বাংলার ভোর প্রতিবেদক
যশোর শহরের অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণ করতেন ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী দুই গ্রুপের নেতারা। এদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হয়ে উঠেছিলেন পৌরসভার চার কাউন্সিলর। তাদের ছত্রছায়ায় সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, ছুরিকাঘাত, দখলবাজিতে বেপরোয়া ছিল চক্রটি। কিশোর গ্যাংয়ের অত্যাচারে নাভিশ^াস উঠেছিল মানুষের। তবুও প্রতিবাদ করার সাহস ছিল না কারো। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর সেই আলোচিত চার কাউন্সিলর আত্মগোপনে গেছেন। কিন্তু কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা এলাকাভিত্তিক প্রভাবশালী ‘বড়ভাই’র ছত্রছায়ায় থাকার চেষ্টা করছেন। আর যারা চিহ্নিত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য, তারাও আপতত গাঢাকা দিয়েছেন। সুযোগ বুঝে ভিড়ে যাবেন কথিত বড়ভাইয়ের দলে। সচেতন নাগরিকরা বলছেন, প্রশাসনের সাঁড়াশি অভিযান না থাকায় ‘ জামাই আদরেই’ আছেন শীর্ষ সন্ত্রাসী ও কিশোর গ্যাং সদস্যরা। জননিরাপত্তা নিশ্চিতে এদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের বিকল্প নেই।
এ বিষয়ে সচেতন নাগরিক কমিটির যশোরের সভাপতি অধ্যক্ষ শাহীন ইকবাল বলেন, বিগত সরকারের সময়ে কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা বেড়েছিল রাজনীতিক অস্থিরতায়। তারা অভ্যন্তরীণ কোন্দলেও একে অপরকে হামলা করেছে। কেউ কেউ নিহত হয়েছে। কিশোর গ্যাংদের বেশির ভাগ সময় স্থায়ী ঠিকানা থাকে না। রাজনীতির চরিত্রও থাকে না। যে দল ক্ষমতায় থাকে তাদের ছত্রছায়াতে থাকে, আধিপত্যে বিরাজ করে। রাজনীতির পট পরিবর্তনের সাথে কিশোর গ্যাংদের প্রকাশ্য তেমন ঘটনা ঘটানো দেখছি না। আমাদের সামাজিকভাবে তাদের প্রতিরোধ করতে হবে। আর কিশোর গ্যাংদের রাজনীতিক নেতাদের আশ্রয় না দেয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।’
যশোরের পুলিশ ও র্যাব সূত্রে জানা যায়, ২০১৪ সালের পর যশোর শহরের কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ নিতে শুরু করেন জনপ্রতিনিধি ও ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতারা। পাড়া মহল্লায় গড়ে উঠে ১৫ থেকে ২২ বছর বয়সীদের নিয়ে কিশোর গ্যাং। সবেচেয়ে বেশি কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম দেখা দেয়, শহরের ষষ্ঠীতলা পাড়া, পুরাতন কসবা, মুজিব সড়ক, তেঁতুলতলা, রেলগেট, তুলোতলা, রায়পাড়া, শংকরপুর, বকচর, বেজপাড়া, খোলাডাঙ্গা, চাঁচড়া, ভাতুড়িয়া, শংকরপুর বাস টার্মিনাল, রেল রোড, মণিহার, উপশহর, পালবাড়ি, ধর্মতলা, খড়কি, খড়কি কলাবাগান, রেল স্টেশন, বিরামপুর, নীলগঞ্জ, সিটি কলেজপাড়া, বারান্দিপাড়া, পুলেরহাট ও শেখহাটি এলাকায়। এদের গডফাদার হিসেবে পরিচিত ছিলেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতারা। কিশোর গ্যাংয়ের গডফাদার হিসেবে বেশি আলোচিত হয়ে ওঠেন পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের মো. সাহিদুর রহমান ওরফে ডিম রিপন। কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্বে ছিল শাহ আলম, পলাশ, মমিন, জিতু, রিমন প্রমুখ। ৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শেখ জাহিদ হোসেন ওরফে টাক মিলনের ছত্রছায়ায় অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে কিশোর গ্যাংয়ের লিডার সাগর, রাব্বি, এনামুল ও শাকিলসহ অন্যান্যরা। ৬ নম্বরের মো. আলমগীর কবির সুমন ওরফে হাজী সুমনের কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্বে ছিল সঞ্জু, শুভ, সাজু, আসাদ, অন্তর, ষষ্ঠীতলার ট্যারা চঞ্চল, শিকদার, বিশাল, বুনো মানিক, নিশান, স্বাধীন, চাঁচড়া রায়পাড়ার রনি, মুই সাগর, মুরাদ, সাইফুল, মামুন, খোকন, শাহিন, জাফর, নয়ন তারাই নিয়ন্ত্রণ করত এই ওয়ার্ডের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড।
৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শাহেদ হোসেন নয়ন ওরফে হিটার নয়ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য আলোচিত নাম। তার নেতৃত্বে ছিল কিশোর গ্যাংয়ের আতংক। তার সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে পরিচিত মাসুদ, অমিত, রাজু, মিঠু, সোহেল, তুহিন, সুহিন ছিল এলাকায় মুর্তিমান আতংক।
কাউন্সিলর রিপন ও নয়ন এক সময় বিএনপির রাজনীতি করলেও সর্বশেষ সদরের সাবেক সংসদ কাজী নাবিল আহমেদের ঘনিষ্ট হিসেবে পরিচিত পান। টাক মিলন বহু বছর শাহীন চাকলাদের সঙ্গে থাকলেও বছর তিন বছর আগে নাবিলের তীরে ভিড়েন। আর হাজী সুমন শুরু থেকেই শাহীনের রাজনীতি করেন। তাদের কিশোর গ্যাংয়ের হাতে জিম্মি হয়ে পড়ে যশোরবাসী। এমন কোন অপরাধ নেই, যার সাথে এই গ্রুপের সংশ্লিষ্টতা ছিল না। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা ভয়ংকর হয়ে ওঠে ছুরিকাঘাতের ঘটনায়। তারা জানত, হত্যা মামলা থেকে নানা সমীকরণে নিস্তার পাওয়া গেলেও অস্ত্র মামলায় নিস্তার নেই। তাই আগ্নেয়াস্ত্রের পরিবর্তে ছুরির ব্যবহারে ঝুঁকে পড়ে। বেড়ে যায় ছুরিকাঘাতের ঘটনা।
আইনশৃঙ্খলার তথ্যমতে, গত এক দশকে শুধু ছুরি ব্যবহার করে যশোরে আলোচিত খুন হয়েছে ৩০ বেশি। ছোট বড় ছুরিকাঘাতের ঘটনা ঘটেছে সহস্রাধিক বলে জানা গেছে। ২০২৩ সালেল ৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় শহরের বেজপাড়া সাদেক দারোগার মোড়ে আলোচিত রাজনৈতিক নেতা ও পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী আসাদুজ্জামান ওরফে বুনো আসাদকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে দুর্বৃত্তরা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর ২১ নভেম্বর তিনি মারা যান। হত্যা, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধে একাধিক মামলার আসামি আসাদ যশোর স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা ছিলেন। এক সময় শাহীন চাকলাদারের কাছের লোক হিসেবে পরিচিত আসাদ খুন হওয়ার ছয় মাসেরও কম সময়ের মধ্যে সদরের এমপি কাজী নাবিল আহমেদের দলে ভিড়ে ছিলেন। ৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. আসাদুজ্জামানকে গত মে মাসে ছুরি দিয়ে হত্যার চেষ্টা করে সন্ত্রাসীরা। ৬ মাস চিকিৎসা শেষে এলাকায় ফিরেন তিনি। একই বছর শহরের চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও হত্যাসহ একাধিক মামলার আসামি ইয়াসিন আরাফাত ওরফে হুজুরে ইয়াসিনকে (২৮) ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা।
বেজপাড়া চোপদারপাড়া এলাকার ব্রাদার্স ক্লাবের এই ঘটনার ৫ মাসের মাথায় জুলাইতে প্রতিশোধ নিতে একই কায়দায় শংকরপুর আকবর মোড়ে খুন করা হয় জেলা যুবদলের সহ-সভাপতি বদিউজ্জামান ধোনীকে। চলতি বছরের ২৬ মার্চ দৃর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে ৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলের অনুসারী রুম্মন হোসেন (৩১) নামে এক যুবক মারা যায়। বুনো আসাদের ঘটনার পরপরই বেজপাড়া বনানী রোডের আক্কাসের ছেলে চঞ্চলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর ১৭ নভেম্বর খাবড়ি হাসান গ্রেপ্তার হয়। সবশেষ এ হত্যা মামলার আসামি শহরের নাজির শংকরপুর মাঠপাড়ার আইয়ুব আলীর ছেলে সুমন ওরফে মাঠ সুমনকে (৩৫) গ্রেপ্তার করে র্যাব। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর আত্মগোপনে চলে গেছেন আওয়ামী লীগের জনপ্রতিনিধি ও তার অনুসারীরা। কিশোর গ্যাংয়ের গডফাদার হিসেবে পরিচিত কাউন্সিলররাও গা ঢাকা দিয়েছেন। সেই সঙ্গে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের অনেকেই ভোল পাল্টে নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এলাকা ভিত্তিক আধিপত্য বিস্তারের কেউ কেউ এদের শেল্টার দিচ্ছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।
চাকু সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণহ নানা অভিযোগের বিষয়ে চার কাউন্সিলর আত্মগোপণে থাকায় কারোও বক্তব্য জানা যায়নি। তবে বিভিন্ন সময়ে ১ নম্বরের কাউন্সিলনর সাহিদুর রহমান ওরফে ডিম রিপন তার বিরুদ্ধে অভিযোগকে রাজনৈতিক চক্রান্ত বলে আখ্যায়িত করে গণমাধ্যমে বক্তব্য দিয়েছেন। আর ৪ নম্বরের জাহিদ হোসেন ওরফে টাক মিলনের দাবি সব মিথ্যা। যদি এত অপরাধ করে থাকেন তাহলে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করছে না কেন?
সদ্য বিদায়ী যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) বেলাল হোসাইন বলেন, বিভিন্ন সময় বেশ কয়েকটি আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে তারা স্বীকার করেছে গুলি করার ঘটনায় অস্ত্র মামলা হয় এবং সাজা থেকে মওকুফ পাওয়ার সম্ভাবনা কম। তাই ছুরি কিংবা চাকুকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে সন্ত্রাসীরা। শহরের কিশোর তরুনেরা অনলাইনে অর্ডারের মাধ্যমে হোম ডেলিভারি নিতো বাহারি নাম ও ডিজাইনের নানা ছুরি ও চাকু। সম্প্রতি অনলাইনে এসব বিক্রি করার বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি বাড়ায় এখন কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও ঢাকা থেকে সংগ্রহ করা হয় বলে জানান যশোরে কাজ করা গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা।