হাসান আদিত্য

যশোর সদর উপজেলা পরিষদের ভোটগ্রহণ আজ। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনের মাধ্যমে এই নির্বাচনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনে চেয়ারম্যানের চেয়ারে কে বসতে যাচ্ছেন; শহর-গ্রামে সেই বিশ্লেষণ এখন তুঙ্গে। নেতারা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোটে এগিয়ে রাখলেও সাধারণ ভোটার ও রাজনীতি সচেতনরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের কারও ভাষ্য, নির্বাচনে যশোর আওয়ামী লীগের যে দুই বলয়; শাহীন-নাবিলের সমর্থিত প্রার্থীকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে যুব মহিলা লীগের বহিস্কৃত নেত্রী ফাতেমা আনোয়ার। প্রচার-প্রচারণাকালে বহিস্কারের পর থেকে ফাতেমার দৃশ্যত ভোট বেড়েছে। আওয়ামী লীগের ভোটের সঙ্গে বিএনপির একটি অংশ তাকে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে সমর্থন দিয়ে ভোট করছেন। ফলে শাহীন-নাবিলের হেভিওয়েট দুই প্রার্থীকে তলিয়ে দিতে পারেন ফাতেমার ঘোড়া প্রতীক, এমনটাই বলছেন সাধারণ ভোটাররা।

তবে করোনাযোদ্ধা হিসেবে পরিচিত সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শফিকুল ইসলাম জুয়েলের পক্ষে দলীয় কোন পরিস্কার পক্ষ না থাকলেও সাধারণ ভোটারসহ নাবিল-শাহীন বিরোধী পক্ষ এবং নিরপেক্ষ একটি বড় অংশের ভোট কাপ পিরিচে যাবে বলেও সাধারণ ভোটারদের অনেকেই মনে করছেন।

সদরে তিনটি পদের বিপরীতে লড়ছেন ১৬ প্রার্থী। এবার দলীয় প্রতীক না থাকায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবেই লড়ছেন তারা। নিজ দলেই মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ভোট যুদ্ধে নেমেছেন ৮জন। এর মধ্যে স্থানীয় সংসদ কাজী নাবিল আহমেদের সমর্থন নিয়ে প্রার্থী হয়েছেন দোয়াত কলম প্রতীকের আনোয়ার হোসেন বিপুল। আর জেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক শাহীন চাকলাদারের সমর্থন নিয়ে মোটরসাইকেল প্রতীকে ভোট করছেন তারই চাচাতো ভাই তৌহিদ চাকলাদার ফন্টু। কাপ পিরিচ প্রতীক নিয়ে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছেন শফিকুল ইসলাম জুয়েল। জেলা যুবলীগের সভাপতি ও বর্তমান চেয়ারম্যান মোস্তফা ফরিদ আহমেদ চৌধুরী ভোট করছেন আনারস প্রতীক নিয়ে। শালিক প্রতীকে ভোট করছেন যশোর সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহিত কুমার নাথ এবং জোড়া ফুল প্রতীকে সমর্থন পেতে ছুটছেন সাধারণ সম্পাদক শাহারুল ইসলাম। এছাড়া ঘোড়া প্রতীক নিয়ে নিরলস ছুটছেন একমাত্র নারী চেয়ারম্যান প্রার্থী ফাতেমা আনোয়ার। আর ভোটের মাঠে নামমাত্র আছেন হেলিকপ্টার প্রতীকের আরিফুল ইসলাম হীরা।

ভোটার ও নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সদর উপজেলা পরিষদের নির্বাচন কেন্দ্র করে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার ও সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদ আবারও মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়েছেন। এই নির্বাচনে তাঁরা দুজন চেয়ারম্যান পদে পছন্দের প্রার্থীকে সমর্থন দিয়েছেন। শাহীন চাকলাদারের বিরোধীপক্ষের ভাষ্য, যশোর শহরে রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার করতে শাহীন চাকলাদার তাঁর দীর্ঘদিনের অনুসারী নেতাদের প্রার্থী না করে নিজের চাচাতো ভাইকে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী করেছেন। এদিকে, কাজী নাবিল আহমেদ বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন বিপুলকে সমর্থন দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বি শাহীন চাকলাদার ও এমপি কাজী নাবিল আহমেদের ‘ঘরের মধ্যে ঘর’ তৈরি হয়েছে। এই দুই শিবির থেকে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে আট প্রার্থী মাঠে রয়েছেন। এর মধ্যে শাহীন চাকলাদার গ্রুপে তিনজন ও কাজী নাবিল আহমেদের গ্রুপে রয়েছেন চারজন। ফলে দুই শিবিরে উপ গ্রুপ তৈরি হয়েছে। বেড়ে গেছে অন্তর্দ্বন্দ্ব।

