এসএম জালাল
খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার হোগলবুনিয়া-হাটবাটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অ্যাডহক কমিটির সভাপতি পদের জন্য তিনজনের নাম প্রস্তাব করেন জেলা প্রশাসক। সেই তালিকায় যথাক্রমে তপন কুমার বিশ্বাস, সঞ্জয় মল্লিক ও ওবায়দুল হকের নাম ছিল। জেলা প্রশাসকের প্রস্তাবিত নামের তালিকা নিয়ে অ্যাডহক কমিটি অনুমোদনের জন্য আবেদন করেন প্রধান শিক্ষক। প্রথম ও দ্বিতীয় ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে তৃতীয় স্থানে থাকা ওবায়দুল হককে প্রথম প্রার্থী দেখিয়ে সভাপতি হিসেবে মনোনয়ন দেয় যশোর শিক্ষাবোর্ড কর্তৃপক্ষ। তৃতীয় স্থানে থাকা ওবায়দুল হক নিজেই হতবাক হয়েছেন সভাপতি হিসেবে নিজের নাম দেখে। কারণ তিনি সভাপতি হতে চাননি। নিয়ম রক্ষার জন্য তার নাম তিন নম্বরে রাখা হয়।
বাংলার ভোরের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য, গত ২ ফেব্রুয়ারি খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার হোগলবুনিয়া-হাটবাটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অ্যাডহক কমিটির সভাপতি পদের জন্য তিনজনের নাম প্রস্তাব করেন খুলনার জেলা প্রশাসক। সেই প্রস্তাবিত তালিকা অনুযায়ী অ্যাডহক কমিটি অনুমোদনের জন্য আবেদন করেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক। গত ১০ ফেব্রুয়ারি ডিসির সুপারিশকৃত তালিকায় তৃতীয় নম্বরে থাকা ওবায়দুল হককে এক নম্বর প্রার্থী হিসেবে উপস্থাপন করে আবেদনটি অনুমোদনের সুপারিশ করেন উপ-স্কুল পরিদর্শক মো. ডালিম হোসেন। একইদিন তার প্রস্তাবটিতে সায় দিয়ে ওবায়দুল হককে সভাপতি মনোনয়ন দেয়ার সুপারিশ করেন স্কুল পরিদর্শক ড. মো. কামরুজ্জামান। তাদের সুপারিশের ভিত্তিতেই ওবায়দুল হককে সভাপতি করে অ্যাডহক কমিটি অনুমোদন দেন চেয়ারম্যান ড. মোসাম্মৎ আসমা বেগম। কমিটি অনুমোদনের পর হতবাক হয়েছেন খোদ ওবায়দুল হকসহ এলাকাবাসী।
এ বিষয়ে তপন কুমার বিশ্বাস বলেন, স্কুলটি প্রতিষ্ঠায় আমার পরিবারের লোকজনের অবদান আছে। আমিও পৃষ্ঠপোষকতা করি। এলাকার মানুষ আমাকে সভাপতি হওয়ার জন্য অনুরোধ করে। প্রথমে আমি রাজি হইনি। একপর্যায়ে রাজি হই। বাড়িতে গিয়ে ওবায়দুলকে ডেকে বললাম শুনছি তুমি প্রার্থী। তুমি সভাপতি হও, আমি হবো না। তখন ওবায়দুল বলল মামা তুমি হও, আমার আপত্তি নেই। ওবায়দুল আমাকে সমর্থন দেয়। সেই হিসেবে ইউএনও অফিস হয়ে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে তিনজন প্রার্থীর নাম প্রস্তাব করা হয়। ওই তালিকায় তৃতীয় নম্বরে ছিল ওবায়দুলের নাম। আমার জানা মতে ওবায়দুল কোন তদবির করেনি। কিন্তু বোর্ডের কর্মকর্তারা তালিকায় তিন নম্বরে থাকায় ওবায়দুলকে সভাপতি মনোনীত করেছে। কমিটি অনুমোদনের পর ওবায়দুল আমাকে বলেছে, মামা আমি রিজাইন দিয়ে দেব। আমি বলেছি, যেহেতু কমিটি অনুমোদন হয়ে গেছে, রিজাইন দেয়ার দরকার নাই। এই অবস্থায় আছে।’
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হোগলবুনিয়া-হাটবাটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়টির উন্নয়নে ভূমিকা রয়েছে এক নম্বর সভাপতি প্রার্থী তপন কুমার বিশ্বাস ও তার পরিবারের লোকজনের। এলাকাবাসীর সর্বসম্মতিক্রমে তাকে প্রার্থী মনোনীত করা হয়। নিয়মের কারণে আরও দুইজনের নামসহ তিনজনের নাম প্রস্তাব করেন জেলা প্রশাসক। তাকে বাদ দিয়ে ওবায়দুল হককে সভাপতি মনোনীত করায় হতবাক হয়েছেন তিনি নিজেই। প্রথম ও দ্বিতীয় ব্যক্তি বাদ রেখে তৃতীয় ব্যক্তিকে সভাপতি হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছেন বোর্ডের কর্মকর্তারা। তারা ধর্মীয় পরিচয়টিই বিবেচনায় নিয়েছেন বলে ধারণা করছেন এলাকাবাসী।
