সাতক্ষীরা প্রতিনিধি
আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশত্যাগের পর সোমবার রাত ১০টার পর থেকে পরবর্তী ১৬ ঘণ্টায় সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদ, দুইজন ইউপি চেয়ারম্যান, দুটি পত্রিকা অফিস, একজন চিকিৎসকের বাড়ি, আওয়ামীলীগ সভাপতিসহ কমপক্ষে ৫০টি বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। হামলায় নয়জন নিহত ও কমপক্ষে ১৪জন জখম হয়েছেন। আহতদের সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
সাতক্ষীরার আশাশুনি ও সদর উপজেলায় পৃথক দুটি ঘটনায় আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান জাকিরসহ ১৪ জন নিহত হয়েছে। এ ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছে আরও ১০/১২ জন। সোমবার সন্ধ্যা থেকে রাত সাড়ে ১১টার মধ্যে
সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের নাকনা এবং সদর উপজেলারবৈকারী গ্রামে পৃথক ঘটনায় হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে। গুলিবিদ্ধ আহতদেরকে
সাতক্ষীরা সদর ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
নিহতরা হলেন, আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নাকনা গ্রামের শেখ জাকির হোসেন (৫৩), একই গ্রামের শেখ শাকের (২২), শেখ জাহাঙ্গীর (৪৮), শেখ আশিক (৩৩), লস্করী খাজরা গ্রামের শাহিন আলম (২২), একই গ্রামের সজীব (২২), কুড়িকাউনিয়া গ্রামের হাফেজ আনাস বিল্লাহ (২১) ও একই ইউনিয়নের কল্যাণপুর গ্রামের আদম আলী (২৩) ও হিজলিয়া গ্রামের আলমগীর হোসেন (১৬) এবং সদর উপজেলার বৈকারী ইউনিয়নের বৈকারী গ্রামের আসাফুর রহমান (৬০), মৃগাডাঙ্গা গ্রামের তৌহিদ ইসলাম (৩০), সাইফুল ইসলাম (২৫), বিএনপির কর্মী জাহিদ হোসেন (২৮) ও ফারুক হোসেন (৩৫) নিহত।
প্রতাপনগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাজী আবু দাউদ ঢালী জানান, সোমবার কয়েকশ’ বিক্ষুদ্ধ জনতা মিছিল নিয়ে নাকনা গ্রামের জাকির চেয়াম্যানের বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় তার বাড়িতে ইট পাটকেল ছোড়ে। একপর্যায় বিক্ষুদ্ধ জনতা
জাকির চেয়ারম্যানের বাড়ির গেট ভেঙ্গে ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করলে তিনি (জাকির) বাড়ির দোতালা থেকে তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে ১০/১২ জন আহত হয়।
এ সময় ক্ষুব্ধ জনতা তার বাড়ি ঘেরাও করে রাখে। গুলিবিদ্ধ আহতদের চারজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়ার পথে হাফেজ আনাসবিল্লাহ, আদম আলী ও আলমগীর মারা যান। পরে তাদের মরদেহ গ্রামে ফিরিয়ে আনলে বিক্ষুব্ধ জনতা জাকিরের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। একপর্যায়ে রাত ৮টার দিকে বিক্ষুব্ধ জনতা জাকিরের বাড়িতে ঢুকে তাকেসহ তার সাথে থাকা শাকের, জাহাঙ্গীর, শাহিন আলম, সজীব ও আশিককে কুপিয়ে ও পিটিয়ে মেরে ফেলে।
এসময় বাড়িতে থাকা জাকিরের স্ত্রী ও মেয়েদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ তারা করে দেয়। চেয়ারম্যান আরো জানান, মঙ্গলবার সকালে নিহতদের মরদেহগুলি শনাক্ত করা হয়েছে।
একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পদত্যাগের পর দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া শেখ হাসিনার নেতাকর্মীদের উপর সোমবার রাত ১০টার পর থেকে নতুন করে হামলা চালায় আন্দোলনকারিরা। তারা সংরক্ষিত নারী সাংসদ লায়লা পারভিন সেঁজুতির বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট শেষে একটি মোটরসাইকেলসহ দৈনিক পত্রদূত পত্রিকা অফিসে আগুন লাগিয়ে দেয়। পরে তার ব্যবহৃত একটি গাড়ি বাইপাস সড়কে নিয়ে পুড়িয়ে দেয়।
প্রায় একই সময় আন্দোলনকারীরা শহরের বাস টার্মিনাল এলাকায় দৈনিক কালের চিত্র অফিসে লুটপাট শেষে অগ্নিসংযোগ করে। এদিকে কালিগঞ্জ উপজেলার রতনপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সজল মুখার্জীর বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লুটপাট শেষে অগ্নিসংযোগ করা হয়। একই উপজেলার শ্রীধরকাটি গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা শেখ সিদ্দীকুর রহমানের বাড়িতে ভাংচুর ও লুটপাট করা হয়। ভাংচুর ও লুটপাট শেষে অগ্নিসংযোগ করা হয় শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জ ইউপি চেয়ারম্যান অসীম মৃধা, বুড়িগোয়ালিনীর ডালিম ঘরামী, ভবতোষ মন্ডলসহ ৭টি বাড়িতে। ভাংচুর ও লুটপাট করা হয় দেবহাটা উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফারুক হোসেন রতনের বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মুজিবর রহমান ও নওয়াপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান আলমগীর হোসেন ওরফে সাহেব আলীর অফিস ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
শ্যামনগরের রমজাননগর গ্রামের হরিপদ বর্মন ও অরুন বর্মনের বাড়িতে হামলা চালিয়ে লুটপাট শেষে তাদেরকে কুপিয়ে জখম করা হয়।
এদিকে সোমবার সন্ধ্যায় জেলখানা থেকে চলে যাওয়ার সময় আসামি ও কারা কর্তৃপক্ষের সাথে হাতাহাতিতে কমপক্ষে ৫৫ জন আহত হয়। এদের মধ্যে ২১ জন কারারক্ষী ও কর্মকর্তা।
এ সময় আন্দোলনকারীরা শতাধিক কারারক্ষীর রেশন, পিসি কার্ডের টাকা ও ক্যান্টিনের ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা লুট হয়। তবে চলে যাওয়া ৫৯৬ জন আসামির অনেকেই মঙ্গলবার সকাল ১০টার পর থেকে আবারকারাগারে ফিরে এসেছেন। শহরের জীবনযাত্রা এখনও স্বাভাবিক হয়নি।
এ ব্যাপারে সাতক্ষীরার কোন প্রশাসনিক কর্মকর্তার সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি।