাকাবাসী তাদের বাড়িতে এসে শোকাহত পরিবারকে সমবেদনা জানাচ্ছেন। বাড়ির ভিতরে অবস্থান করছিলেন নিহত আলী হোসেনের দীর্ঘদিনের সহযোগী সোহান হোসেন শেখ। তিনি বলেন, ‘আমরা উপজেলা নির্বাচনে মোটরসাইকেলের কর্মী ছিলাম। বিজয়ী হওয়ার পর ৬ জুন উপশহর ই ব্লকে পিকনিকের আয়োজন করা হয়। ওখান থেকে খাওয়া দাওয়া করে আলী হোসেন ও আমি মোটরসাইকেলে বাড়ি ফিরছিলাম। আলী বাইক চালাচ্ছিলো, আমি পিছনে বসে ছিলাম। বাড়িতে ফেরার পথে লক্ষ্য করি, এক বাইকে দুজন আমাদের ফলো করছে। রাত সাড়ে ১২ টার দিকে বাড়ির সামনে মোড়ে পৌঁছাতেই পিছন থেকে ওই বাইক থেকে নামেন কিসমত নওয়াপাড়া গ্রামের নবাব আলী। সে প্রথমে গুলি ছুঁড়তেই আমরা পালাতে শুরু করি।
প্রথমটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। পরে দুইজন দৌঁড়াতে শুরু করি। আবার গুলি ছুঁড়লে এবার আলী হোসেনের পায়ে লাগলে পড়ে যান। এর পর নবাব কাছে এসে প্রথমে মাথায় একটি, পরে পিঠে তিনটি গুলি বিদ্ধ করে। এরপর পালিয়ে যায় নবাব ও তার সহযোগী। পুরো কিলিং মিশনে তারা সময় নিয়েছে ৪০ থেকে ৬০ সেকেন্ড। এ সময় আমি চিৎকার করলে স্থানীয়রা এগিয়ে আসে। উদ্ধার করে হাসপাতালে নিলে আলী হোসেনকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।
সোহান হোসেন শেখ অভিযোগ করেন, নবাব ও আলী হোসেনের মধ্যে এলাকায় মাটি ও বালি ভরাট বিক্রি নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিলো। এর মধ্যে আলী হোসেন মোটরসাইকেল প্রতীকে ও নবাব ঘোড়া প্রতীকে নির্বাচন করে। নির্বাচন ও পূর্বের ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব নিয়ে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।’
আলী হোসেনের বৃদ্ধ পিতা আব্দুর রহমান বলেন, ‘আমার দুই মেয়ে ও এক ছেলে। দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছে আলী। বাড়ির একমাত্র উপর্জনক্ষম ব্যক্তি মারা যাওয়ায় আমাদের বিরাট ক্ষতি হয়ে গেল। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আলীর কোন ছেলে মেয়ে নেই। ৮ মাস হয়েছে বিয়ে করেছে। এলাকায় ব্যবসা ও সালিশ বিচার নিয়ে কারো কারো সাথে দ্বন্দ্ব থাকতে পারে। কিছুদিন আগে নবাব ও তার সহযোগী সিরাজ, টুকুনের সঙ্গে কথাকাটাকাঠি হয়। সেই দ্বন্দ্বের জেরে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
আলীর স্ত্রী লুপা খানম বলেন, ‘অল্প বয়সে আমারে যারা বিধবা করেছে, তাদের বিচার চাই। আমার স্বামী হত্যার বিচার চাই। এই হত্যায় আমাদের পরিবারডা পঙ্গু হয়ে গেল।’
প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় লোকজনের বরাত দিয়ে যশোর ডিবি পুলিশের উপপরিদর্শক মফিজুল ইসলাম বলেন, ‘মোট ছয়টি গুলি করা হয় আলীকে উদ্দেশ্য করে। এর মধ্যে পাঁচটি বিদ্ধ হয়। আর একটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে। আপাতত এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত দুইজনকে খুঁজছি। কাউকে আটক করা যায়নি। এর পিছনে কেউ আছে কিনা বা মাস্টার মাইন্ডকে খুঁজছি আমরা।’
কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক বলেন, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে আলী হোসেনের বিরোধ ছিল। সেই বিরোধের জেরে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় শনিবার বিকেল পর্যন্ত মামলা হয়নি। তবে মামলা প্রক্রিয়াধীন। নিহত আলী হোসেনের বিরুদ্ধে হত্যা, মাদক, মারামারি ও দ্রুত বিচার আইনে চারটি মামলা রয়েছে।
এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে নির্বাচনের কোন সম্পর্ক নেই দাবি করেছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার। তিনি বলেন, ‘যশোরে নির্বাচনকালীন যিনি নিহত হয়েছেন ঘটনাটি দুঃজনক। এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা। তারা আমাদের দলের কেউ না। এসব ঘটনার সঙ্গে নির্বাচনের কোন সম্পর্ক নেই।