শুধু খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার হোগলবুনিয়া-হাটবাটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অ্যাডহক কমিটির সভাপতি অনুমোদন নয়, খুলনা বিভাগের ১০ জেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অ্যাডহক কমিটির সভাপতি মনোনয়নের ক্ষেত্রে বোর্ডের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধের গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। বোর্ডের চেয়ারম্যানের ছত্রছায়ায় স্কুল, কলেজ উপপরিদর্শক ও পরিদর্শকদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় পরিচয়, অর্থ বাণিজ্য, পছন্দের একটি বিশেষ দলের নেতাকর্মীদের সভাপতি মনোনীত করার ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। এসব বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন অনেকেই। তবে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সংশ্লিষ্ট অভিযুক্ত কর্মকর্তারা।
জানা যায়, যশোর শিক্ষাবোর্ডের অধীনে খুলনা বিভাগের ৩ হাজার ৩৯৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে নিম্নমাধ্যমিক ৩৩৭টি, মাধ্যমিক বিদ্যালয় দুই হাজার ৪৫৯টি, উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ১২৩টি ও মহাবিদ্যালয় ৪৭৬টি রয়েছে। বুধবার (১৯মার্চ) পর্যন্ত এক হাজার ৮০১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অ্যাডহক কমিটির আবেদন জমা পড়েছে। এর মধ্যে এক হাজার ৭৯৯টি বিদ্যালয় ও ২৭০টি মহাবিদ্যালয় অ্যাডহক কমিটি অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, জেলা প্রশাসক মনোনীত সভাপতি পদে তিনজন প্রার্থীর নাম, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা/জেলা প্রশাসক মনোনীত অভিভাবক সদস্য একজন ও জেলা শিক্ষা অফিসার মনোনীত শিক্ষক প্রতিনিধির নাম সংগ্রহ করে প্রতিষ্ঠান প্রধান শিক্ষাবোর্ডে অনলাইনে আবেদন করছেন। আর এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে অনৈতিক সুবিধা নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। তারা তাদের ইচ্ছা ও পছেন্দের প্রার্থীকে অ্যাডহক কমিটির সভাপতি মনোনীত করছেন। এ ক্ষেত্রে দেখা গেছে প্রথম জনকে বাদ দিয়ে দ্বিতীয় ও তৃতীয় জনকে সভাপতি নির্বাচিত করছেন। এতে করে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে।
অনলাইন আবেদনের ভিত্তিতে বোর্ড কর্তৃপক্ষ অ্যাডহক ম্যানেজিং কমিটি অনুমোদন দিচ্ছেন। সভাপতির নাম প্রস্তাব ও মনোনয়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি বিএনপি ও জামায়াত ইসলামীর নেতাকর্মীদের নাম আসছে। তাদের অনুসারীদের সভাপতি পদে বসাতে সংগঠনের প্যাডে সুপারিশের পাশাপাশি সরাসরি কিংবা মোবাইল ফোনে তদবির করছেন শীর্ষ নেতারা। অনেক প্রতিষ্ঠান প্রধানকে চাপ প্রয়োগ করে একাধিক সভাপতি প্রার্থী হিসেবে নাম প্রস্তাব করতে বাধ্য করার অভিযোগও আছে। কতিপয় কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের অনুসারীদের অগ্রাধিকার দিয়ে সিরিয়াল ভেঙে কমিটি অনুমোদন দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। যা নিয়ে বঞ্চিত অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা অভিযোগ করছেন।
এ বিষয়ে একাধিক প্রতিষ্ঠান প্রধান জানান, ছয় মাস মেয়াদী অ্যাডহক কমিটি অনুমোদনের জন্য শিক্ষা কর্মকর্তা, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে নামের তালিকা সংগ্রহ করে অনলাইনে আবেদন করছি। রাজনৈতিক দলের স্থানীয় ও প্রভাবশালী নেতাকর্মীদের চাপে খুবই বিপাকে আছি। সভাপতি পদে ৩ জনের বেশি নাম দেয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু প্রার্থী কোন কোন ক্ষেত্রে দ্বিগুণের বেশি নাম আসছে। অনলাইনে তিনজনের নাম প্রস্তাব করলেও চাপে পড়ে আলাদাভাবে তাদের তালিকা বোর্ডে পাঠাতে হচ্ছে। তালিকায় নাম না থাকলে অনেকে ক্ষুব্ধ হয়ে হয়রানি করছে। যার ফলে প্রতিষ্ঠান প্রধানরা পড়ছেন উভয় সংকটে।’
এ বিষয়ে নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষাবোর্ডের একাধিক কর্মচারী ও কর্মকর্তা বলেন, বোর্ডের শীর্ষ কর্মকর্তাদের অধিকাংশই একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের অনুসারী। তারা তাদের দলীয় বিবেচনায় অ্যাডহক কমিটির সভাপতি মনোনীত করছেন। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে টাকার বিনিময়ে সভাপতি চূড়ান্ত অনুমোদন দিচ্ছেন। আবার জেলা প্রশাসকের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে ধর্মীয় পরিচয় বিবেচনায় নিয়ে সভাপতি অনুমোদনেরও অভিযোগ পাওয়া গেছে। নজিরবিহীন জালিয়াতির মাধ্যমে অ্যাডহক কমিটির সভাপতি মনোনীত করার অভিযোগ রয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে উপ-বিদ্যালয় পরিদর্শক মো. ডালিম হোসেন বলেন, সভাপতি পদে তিনজনের যেকোন একজনকে মনোনীত করার এখতিয়ার নীতিমালায় বোর্ড চেয়ারম্যানের আছে। কমিটি অনুমোদনে অর্থ লেনদেনের অভিযোগ ভিত্তিহীন। তালিকায় থাকা প্রথম জনকে প্রধান্য দেয়া হচ্ছে বলে তিনি দাবি করেন। তবে তিনজনের যে কাউকে সভাপতি করতে পারে বোর্ড কর্তৃপক্ষ।
এ বিষয়ে উপপরিদর্শক (কলেজ) মোহাম্মদ রকিবুল ইসলাম জানান, জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে সংগৃহীত নামের তালিকার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠান প্রধান আবেদন করছেন। সেই আবেদনের ভিত্তিতে সিরিয়াল অনুযায়ী কমিটি অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। রাজনৈতিক তদবির থাকলে বোর্ড মিটিংয়ের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে নিষ্পত্তি করা হচ্ছে। যদিও অফিসিয়ালি রাজনৈতিক তদবির করার সুযোগ নেই। তবে ব্যক্তিগতভাবে অনেকেই সুপারিশ করছেন। সভাপতি পদে তিনজনের যেকোন একজনকে মনোনীত করার এখতিয়ার নীতিমালায় বোর্ড চেয়ারম্যানের আছে।’
এ বিষয়ে কয়েকদিন কথা বলার চেষ্টা করা হয় যশোর শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান ড. মোসাম্মৎ আসমা বেগমের সাথে। কয়েক দফায় অফিসে গিয়ে ও ফোনে তাকে পাওয়া যায়নি। সাংবাদিক পরিচয় শুনে তিনি ফোন কেটে দেন। সর্বশেষ রোববার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, অ্যাডহক কমিটির কাজ চলছে। এ কমিটি নিয়ে কোন অভিযোগ থাকলে তা লিখিতভাবে জানাতে হবে। এ কথা বলে তিনি ফোন কেটে দেন।