চেয়ারম্যান ৮ জন প্রার্থী হলেও মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকবেন তিন জন। কারও কারও জামানতও বাজেয়াপ্ত হতে পারে। যদিও জয়ের ব্যাপারে সব প্রার্থীই আশাবাদী। সেক্ষেত্রে ফ্যাক্টর হয়ে উঠেছেন রাজনীতিতে অনেকটা অপরিচিত মুখ ফাতেমা আনোয়ার। সদর উপজেলা যুব মহিলা লীগের সভাপতি দায়িত্বে থাকলেও প্রচার প্রচারণায় প্রধানমন্ত্রীর পরিবার নিয়ে কথা বলায় দল থেকে বহিস্কার হয়েছেন। বহিস্কারের পরেই যেন তার পাল্লা ভারি হয়েছে বলে নেতাকর্মীদের ভাষ্য। জেলা আওয়ামী লীগ, যুবলীগের অনেক নেতাকে তিনি তার ঘোড়ায় উঠিয়েছেন। এছাড়া যশোর সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে নিরবে সক্রিয় হয়েছে তৃণমূলের অনেক বিএনপি নেতাকর্মী। উপজেলা নির্বাচনের প্রথমদিকে বিএনপি নেতাকর্মীদের তেমন ভূমিকা না থাকলেও ধীরে ধীরে তাদের সংশ্লিষ্টতা বেড়েছে। যদিও দলীয়ভাবে নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়ে সাধারণ মানুষকে নির্বাচন বর্জনের আহ্বান জানিয়েছে বিএনপি। দল নির্বাচন বর্জনের পরও বেশকিছু নেতাকর্মী ফাতেমার হয়ে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে নির্বাচনে সম্পৃক্ত হয়েছে। এই নেতাকর্মীরা এলাকাভিত্তিক বিএনপি নেতাকর্মীদের নিরবে ফাতেমা আনোয়ার সক্রিয় করছে ভোট প্রদানের জন্য। এক্ষেত্রে মোটা টাকার আর্থিক লেনদেনেরও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তবে ফাতেমা আনোয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘অনেক আগে থেকেই জনগণের সঙ্গে ছিলাম, তাই নির্বাচনে ঘোড়ার গণজোয়ার বইছে।’

নির্বাচনী এলাকায় সুষ্ঠু পরিবেশ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে চেয়ারম্যান প্রার্থী মোস্তফা ফরিদ আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘যশোরের ১ নং ওয়ার্ড, ৯ নং ওয়ার্ড, বসুন্দিয়া ইউনিয়ন এবং নওয়াপাড়া ইউনিয়নের কিছু অংশে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটাদের হুমকি দিচ্ছে আরেকজন প্রার্থীর সমর্থকরা। স্থানীয় সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদ সরাসরি নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন। এমনকি তিনি কিশোর গ্যাংয়ের আশ্রয় প্রশ্রয়দাতাকে প্রার্থী হিসেবে মনোনিত করে তার পক্ষে কাজ করছেন। যা মোটেও সমীচিন নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি। এছাড়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলন ও সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার আরেক প্রার্থীর জন্য মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন ‘

জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার বলেন, ‘আমি তৌহিদ চাকলাদের পক্ষে ভোট করছি। বিভিন্ন ইউনিয়নে কর্মিসভায় যোগ দিয়েছি এটা সত্য। মূল কথা হচ্ছে, ভোটের মাঠে ভোটার উঠাতে হবে। যে প্রার্থী সেটা করতে পারবে, সেই বিজয়ী হবে। সদরের রাজনীতি দুর্বল হয়ে গেছে বলে আবার আমাকে মাঠে নামতে হচ্ছে।’

আর সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলন বলেন, ‘বিএনপি ভোটের মাঠে আসবে না। যিনি জনগণের পাশে ছিলো, জনগণ তাকেই বেঁচে নিবে।’

জেলা বিএনপির সদস্য সচিব অ্যাড. সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু বলেন, সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও বিএনপি নেতাকর্মীরা ভোট দিতে যাবে না। ইতোপূর্বে যারা নির্বাচনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভূমিকা রেখেছে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। তদন্তের মাধ্যমে নির্বাচনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িতদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

এদিকে, মঙ্গলবার সকাল থেকে কেন্দ্রে কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে ইভিএম মেশিনসহ ভোটগ্রহণ সরঞ্জাম। সদরের একটি পৌরসভা ও ১৫টি ইউনিয়নের ২১৯টি ভোট কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ হবে। মোট ভোটার ৬ লাখ ৭ হাজার ৭৪২ ভোটার। ২১৯টি ভোট কেন্দ্রে ১৭৫৬ কক্ষে ভোটগ্রহণ হবে। এতে দায়িত্ব পালন করবেন ২১৯ প্রিজাইডিং অফিসার, ১৭৫৬ সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ও ৩৫১২ পোলিং অফিসার। তৃতীয় ধাপে গেল ২৯ মে সদর উপজেলা পরিষদের ভোট গ্রহণের কথা ছিলো। কিন্তু সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহারুল ইসলামের করা মামলার কারণে সেটি স্থগিত হয়।

স্থগিত হওয়ায় ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের চতুর্থ ধাপে এই উপজেলায় ভোট গ্রহণ হচ্ছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে নির্বাচন কমিশন।

এ বিষয়ে যশোরের পুলিশ সুপার প্রলয় কুমার জোয়ারদার বলেন, ভোট কেন্দ্রে নিরিবচ্ছন্ন নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। ভোটাররা নিরাপদে কেন্দ্রে গিয়ে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবেন। নির্ভয়ে ভোট দিয়ে মানুষ বাড়ি ফিরতে পারবেন সেই ব্যবস্থা করা হয়েছে।

Share.
Leave A Reply Cancel Reply
Exit mobile version