হাসান আদিত্য
গেল ৩১ জানুয়ারি গভীর রাত। একদল ডাকাত যশোরের উপশহর এলাকার গোল্ডেন ইজিবাইক শোরুমের নৈশপ্রহরী আবুল হোসেনকে গামছা দিয়ে বেঁধে ফেলে। এরপর তালা কেটে ভেতরে থাকা ইজিবাইকের ২০০টির বেশি ব্যাটারিসহ ২৫ লক্ষাধিক টাকার পণ্য লুট করে নিয়ে যায়। যে শোরুমে ডাকাতি হয়েছে, তার ২০০ গজের মধ্যে খাজুরা বাসস্ট্যাণ্ডে পুলিশের চেকপোস্ট ছিল। চেকপোস্ট থেকে ১০০ মিটারের মধ্যে রয়েছে উপশহর পুলিশ ফাঁড়ি, কিন্তু পুলিশ কিছুই টের পায়নি। এই ঘটনায় মামলা পরে দুই দিন পার হলেও কূলকিনারা করতে পারেনি পুলিশ। গোল্ডেন বাইক শোরুমের স্বত্বাধিকারী আবুল কাশেম বলেন, ‘রাতে নৈশপ্রহরীর ফোন পেয়ে আমি শোরুমে যাই। গিয়ে দেখি, প্রতিষ্ঠান থেকে ২০০টির বেশি ব্যাটারি, অন্যান্য মালামালসহ প্রায় ২৫ লাখ টাকার পণ্য নিয়ে গেছে। থানায় মামলা করেছি, এখনো কাউকে আটক করতে পারেনি। পুলিশ দ্রুত মালামাল উদ্ধারে আশ্বাস দিয়েছেন।’
গত ২১ ডিসেম্বর গভীর রাতে শহরের শংকরপুর বাসটার্মিনাল এলাকার এসএস মোটরসের সামনে একটি নীল রঙের মিনি পিকআপে ৮ থেকে ১০ জন এসে দাঁড়ায়। এর মধ্যে দুজনের হাতে থাকা কাটার দিয়ে দোকানটির শার্টারের তালা কাটেন। এরপর দোকানে ট্রাক ভিড়িয়ে প্রায় ১৫ মিনিটে ১৮ লাখ টাকার টায়ার লুট করে তারা পালিয়ে যায়। দুঃসাহসিক এই চুরির দুই মাস অতিবাহিত হলেও পুলিশ এখনো কাউকে আটক বা লুটের মাল উদ্ধার করতে পারেনি। এসএম মোটরসের ব্যবস্থাপক সাহেব আলী বলেন, ‘আমার দোকান ছাড়াও আশে পাশের আরো চারটি দোকানে ও বাসা বাড়িতে চুরি হয়েছে। আমরা অভিযোগ দিয়েছি। পুলিশ আটক কিংবা মালামাল উদ্ধার করতে পারেনি। তিনি বলেন, ‘ধার-দেনা করে কোম্পানির কাছ থেকে টায়ারগুলো নেয়া। আবার অনেকের কাছে টায়ার বাবদ অগ্রিম টাকাও নেয়া হয়েছে; কিন্তু এখন তাদের টায়ারও দিতে পারছি না, আবার টাকাও ফেরত দিতে পারছি না।’
যশোরে বর্তমানে ডাকাত বা দুঃসাহসিক চুরির আতঙ্ক বিরাজ করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্যমতে, বাসাবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গত চার মাসে যশোরে ১০টি দুর্ধর্ষ ডাকাতি, অন্তত ২০টি দুঃসাহসিক চুরির ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া দুটি স্থানে ডাকাতির প্রস্তুতিকালে এলাকাবাসীর প্রতিরোধের মুখে পড়ে সটকে যায় ডাকাত দল। এসব ঘটনায় একটিরও কূলকিনারা করতে পারেনি পুলিশ। উদ্ধার হয়নি লুণ্ঠিত টাকা ও মালামাল। ফলে দিনকে দিন আতঙ্ক বেড়েই চলেছে। পুলিশি ব্যর্থতা নিয়ে বিভিন্ন মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্যমতে, গত ৫ জানুয়ারি বাঘারপাড়া উপজেলার ধলগ্রাম ইউনিয়নের বারভাগ গ্রামের পশুপতি দেবনাথ ও বিশ্বনাথ দেবনাথের বাড়িতে ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে ডাকাতি করে। ভুক্তভোগী পশুপতি দেবনাথের ছেলে ব্রজেস্বর দেবনাথ জানান, ভোরে ডিবি পুলিশের পরিচয়ে তাদের ডাকাডাকি করে। দরজা খুলতে রাজি না হওয়ায় তারা ভেঙে ঢুকবে বলে হুমকি দেয়। এ সময় তারা ঘরে ঢুকে বলে, তাদের কাছে তথ্য রয়েছে চট্টগ্রামের এক আসামি এই বাড়িতে লুকিয়ে আছে। এরপর তারা ওয়াকিটকিতে কথা বলতে থাকে। এ সময় নারীদের ভয় দেখাতে থাকে আলমারি চাবি না দিলে তাদের মেরে ফেলবে। বাধ্য হয়ে তাদের হাতে চাবি দিয়ে দেয়া হয়। এরপর তারা পশুপতি দেবনাথের ঘর থেকে নগদ এক লাখ টাকা ও কয়েক ভরি স্বর্ণালংকার নিয়ে নেয়। এরপর বিশ্বনাথ দেবনাথের ঘর থেকে পাঁচ হাজার টাকা ও কয়েক ভরি স্বার্ণালংকার নিয়ে নেয়। দুই পরিবার থেকে সাত ভরি স্বর্ণ ও এক লাখ পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে যায়। ঘটনার এক মাস পার হলেও কাউকে আটক করতে পারেনি পুলিশ।
গত ২৮ ডিসেম্বর বাঘারপাড়া উপজেলার ধুপখালী গ্রামের মালয়েশিয়া প্রবাসী মোহাম্মদ খোকনের বাড়িতে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। একদল ডাকাত ক্লপসিবল গেটের তালা ভেঙে ঘরের ভেতর ঢুকে অস্ত্রের মুখে পরিবারের লোকজনকে জিম্মি রেখে নগদ টাকা ও সোনার অলঙ্কার লুট করে নিয়ে যায়। গত ৯ নভেম্বর গভীর রাতে যশোর শহরতলীর শেখহাটিতে অবস্থিত এসিআই অ্যাগ্রো লিমিটেডের ডিপোতে দুর্ধর্ষ ডাকাতি হয়। মুখে মাস্ক পরা ৮/১০ জনের একদল ডাকাত মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে দুই জন নৈশপ্রহরীকে বেঁধে রেখে নগদ ২০ লাখ টাকা লুট করে নিয়ে যায়। ওই টাকা ছিলো একটি সিন্দুকের মধ্যে। ভাঙতে না পেরে তারা টাকাসহ সিন্দুক নিয়ে যায়। ২৫ অক্টোবর ভোরে পাঁচবাড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল ওয়াদুদের বাড়িতে দুর্ধর্ষ ডাকাতির ঘটনা ঘটে। ৭/৮ জনের একদল ডাকাত জানালার গ্রিল ভেঙে ঘরে ঢোকে। পরে তারা অস্ত্রের মুখে আব্দুল ওয়াদুদ ও তার ছেলের চোখ ও হাত বেঁধে অর্থ ও সোনার অলঙ্কার লুট করে। ডাকাতরা আব্দুল ওয়াদুদের পুত্রবধূর কাছ থেকে চাবি নিয়ে আলমারি খুলে ও শো-কেসের ড্রয়ার ভেঙে প্রায় সাড়ে ৬ ভরি সোনার অলঙ্কার, নগদ পৌনে ৩ লাখ টাকা, সৌদি ১২শ’ রিয়াল এবং কাপড় চোপড়সহ ১০ লক্ষাধিক টাকার মালামাল লুট করে নিয়ে যায়।
গত ২৪ অক্টোবর ভোরে যশোর সদর উপজেলার আরবপুর ইউনিয়নের সুজলপুরের বাসিন্দা মোকসেদ আলীর বাড়িতে ডাকাতির চেষ্টা চলে। কিন্তু ওই বাড়িতে সিসি ক্যামেরা থাকায় তাদের ডাকাতির চেষ্টা ব্যর্থ হয়। প্রতিটি ডাকাতির ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থানায় আলাদা মামলা হয়েছে। তবে কাউকে আটক করতে পারেনি পুলিশ।
এ বিষয়ে যশোর চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মিজানুর রহমান খান বলেন, ‘একের পর এক ব্যবসায়ীদের বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চুরি ডাকাতিতে আতংক বিরাজ করছে ব্যবসায়ী মহলে। ফলে নির্বিঘ্নে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারছে না ব্যবসায়ীরা। তিনি বলেন, যশোরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ব্যাপক অবনতি হয়েছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে নাগরিক সমাজ চরম দুদর্শার মধ্য পড়বে। দ্রুত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানান তিনি।’
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নুর ই আলম সিদ্দিকী বলেন, দু’ একটি ঘটনা দিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পরিমাপ করা যায় না। যেসব ঘটনা ঘটেছে সেসব জায়গায় পুলিশ সদস্যদের দায়িত্ব অবহেলা থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি চুরি, ডাকাতি ঘটনায় পুলিশ কাজ করছে। পুলিশি পেট্রলিং বাড়ানো হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।’ এমন অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে বেশি বেশি যৌথবাহিনীর অভিযান ও টহল বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন সচেতন মহল।